বিগত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে বিরাজ করেছিল বড় ধরনের মন্দাভাব। পূর্বের চেয়ে মার্কেট সূচক, সচল বিও একাউন্ট সংখ্যা ও দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছিল। অবশ্য বর্তমান বছরের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে মার্কেট অনেকটাই বিপরীতমূখী ট্রেন্ড ধারণ করেছে। মার্কেটে যখন নিম্নমূখী ট্রেন্ড থাকে তখন বেশীরভাগ শেয়ারের দাম কমলেও লক্ষ্যনীয় যে কিছু শেয়ারের দাম মার্কেট সূচকের চেয়ে বেশী কমে, আবার কিছু শেয়ারের দাম তেমন একটা কমে না। আপ্ট্রেন্ডের সময়ও সব শেয়ার সমানভাবে বাড়ে না।
অভিজ্ঞরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করবেন যে, মার্কেট যখন ডাউনট্রেন্ডে ছিল তখন জিএসপি ফাইন্যান্স, বিবিএস ক্যাবলস, জিপি, বেক্সিমকো ফার্মা, অলিম্পিক এর মত শেয়ারের দরপতন যে হারে ঘটেছে সে হারে কিন্ত অনেক কোম্পানী যেমন লিন্ডে বিডি, ইউপিজিডিসিএল, ডেল্টা-ব্র্যাক হাউজিং, ম্যারিকোর দাম কমেনি। আরো লক্ষ্যনীয় যে যেসব শেয়ার ডাউনট্রেন্ডে বেশী কমেছিল মার্কেট কিছুটা আপট্রেন্ডে আসার সাথে সাথে তাদের দাম অন্যদের তুলনায় বেশী হারে বাড়তে শুরু করেছে।
মার্কেট ট্রেন্ড তথা ডিএসই ইন্ডেক্স বাড়া-কমার সাথে কোন বিশেষ শেয়ারের দাম বাড়া-কমার হার এর যে সম্পর্ক তাকে পরিসংখ্যানের বিশেষ এক ধারনা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়, যাকে গ্রীক লেটার β বলা হয়। মার্কেট সূচকের উঠানামার সাথে কোন কোম্পানীর প্রাইস উঠানামা তথা Volatality পরিমাপ করে β। এর মান ১ এর বেশী হওয়ার মানে হলো মার্কেট যে হারে বাড়বে বা কমবে তার চেয়ে ঐ শেয়ারটি বেশী হারে বাড়বে বা কমবে। উদাহরণস্বরুপ, সিংগার কোম্পানীর β এর মান ১.২৬ হলে ডিএসই ইনডেক্স যদি ১০% কমে, তবে সিংগার কোম্পানীর প্রাইস কমবে ১২.৬%। আবার আপ ট্রেন্ডের সময় মার্কেট ইনডেক্স ১০% বাড়লে সিংগারের দাম বাড়বে ১২.৬%। সিংগারের প্রাইস সেনসিটিভিটি অধিক হওয়ার ফলেই এটি হয়। β মান ১ এর চেয়ে যত অধিক হবে সে কোম্পানী্র Volatality ঝুঁকিও তত বাড়বে। অপরদিকে β এর মান ১ এর চেয়ে যত কম হবে সে শেয়ারটির Volatality এবং ঝুঁকিও তত কমবে। বুঝাই যাচ্ছে যে ডাউন মার্কেটে কোন কোম্পানীর β এর মান যত কম সে শেয়ার তত বেশী নিরাপদ। কিন্ত নিরাপত্তা বহাল থাকলেও আপ মার্কেটে লাভের সুযোগ কিন্ত কমে যাবে। তাই যদি β এর মান পরিমাপ বা নিদেনপক্ষে অনুমান করা সম্ভব হয় তবে মার্কেট ট্রেন্ড দেখে সে অনুসারে শেয়ার চয়েস করলে বিনিয়োগকারী অধিক লাভের মুখ দেখবে।
বর্তমান কম্পিউটার প্রযুক্তির যুগে একটু সচেতন হলে বিনিয়োগকারী নিজেই ডিএসই এর কোম্পানীসমূহের নিজস্ব β এর মান পরিমাপ করতে পারেন। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভূক্ত কোম্পানীগুলোর মধ্য থেকে ফার্মাসিউটিক্যাল ও ক্যামিকেল খাতের ৩টি, ব্যাংক খাতের ৩টি, আর্থিক প্রতিষ্টান খাতের ৩টি, প্রকৌশল খাতের ২টি, জ্বালানী ও পাওয়ার খাতের ৩টি, টেলিকমিউনিকেশন খাতের ১টি এবং ফুড এন্ড এলাইড খাতের ১টি নিয়ে মোট ১৬টি গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানী চিহ্নিত করে তাদের β মান লেখক কর্তৃক পরিমাপ করা হয়েছে। মার্চ ২০১৩ থেকে জুন ২০২০ সময়ে ডিএসই ইনডেক্স এবং কোম্পানীর ত্রৈমাসিক ক্লোজিং শেয়ার প্রাইসের তথ্য ব্যবহার করে ক্যাল্কুলেশন করা হয়েছে। তাতে দেখা যায় যে জিএসপি ফাইন্যান্স এর β মান ১.৭৭, বিবিএস ক্যাবলস এর ২.৩৫, বেক্সিঃ ফার্মাঃ এর ১.৩৬, ব্র্যাক ব্যাংক এর ১.৯২, প্রিমিয়ার ব্যাংক এর ১.২৩, আইপিডিসি এর ১.৩৫, সিংগার বিডি এর ১.২৬, গ্রামীন ফোন এর ১.২৭, অলিম্পিক ইন্ডাঃ এর ১.২২। অপরদিকে, ম্যারিকো এর β মান ০.২১, লিন্ডে বিডি এর ০.৪১, ইউপিজিডিসিএল এর ০.২, সামিট পাওয়ার এর ০.৮৪, ডিবিএইচ এর ০.৭৬, এনসিসি ব্যাংক এর ০.৮৮ এবং স্কয়ার ফার্মাঃ এর ০.৯১।
আমরা চিহ্নিত কোম্পানীগুলোর পরিমাপকৃত β মান এর সাথে তাদের শেয়ার মূল্যের বাস্তব হ্রাস-বৃদ্ধি মিলিয়ে দেখতে পারি। মোটামুটিভাবে বলা যায় যে ২০১৯ এর প্রথম থেকেই বাজার নিম্নগামী হয়েছিল। সে দরপতন অব্যাহত ছিল অন্তত ৩০ জুন ২০২০ পর্যন্ত। তারপর ১২ আগষ্ট ২০২০ তারিখে এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত মার্কেট উর্ধ্মূখী ছিল বলা যায়।
পর্যালোচনায় দেখা যায় যে ১ জানুয়ারী ২০১৯ থেকে ৩০ জুন ২০২০ পর্যন্ত ডিএসই ইন্ডেক্স এর বার্ষিক ঋণাত্বক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল বা দাম কমেছিল প্রায় ২৩%। তারপর ১ জুলাই ২০২০ থেকে ১২ আগষ্ট ২০২০ পর্যন্ত ডিএসই ইন্ডেক্স এর বার্ষিক ধনাত্বক প্রবৃদ্ধি হয় প্রায় ২৩১%। কিন্ত ১ জানুয়ারী ২০১৯ থেকে ৩০ জুন ২০২০ সময়ে জিএসপি ফাইন্যান্স (β মান ১.৭৭), বিবিএস ক্যাবলস (২.৩৫), গ্রামীন ফোন (১.২৭) এবং অলিম্পিক ইন্ডাঃ (১.২২) (যাদের β মান ১ এর চেয়ে বেশী) এর বার্ষিক হিসাবে দরপতন হয়েছে যথাক্রমে ৪৩%, ৫৫%, ৩৩% ও ২৯% যা ওভারঅল সূচক থেকে অনেক বেশী । অপরদিকে, একই সময়ে সামিট পাওয়ার (০.৮৪) এবং ইউপিজিডিসিএল (০.২), যাদের β মান ১ এর চেয়ে কম, এর বার্ষিক দরপতন হয়েছে যথাক্রমে মাত্র ১০% ও ২৫% যা ওভারঅল সূচক থেকে বেশ কম ।
পরবর্তীতে ১ জুলাই ২০২০ থেকে ১২ আগষ্ট ২০২০ পর্যন্ত, যখন মার্কেট কিছুটা আপট্রেন্ড ধারন করে এবং ডিএসই ইন্ডেক্স এর বার্ষিক ধনাত্বক প্রবৃদ্ধি হয় প্রায় ২৩১% তখন জিএসপি ফাইন্যান্স, বিবিএস ক্যাবলস, গ্রামীন ফোন এবং অলিম্পিক ইন্ডাঃ ( (যাদের β মান ১ এর চেয়ে বেশী) এর বার্ষিক হিসাবে দরবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে ৫৭৯%, ২৪৮%, ৩৬০% ও ১৯৭৪% যা ওভারঅল সূচক বৃদ্ধির হার থেকে অনেক বেশী। ঠিক একই সময়ে সামিট পাওয়ার এবং ইউপিজিডিসিএল, যাদের β মান ১ এর চেয়ে কম, এর বার্ষিক হিসাবে দরবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে মাত্র ২০৮% ও ১৬৭%। গাণিতিক ঐসব ক্যাল্কুলেশনে না যেয়েও এটা সহজেই অনুভব করা যায় যে, বিগত বছরগুলোতে মার্কেট যখন ক্রমাগত নিম্নমূখী হয়েছে তখন জিএসপি ফাইন্যান্স, বিবিএস ক্যাবলস, ব্র্যাক ব্যাংক, ও জিপির মত কোম্পানীগুলোর শেয়ার প্রাইস ব্যাপকভাবে কমে আগের তুলনায় প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। এদের β মান বেশী থাকার ফলে ধারনা করা যায় যে মার্কেট উর্ধ্মূখী হলে সেসব কোম্পানীর শেয়ারদর অন্যান্য কোম্পানীর তুলনায় বেশী হারে বাড়ার কথা। বর্তমানে হচ্ছেও তাই।
অপরদিকে মন্দা চলাকালীন সময়েও ম্যারিকো, সামিট পাওয়ার, ইউপিজিডিসিএল এর মত বেশ কিছু কোম্পানী্র দরপতন কিন্ত খুব বেশী হয়নি। এখন তাদের দামবৃদ্ধিও খুব বেশী হচ্ছে না। সে কারণে β মানকে অনেকে বলে থাকে Double Edged Sword, অর্থাৎ লাভ যেমন বেশী লসও তেমন অধিক। তাই সৃষ্ট মার্কেট পরিস্থিতিকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর উপর নির্ভর করে লাভ কিংবা লোকসান।
উপরের দৃষ্টান্ত দ্বারা বুঝাই যাচ্ছে মার্কেট ডাউনট্রেন্ড বা আপট্রেন্ড এ থাকলে কোম্পানীর β মান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর যার দ্বারা নির্ধারিত হয় কোন কোম্পানীর শেয়ারদাম কি হারে কমবে কিংবা বাড়বে। অবশ্য মার্কেট অনেক সময় সাইডলাইনে থাকে যখন সূচক সামান্য বাড়া-কমার মধ্যে থাকে। সে অবস্থায় β মান এর বড় কোন ভূমিকা নেই।
উপরোক্ত উদাহরণ ও আলোচনা থেকে সাধারন বিনিয়োগকারীগণ কি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে বা স্ট্র্যাটেজী নিতে পারে? সেটা হলো মার্কেটের বর্তমান ট্রেন্ডের ধরণ বুঝে সে অনুযায়ী কোম্পানী চয়েস করা যেতে পারে। ডাউন মার্কেটে রক্ষণশীল বিনিয়োগ এবং আপ মার্কেটে কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে এগ্রেসিভ বিনিয়োগ গ্রহণ করতে সক্ষম হলে বিনিয়োগকারী বেশী লাভবান হতে পারবেন। সবচেয়ে ভাল হয় যদি বিনিয়োগকারীগণ নিজেরা সম্ভাবনাময় কোম্পানীর β মান ক্যাল্কুলেট করতে পারেন। এটি কম্পিউটারের এক্সেল প্রগ্রামের সাহায্যে বের করা যায়। নিজে ক্যাল্কুলেট করার সুবিধা হলো যে দীর্ঘ সময়কালের ডাটা নিয়ে কিংবা দৈনিক বা সাপ্তাহিক ডাটা নিয়ে তা করা যায়। দীর্ঘকালীন ডাটার মাধ্যমে β ক্যাল্কুলেট করলে তা অধিক নির্ভরযোগ্য হবে। বিকল্প হিসাবে www.stockbangladesh.com এর ওয়েবসাইটে যেয়ে Company Beta অংশে সার্চ করে তা পাওয়া যেতে পারে। তাও না পারলে বিনিয়োগকারী খেয়াল করতে পারেন যে মার্কেট যখন ডাউন হয়েছিল তখন ডিএসই সূচকের তুলনায় কোন কোন কোম্পানীর দর বেশী হারে পড়েছিল। বেশী হারে পড়ার কারণ সম্ভবত ঐসব কোম্পানীর প্রাইস সেনসিটিভিটি বেশী অর্থাৎ β মান অধিক। বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেট এখন আপ ট্রেন্ডে রুপ নেওয়ার লক্ষণ ক্রমেই পরিস্ফট হচ্ছে। তাই যেসব কোম্পানীর দাম বেশী পড়েছিল তা এখন বেশী হারে বাড়ার কথা - কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া।
ট্রেন্ড পরিবর্তনকালীন সময়ের মধ্যে কোম্পানীর নিজস্ব অবস্থানের মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হলে সেটা ব্যতিক্রম বলেই ধরে নেয়া যায়। বিনিয়োগকারী তার নিজস্ব ঝুঁকি গ্রহণের অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে সে কোন ধরনের কোম্পানীর শেয়ার কিনবে। ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুকদের জন্য আপ ট্রেন্ডের সময় উচ্চ β মানবিশিষ্ট কোম্পানীতে বিনিয়োগ হবে সঠিক স্ট্র্যাটেজী।
তবে একজন রক্ষণশীল ও দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগকারীর জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ার বেছে নেয়াই হবে উত্তম। সব সময় মনে রাখতে হবে যে Risk আর Reward প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত। তাই বিনিয়োগের আগে কোম্পানী নির্বাচনের অন্যান্য যেসব সূচক বা ইন্ডিকেটর রয়েছে তা ধর্তব্যে নিয়ে তার সাথে মার্কেট ট্রেন্ড এবং কোম্পানীর β মান তথা প্রাইস সেনসিটিভিটি ফ্যাক্টর বিবেচনা করার সক্ষমতা হবে একজন সচেতন বিনিয়োগকারীর আদর্শ স্ট্র্যাটেজী।
লেখক,
অতিরিক্ত সচিব (পিআরএল)
Email: msislam201386@gmail.com