ধর্ষণের মনস্তাত্ত্বিক কারন ও প্রতিকার
সান বিডি ডেস্ক আপডেট: ২০২০-১০-০২ ১৮:২৬:৪৪
বিজ্ঞানী পাভলভ একদল কুকুরকে ল্যাবে বেঁধে রেখে দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। তিনি প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে তাদের খাবার দিতেন।
ব্রেইনের স্বাভাবিক প্রকৃয়া হলো খাবার গ্রহণের সময় লালা ঝরা। কিন্তু পাভলভ দেখলেন যে, খাবার গ্রহণ নয়, খাবার দেখেও এবার কুকুরের লালা ঝরতে শুরু করেছে।
বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর পাভলভ দেখলেন তিনি ল্যাবে ঢুকলেই কুকুরের লালা বের হচ্ছে। সঙ্গে খাবার থাক আর না থাক।
এরপর তিনি কুকুরকে খাবার দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে একই সময়ে একটি ঘণ্টি বাজাতে থাকলেন। খাবার দেয়া হচ্ছে এবং ঘণ্টি বাজানো হচ্ছে।
এরপর পাভলভ খাবার ছাড়াই ঘণ্টি বাজাতে শুরু করলেন। দেখলেন খাবার না দেয়া সত্ত্বেও কুকুরগুলোর একই পরিমাণ লালা ক্ষরণ হচ্ছে।
পাভলভ সিদ্ধান্তে আসলেন খাবারের প্যাকেট, খাবার পরিবেশনকারী, ঘণ্টির শব্দ এগুলো সব নিউট্রাল স্টিমুলেশন। এগুলোর সঙ্গে লালা ক্ষরণের সম্পর্ক নেই। কিন্তু কুকুর তার লার্নিং বিহেভিয়ারে খাবারের সঙ্গে খাবারের প্যাকেট, পাভলভ বা ঘণ্টার শব্দকে লালা ক্ষরণের উপাদান হিসেবে তার ব্রেইন ডিটেক্ট করছে।
মানুষ পরিবেশ, পশু পাখি ও সমাজ থেকে শিক্ষা লাভ করে। বর্তমানে তথ্য প্রবাহের অবাধ প্রবাহের সাথে ভালোর সাথে মন্দ ভেসে আসছে সহজে ও সুলভে। একটি গ্রামের সরল ছেলেও ধান ক্ষেতের আইলে বসে তার স্মার্ট ফোনে সহজেই পর্ণ ছবি দেখতে পাচ্ছে। কুকুরের লার্নিং মেথডের মাধ্যমেই মানুষ সচেতন বা অচেতন ভাবে শিখে নিচ্ছে।
তবুও মানুষ আশরাফুল মখলুকাত। সে কুকুর নয় যে, মেয়ে দেখলেই তাকে ধর্ষণ করবে। তবে মানুষের মধ্যে পশুত্ব আছে।
বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট ফ্রয়েড বলেছেন, যাকে আমরা মন বলি সেটি মূলত তিনটি সত্ত্বার সমন্বয়ে গঠিত ১। ইড, ২। ইগো এবং ৩। সুপার ইগো।
১। “ইড” মূলত মানুষের জৈবিক সত্ত্বা। “ইড” মানুষ এবং পশু সবার মাঝেই সমানভাবে বিরাজমান। “ইড” এর পুরোটাই লোভ লালসা ও কাম। “ইড” হচ্ছে মানুষের ভিতরের সুপ্ত পশু।
২। সুপার ইগো হচ্ছে মানুষের বিবেক। ইড যখন জৈবিক কামনা বাসনা পুরণ করতে উদ্দীপ্ত করে, তখন সুপার ইগো একে বাধা দেয়।
৩। অন্যদিকে ইগো হচ্ছে এই দুই অবস্থার মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টিকারী একটি অবস্থা। ইগো এবং সুপার ইগোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলাই এর কাজ।
জীব হিসেবে মানুষের সাথে অন্য প্রাণীর তেমন পার্থক্য নেই। উভয়েরই ‘ইড’ আছে। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে ইডের সাথে দুইটা জিনিস আছে, যা হলো: ইগো ও সুপার ইগো। আর এ জন্যই মানুষ এত সমৃদ্ধ, এত মহীয়ান, এত গরিয়ান।
উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক:
যেমন, মেয়েটি সুন্দরী, অতএব ওকে ইভটিজিং বা রেইপ করো (ইড বলছে);
রেইপ, ইভটিজিং অপরাধ, অতএব করা যাবে না (সুপার ইগো বাধা দিচ্ছে);
মেয়েটির সাথে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করো, সম্ভব হলে বিয়ের প্রস্তাব দাও (ইগো ব্যালেন্স করছে)।
এখন প্রশ্ন হলো:
১। ইগো, সুপার ইগো, লোক লজ্জা, জেল-ফাসি, হাবিয়া দোযখ বা নরক থাকার পরেও মানুষ ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের কেন লিপ্ত হয়?
২। ছয় বছরের শিশু কিংবা ষাট বছরের বৃদ্ধ কেন ধর্ষিত হয়? যেখানে যৌন তৃপ্তি অবান্তর (ধর্ষণে যৌন তৃপ্তি অসম্ভব) তবুও কেন এই বিকৃত চিত্র সমাজে দৃশ্যমান হয়?
৩। মোল্লা পুরুত কিংবা গির্জার পাদ্রী চরম ধর্মীয় অনুশাষনে থেকেও কেন এই গর্বিত অপরাধে জড়িয়ে যায়?
ধর্ষণের কারন:
১। ব্যক্তির মনের তিনটি অবস্থার মধ্যে ইড(পশুত্ব) এর প্রাধান্য;
২। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব; এবং
৩। নির্দিষ্ট পরিবেশ।
১। ইডের প্রাধান্য:
সুপার ইগো হলো বিবেক। সে খারাপ কাজে আপনাকে বাধা দিবে, কিন্তু যখন আপনি বার বার এই বাধাকে অস্বীকার করবেন তখন সুপার ইগো বা বিবেক দুর্বল হয়ে যাবে। আর সুপার ইগো জাগ্রত না হলে ইগো কার সাথে ব্যালেন্স করবে? ইগো অদৃশ্য হয়ে যায়। তখন মনের রাজা হয়ে যায় বনের পশু (ইড)। সিংহ যেমন যৌন সম্পর্কের তাগিদে তার বাচ্চাদের মেরে ফেলে, তেমনি মানুষ পশুটি যা খুশি তাই করে ফেলে।
২। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব:
ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব তৈরি ও বিকশিত হয় তার শিক্ষার মাধ্যমে। পরিবার, স্কুল কলেজ, সমাজ, বন্ধু, সহকর্মী এবং পরিবেশের কাছেই মানুষ শিক্ষা লাভ করে। আদর্শ, রুচিশীল ও সুস্থ পরিবেশ উন্নত ব্যক্তিত্ব তৈরিতে সহায়ক এবং তা বিকশিত হয়। এর অভাবে মানুষ পাশবিক আচরণে সম্পৃক্ত হয়ে ধর্ষণের মতো অপরাধ করে।
৩। পরিবেশ: বিকৃত ও ব্যক্তিত্বহীন মানুষের মধ্যেই যখন ইডের (পশুত্ব) প্রাধান্য বিরাজ করে তখন অনুকূল পরিবেশ তাকে ধর্ষণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। যেমন: হজ্বের মহাসম্মেলনে নারী পুরুষের বিশাল সমাগমে কোন নারী ধর্ষিত হয়েছে এরূপ কোন ইতিহাস নেই; অথচ রাতের আধারে যাত্রা বা অপেন কনসার্টে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হিমশিম খেতে হয়।
ধর্ষণ থেকে পরিত্রাণের উপায়:
১। পারিবারিক সুশিক্ষা, যত্ন ও ভালবাসার সবার আগে প্রয়োজন;
২। শিক্ষা ব্যবস্থায় অধিক নম্বর পাওয়ার প্রতিযোগিতা থেকেও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে নৈতিক শিক্ষা (ভাল মন্দের পার্থক্য, বড়দের সম্মান আর ছোটদের স্নেহ, দেশপ্রেম, দায়িত্ববোধ, সহনশীলতা, ভদ্রতা, নম্রতা ইত্যাদি)। শিক্ষার মাধ্যমে শিশুটিকে মানবিক করে তুলতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধনী-দরিদ্র, ছেলে-মেয়ে, হিন্দু-মুসলিম ইত্যাদি কোন বৈষম্য সৃষ্টি করা যাবে না। সব শিশুদের শিক্ষার সুযোগ দিতে হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে খেলা-ধূলাসহ সকল সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। কলেজ পর্যায়ে ধর্ষণের কুফল, শাস্তি ও সচেতনতার বিষয় পাঠ্য সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে;
৩। কলেজ পর্যায় থেকে ক্যারিয়ার, মানবিকতা, দেশপ্রেম, অপরের অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে মটিভেশনাল সেশন বা ওয়ার্কশপ চালু করতে হবে;
৪। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার ব্যবস্থা করতে হবে;
৫। আইন শৃঙ্খলার বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি ও দ্রুত বিচার করে তা কার্যকর করতে হবে। সরকারকে এই সামাজিক ব্যধিটিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে (সিঙ্গাপুর এভাবেই নিরাপদ হয়েছে)।
৬। সর্বোপরি, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। ধর্ষিতার লজ্জার কিছুই নেই। এটি ধর্ষণকারীর লজ্জা। সমাজের প্রতিটি স্তরে, গ্রামে-গঞ্জে, পড়ায়-মহল্লায়, স্কুলে-কলেজে, টেলিভিশন বা সামাজিক মিডিয়ার মাধ্যমে আলাপ আলোচনা, সভা-সেমিনার ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যপক প্রচারণা চালাতে হবে। এভাবেই জনগণ সচেতন হবে এবং ধর্ষণ শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনা যাবে।
জি এম কিবরিয়া-
লেখক: ক্লিন গ্রীন বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়ক।
সানবিডি/নাজমুল.০6:20/০২.১০.২০২০