সময়টা ছিল ২০১২ সালের শেষের দিকে। আমি তখন গাজীপুরে ভিয়েলাটেক্স গ্রুপে চাকরি করতাম। ঘটনাক্রমে আমার বসার জায়গাটা ছিল চেয়ারম্যানের চেম্বারের ঠিক পেছনের দিকের একটা কক্ষে। আমরা প্রায় চার-পাঁচ জন সহকর্মী পাসাপাশি বসতাম সেখানে। একদিন দুপুরের দিকে হঠাৎ আমার আশপাশের সহকর্মীরা বলাবলি করতে লাগলেন ইয়ুথ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব ফিরোজ আলম স্যার আসছেন। উনাকে এক নজর দেখার খুব কৌতূহল লক্ষ করলাম সবার মধ্যে। বিষয়টা আমার মধ্যেও একটা আগ্রহের জন্ম দেয়। কে এই ব্যাক্তি? কেনইবা সবাই উনাকে এক নজর দেখতে চায়। অফিস শেষে বের হবার সময় কাকতালীয় ভাবে ভিয়েলাটেক্স এর চেয়ারম্যন স্যার এর সঙ্গে ফিরোজ আলম স্যার ও বের হলেন। আমরা বেশ পেছনের দিকে দাঁড়িয়ে উনাদের চলে যাওয়া দেখছিলাম। সাদা রঙ্গের হালকা সিল্ক অথবা সুতি কাপড়ে বানানো পায়জামা আর পাঞ্জাবীতে খুব ধীর গতিতে হেঁটে যাচ্ছিলেন ফিরোজ আলম স্যার। স্বকীয় পোশাক আর হেঁটে যাওয়ার ভঙ্গীতে উনার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে যেকাউকে একটা স্পষ্ট ধারনা দিতে বাধ্য। বলতে গেলে এটাই ছিল উনার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। জানতে পারলাম ভিয়েলাটেক্স গ্রুপ ও ইয়ুথ গ্রুপের যৌথ উদ্যোগে একটা বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে। সে বিষয়ে আলোচনার জন্য উনি এসছিলেন। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের আওতায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালন ক্ষেত্রে উনাকে বাংলাদেশের একজন অন্যতম অভিজ্ঞ ব্যাক্তি হিসেবে পরিগণিত করা হয়।
দৈবক্রমে এর ঠিক মাসছয়েকের মাথায় আমার রিজিকের ফয়সালা হয়ে যায় ইয়ুথ গ্রুপে। প্রায় ছয় বছর টানা কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার উনার সঙ্গে। চার দশকের কর্মজীবনে ফিরোজ আলম স্যার ছিলেন অত্যন্ত সফল একজন ব্যক্তিত্ব। ছিলেন একজন সফল শিল্প উদ্যোগতা। তৈরি পোশাক খাত থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ, জ্বালানী, উন্নত শিক্ষা ও আর্থিক খাতে সমান পদচারনা ছিল তার। ট্রেডিং ব্যবসা থেকে সবসময় দূরে থাকতে দেখেছি তাকে। ট্রেডিং করে অনেক অর্থ উপার্জন করার সুযোগ থাকলেও কখনো তিনি তা করেননি। শিল্পের মাধ্যমে দেশীয় সম্পদের উন্নত ব্যবহার ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে একের পর এক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন তিনি। ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের এক অসাধারন সাম্যতা রক্ষা করতে দেখেছি তাকে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন মানুষ। ইয়ুথ গ্রুপে বহু বছর ধরে কাজ করা আমার জ্যেষ্ঠ সহকর্মীবৃন্দ ও ফিরোজ আলম স্যারের পরিবারের তথ্যসুত্রে উনার সেই অসাধারন ব্যক্তিত্ব নিয়ে একটু বিশ্লেষণের প্রয়াস রেখেছি।
দুঃসাহসিক আত্মবিশ্বাস
শৈশব থেকে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দুরন্ত আর আত্মবিশ্বাসী। জ্ঞ্যান আহরনের প্রচণ্ড রকমের ইচ্ছা সবসময় তাকে তাড়া করে বেড়াতো। অন্যান্য সহপাঠীরা যখন বই মুখস্ত করা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো উনি তখন বই পড়ে ছিঁড়ে ফেলতেন। উনার আত্মবিশ্বাস উনাকে সেই পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যেখান থেকে উনি মনে করতেন বইয়ের লেখা তথ্য বা জ্ঞ্যান উনার মস্তিষ্কে চিরতরে গেঁথে গিয়েছে।
ঝুঁকি মানসিকতা
দুঃসাহসিক ঝুঁকি গ্রহন করা ছিল তার চরিত্রের একটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। উনি বিশ্বাস করতেন একজন উদ্যোগতার প্রধান কাজ হচ্ছে ঝুঁকি পরিমাপ ও গ্রহন করা আর ব্যবসা পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে পেশাদার ও অভিজ্ঞ কর্মীদের কাজ। ব্যবসায় সুশাসন ও জবাবদিহিতার প্রয়োজনে এটি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। যে সমস্ত ব্যবসায়িক ধারনাগুলো গতানুগতিক উদ্যোগতারা উপেক্ষা করতেন উনি সে ধারনাগুলো নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করেছেন এবং বিনিয়োগ করেছেন। শেষ পর্যন্ত লেগে থেকে চূড়ান্ত সফলতা বের করে আনার অহরহ নজীর রয়েছে তার ব্যবসায়িক কর্মজীবনে।
উদ্ভাবনী ক্ষমতা
অভিনব প্রযুক্তি আর নতুনত্বের প্রতি ছিল তার প্রগাঢ় আগ্রহ। অনলাইন ও বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তিনি প্রচুর পড়াশোনা করতেন। নিজেকে সবসময় হালনাগাদ রাখতেন। উনি কখনো উনার জানার পরিধি নির্দিষ্ট কোন বিষয়ের উপর সীমাবদ্ধ রাখেননি। তার জ্ঞ্যানের ব্যাপ্তি ছিল অপরিসীম। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ব্যবসায় প্রসাশন থেকে শুরু করে অর্থ ও হিসাব শাস্ত্র এবং সাচিবিয় বিষয়েও ছিল তার সমান ধকল। ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে হিসাব ও অর্থ এবং ব্যবস্থাপনা ও মানবসম্পদ বিভাগ পর্যন্ত আমরা সকলে কোন একটা কঠিন সমস্যা নিয়ে তার কাছে গেলে উনি অত্যন্ত সাবলীলভাবে সমাধান দিয়ে দিতেন।
অদম্য
উনি ছিলেন অদম্য ইচ্ছাশক্তির সারসংক্ষেপ। কাজের সময় বাঁচানোর জন্য সপ্তাহের যে দিনগুলোতে তিনি ঢাকার অদুরে আমাদের প্ল্যান্ট গুলো দেখতে যেতেন সে দিন গুলোতে সুর্যদোয় হবার আগে রওনা হতেন যাতে করে পুরো অফিসের সময়কালটা তিনি কাজে লাগাতে পারেন। কখনো কোন কাজকে তিনি ছোট করে দেখেননি প্রত্যেকটি কাজকে তিনি সমান গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতেন।
অকৃত্রিম বন্ধুত্ববোধ
উনার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার ছিলেন ইয়ুথ গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান জনাব রেজাকুল হায়দার স্যার। বন্ধুত্ববোধের এরকম অটুট বন্ধন বাংলাদেশের ব্যবসায়িক জগতে অদ্বিতীয়। দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ বছরের বন্ধুত্ব জীবনে উনারা কখনো কোন একটি দিন না কথা বলে কাটাননি। জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত উনারা নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে গ্রহন করেছেন। এ বন্ধুত্ব কেবল নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না ছড়িয়ে গিয়েছে তাদের দুটি পরিবারের মধ্যে। দুই পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মধ্যে তাঁদের অকৃত্রিম বন্ধুত্বের প্রতি রয়েছে পরম শ্রদ্ধা।
শৈশব ও পরিবার
ফিরোজ আলম ১৯৫৬ সালের ৩০শে এপ্রিল চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তারা ছিলেন ছয় ভাই ও দুই বোন। মাত্র দু বছর বয়সে পিতা হারিয়ে খুব অল্প বয়সেই জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। আর্থিক অসচ্ছলতার কারনে খুব অল্প বয়সেই পরিবারের হাল ধরতে হয়েছিলো। সংগ্রামের সেই কঠিন সময়গুলোতে অনেক ত্যগ ও কষ্টের বিনিময়ে সম্ভব হয়েছে তার আজকের এই সফলতা।
সবুজের প্রতি ভালোবাসা
সবুজের প্রতি তাঁর ছিল অদ্ভুত রকমের টান। ইয়ুথ গ্রুপের প্রতিটি প্ল্যান্টে উৎপাদন কাঠামো তৈরি করার আগে তিনি বিভিন্ন ফুল ও ফলজ বৃক্ষ রোপণ করে একটি সবুজ বেষ্টনী তৈরি করেছেন। ইয়ুথ গ্রুপের উৎপাদন কাঠামোগুলো তাঁর সবুজের প্রতি ভালবাসার নীরব সাক্ষী হিসেবে রয়ে গিয়েছে। তিনি নিজের হাতে প্রতিটি চারা গাছ নির্বাচন করে দিতেন। শত ব্যাস্ততার মধ্যেও বাগান পরিচর্যায় আলাদা সময় বের করে নিজেকে নিযুক্ত করতেন।
অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে বিশ্বাস
ফিরোজ আলম স্যার অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে বিশ্বাস করতেন। প্রিয় মাতৃভূমি সন্দ্বীপের প্রতিটি মানুষের দুঃখ ও দুর্দশা তিনি শৈশব কাল থেকেই অনুধাবন করতেন। নিজের এলাকার পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর জন্য কিছু করার চেষ্টা থেকে প্রিয় বন্ধু জনাব রেজাকুল হায়দারকে ও পরিবারের অন্যান্য সদশ্যদের সঙ্গে নিয়ে গঠন করেন স্বর্ণদ্বীপ ফাউন্ডেশন নামে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের অধিনে ইতিমধ্যে ৩০ (ত্রিশ) শয্যা বিশিষ্ট একটি হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে। আজ তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে প্রিয় বন্ধু রেজাকুল হায়দারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে হাসপাতালের শুভ উদ্বোধন সম্পন্ন হচ্ছে।
পরিবারের প্রতি ভালোবাসা
ফিরোজ আলম স্যার স্ত্রী, এক কন্যা ও দুইজন ছেলে সন্তান রেখে গিয়েছেন। পরিবারের প্রতি ছিল তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা। প্রত্যেক সন্তানদের পছন্দ ও অপছন্দ সমূহ সবসময় তিনি মনে রাখতেন এবং আলাদা ভাবে যত্ন নিতেন। সন্তানদের কাছে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ বাবা আর স্ত্রীর কাছে একজন আদর্শ স্বামী। নাতি নাতনীদের নিয়ে খেলাধুলা করতে পছন্দ করতেন সব সময়। নাতি নাতনীরা ছিল তাঁর প্রানের বন্ধু।
সেপ্টেম্বর ২০১৯ এর শেষের দিকে উনি খুব অসুস্থ বোধ করেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতের মেডান্টা মেডিসিটি হাঁসপাতালে বেশ কিছুদিন চিকিৎসা নিতে হয়েছিলো তাঁকে। জীবন সম্পর্কে উনি অনেক আশাবাদী ছিলেন। দেশ ছেড়ে যাবার সময়ও উনি সুস্থ হয়ে আসার পরের কাজের পরিকল্পনা করে গিয়েছিলেন। উনার চলে যাওয়াটা ছিল আমাদের সবার জন্য খুবি অপ্রত্যাশিত। উনি মাঝে মাঝে চিকিৎসার প্রয়োজনে দেশের বাইরে যেতেন আবার চলেও আসতেন। আমরা সবাই ধরেই নিয়েছিলাম স্যার এবারও ঠিক একই ভাবে আমাদের মধ্যে ফিরে আসবেন। আমরা কখনই মনে করি না যে স্যার আমাদের মাঝে নেই। ইয়ুথ গ্রুপের প্রতিটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বের সাথে ফিরোজ আলম চিরদীন বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে।
• তথ্যসূত্র – ফরিদুল আলম
• লেখা সত্ত্ব – ইয়াছিন আহমেদ