২০৪১ সালে সুখি সমৃদ্ধ উন্নত দেশ হবে বাংলাদেশ। উন্নত দেশ পরিচালনার জন্য উন্নত নাগরিক প্রয়োজন। প্রশ্ন হতে পারে, নাগরিক কেন? উন্নত রাজনীতিবিদ ও আমলা হলেই উন্নত দেশ পরিচালনা সম্ভব!
নাগরিকের অংশগ্রহণ ও তাদের জীবন মানের উন্নয়ন ছাড়া কোন দেশ উন্নত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তার সাথে যুক্ত হয়েছে সুখি শব্দটি। তাই কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ পেতে হলে প্রতিটি নাগরিকের দিকে সমান দৃষ্টি দিতে হবে যেন একটি জ্ঞানভিত্তিক, শারীরিক ও মানসিক ভাবে সুস্থ-সবল এবং সর্বপ্রকার কুসংস্কার, অজ্ঞতা ও গোড়ামীমুক্ত একটি প্রজন্ম পেতে পারে বাংলাদেশ।
কাজটি কি সহজ?
মোটেই না। তবে বেশি কঠিনও নয়।
পৃথিবীতে মানব জাতির এত অর্জনের পিছনে মাত্র একটি জিনিস টনিকের মতো কাজ করেছে, তা হলো শিক্ষা।
আজকের তরুণ ও শিশু ২০৪১ সালের সমৃদ্ধ বাংলাদেশের চালিকা শক্তিতে পরিণত হবে। তাদের সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করবে অনাগত শিশু। তাই অগ্রাধিকার ও জরুরী ভিত্তিতে পানি ঢালতে হবে প্রাথমিক শিক্ষা নামক চারাগাছটিতে।
২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতিতে সে কথারই ইঙ্গিত রয়েছে।
শিক্ষানীতি অনুয়ায়ী ‘প্রাথমিক শিক্ষা হবে সর্বজনীন, বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক এবং সবার জন্য একই মানের।
শিক্ষানীতি অনুয়ায়ী প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য গুলো নিম্নরূপ:
১। কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে এক ও অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি সব ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বাধ্যতামূলক করা।
২। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর দেশাত্মবোধের বিকাশ ও দেশ গঠনমূলক কাজে উদ্বুদ্ধ করা।
৩। শিশুর মনে ন্যায়বোধ, কর্তব্যবোধ, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, মানবাধিকার, কৌতূহল, প্রীতি, সৌহার্দ্য, অধ্যবসায় ইত্যাদি নৈতিক ও আত্মিক গুণাবলি অর্জনে সহায়তা করা।
৪। বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিমনস্ক করা এবং কুসংস্কারমুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে উৎসাহিত করা।
৫। শিক্ষার্থীকে জীবনযাপনের জন্য আবশ্যকীয় জ্ঞান, বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা, জীবন-দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, সামাজিক সচেতনতা অর্জন এবং পরবর্তী স্তরের শিক্ষা লাভের উপযোগী করে গড়ে তোলা।
৬। কায়িক শ্রমের প্রতি আগ্রহ ও মর্যাদাবোধ এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষা সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারণা সৃষ্টি করা।
৭। আদিবাসীসহ সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার স্ব স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
৮। সব ধরনের প্রতিবন্ধীসহ সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত ছেলেমেয়েদের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
তাছাড়াও বহুধাবিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থার (কমিউনিটি বিদ্যালয়, রেজিস্ট্রার্ড ও রেজিস্ট্রিহীন বিদ্যালয়, সরকারি বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন, গ্রামীণ ও শহুরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, মাদ্রাসা ইত্যাদি) মধ্যে বিরাজমান প্রকট বৈষম্য দূর ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে আট বছর মেয়াদি সমন্বিত শিক্ষা কর্মসূচি চালু করার কথা শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে।
তাছাড়াও বলা হয়েছে:
১।গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ বিকাশের জন্য পারস্পরিক মতাদর্শের প্রতি সহনশীল হওয়া এবং জীবনমুখী ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশে সহায়তা করা।
২। মুখস্থবিদ্যার পরিবর্তে আনন্দদায়ক সৃজনশীল পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থী যাতে চিন্তা ও কল্পনাশক্তির বিকাশ ও অনুসন্ধিৎসু মননের অধিকারী হয়ে মানসম্মত প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন করতে পারে, তা নিশ্চিত করা।
৩। শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে স্থানীয় জনসাধারণকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা।
৪। ব্যবস্থাপনার সামগ্রিক বিকেন্দ্রীকরণ, ব্যবস্থাপনা কমিটিকে আরও ক্ষমতা প্রদান, নারী অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করা।
৫। যথাযথ মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগে শিক্ষক নির্বাচন কমিশন গঠন, দেশে-বিদেশে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষকের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, শিক্ষকের দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি করা।
৬। শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ইত্যাদি করা।
৭। পাঠ্যসূচি অনুযায়ী বাংলা, ইংরেজি, নৈতিক শিক্ষা, বাংলাদেশ স্টাডিজ, গণিত, সামাজিক পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ধারণাসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিচিতি এবং তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বাধ্যতামূলক করা।
৮। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জীবন উপযোগী প্রাক-বৃত্তিমূলক ও তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা প্রদান করা, ইত্যাদি।
শিক্ষা নীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তা বাস্তবায়নের সুপারিশ সমূহ চমৎকার। সমস্যা হলো, এদের বাস্তবায়ন। আর এ পরিকল্পনাগলোর সঠিক বাস্তবায়ন না হলে ২০৪১ সালের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ পরিচালনার সঠিক কারিগরের ঘাটতি দেখা দেবে আবশ্যিকভাবে। আর বিদেশী জনবলের হাতে কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ কতটা নিরাপদ তার যথেষ্ট সংশয় আছে। আর পরশ পাথর পেয়ে হারানোর বেদনা জাতি সইতে পারবে তো?
চ্যালেঞ্জসমূহ:
১। শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাথমিক পর্যায়ে (১ম-৮ম) কমপক্ষে ১২-১৩ প্রকারের শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমানে প্রচলিত আছে। প্রত্যেকেই অনড় নিজ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে। প্রাথমিক-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব লক্ষণীয়।
২। মানসম্মত শিক্ষক: এই শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে সবচেয়ে ভূমিকা যারা পালন করবে তারা হচ্ছেন শিক্ষক সমাজ। বাস্তবে মানসম্মত শিক্ষক ও প্রশিক্ষকের যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
৩। অবকাঠামো উন্নয়ন: সরকার যোগাযোগ খাতের মত শিক্ষা খাতে বরাদ্দ তেমন বৃদ্ধি করতে পারছে না, ফলে শিক্ষা অবকাঠামোর অভাবে মানসম্মত শিক্ষা প্রদান ব্যহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
৪। জনগণকে অধিক মাত্রায় সম্পৃক্ত করা যাচ্ছে না, ফলে জবাবদিহিতা ও তাদের যথেষ্ট সহযোগিতার পাওয়া যাচ্ছে না।
৫। বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় অশিক্ষিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আধিপত্য লক্ষণীয়। ফলে একদিকে শিক্ষকদের মর্যাদাসহ শিক্ষার অধিনায়ন চেতনা যেমন বিঘ্নিত হচ্ছে, তেমনি স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সুস্থ ব্যবস্থাপনা অধরায় থেকে যাচ্ছে।
সুপারিশসমূহ:
১। প্রথমেই বাংলাদেশের সকল প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূকে জাতীয়করণ করতে হবে। অতঃপর কেউ যেন সরকারের পূর্বানুমোদন ছাড়া এ ধরনের বিদ্যালয়ের তৈরি না করতে পারে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
২। কিন্ডারগার্টেন সমূহকে যাদের অবকাঠামো ভাল আছে তাদেরকে জাতীয়করণ আর বাদবাকিদের বিলুপ্ত করতে হবে।
৩। কওমি মাদ্রাসাসমূহকে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে মূল ধারায় সম্পৃক্ত করতে হবে এবং তাদের জীবন মানের উন্নয়নের নিমিত্তে দ্বীনি শিক্ষার পাশাপাশি তাদেরকে কর্মমুখি বা কারিগরী শিক্ষার সুযোগ দিতে হবে।
৫। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষক নিয়োগের জন্য পৃথক কমিশন গঠন করতে হবে। মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে আকর্ষণীয় বেতন ও গ্রাম ভাতার প্রচলন করতে হবে। তাছাড়া সকল শিক্ষকেরকে একটি বিশেষ ক্যাডারভূক্ত করে তাদের মর্যাদা প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করতে হবে।
৬। শিক্ষকদের তিনবছর অন্তর অন্তর বাধ্যতামূলক দেশি বিদেশী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৭। প্রতিটি বিদ্যালয়ে থাকবে খেলার মাঠ, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, শিশু কর্ণার, লাইব্রেরি ও তথ্য যোগাযোগ কেন্দ্র।
৮। প্রতিদিন বিদ্যালয়ে জাতীয় সঙ্গীত ও শরীরচর্চার পর ছাত্র-শিক্ষক সমন্বয়ে ১০ মিনিটের পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি পালন এবং হাত ধৌতকরণ কর্মসূচি পালন করতে হবে।
৯। বিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে পুষ্টি ও পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করে মিড ডে মিল বা দুপুরের খাবার চালু করতে হবে।
১০। জনগণের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে প্রতিমাসে একদিন অভিভাবক দিবস পালন করতে হবে। তাছাড়া প্রতিটি জাতীয় দিবসে জনগনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১১। বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের সম্পৃক্ত করতে প্রতিটি বিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলকভাবে এলামনাই এসোসিয়েশন গঠন ও এসোসিয়েশন মনোনীত একজন সদস্যকে বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদে সম্পৃক্ত করতে হবে।
১২। বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটিকে ঢেলে সাজাতে হবে। সভাপতি ও সদস্যদের শিক্ষাগত ও অন্যান্য যোগ্যতা, দায়িত্ব ও ক্ষমতা উল্লেখ করে একটি অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে সভাপতি স্নাতকোত্তর ও সদস্যগণ স্নাতক ডিগ্রিধারী হবেন।
১৩। সর্বক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে দুদকের আদলে একটি শক্তিশালী মনিটরিং কমিশন গঠন করতে হবে।
উপরোক্ত ব্যবস্থাসমূহ বাস্তবায়নে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। এক্ষেত্রে জিডিপির ৭ শতাংশ বরাদ্দের পাশাপাশি স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণের জন্য প্রাথমিকভাবে থোক বরাদ্দের ব্যবস্থা করতে হবে।
আমড়া গাছে যেমন আম আশা করা যায় না, তেমনি বর্তমান বহুধাবিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ২০৪১ সালের সেই স্বপ্নের সমৃদ্ধ ও উন্নত অর্থনীতি পরিচালনার জন্য দক্ষ নাগরিক শক্তি গঠন সম্ভব নয়।
এটি একটি বড় বিনিয়োগ বটে। তবে শিক্ষার বিনিয়োগ ও তার সফলতার মাধ্যমে অনেকাংশেই অন্যসকল বাজেট যেমন: স্বাস্থ্য, অভ্যন্তরীণ আইন শৃঙ্খলা, পরিবেশসহ অন্যান্য খাতের বরাদ্দ কমে আসবে। আর আমরা পেয়ে যাব সুখি সমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলা।
লেখক: জি এম কিবরিয়া
প্রধান সমন্বয়কারী
ক্লিন গ্রিণ বাংলাদেশ।