এ লজ্জা কোথায় রাখি!
:: আপডেট: ২০২০-১০-০৭ ১৫:৫০:৪০
১। ত্রুটিপূর্ণ পারিবারিক শিক্ষা:
কেউ ধর্ষক হয়ে জন্মায় না। কোন পরিবার বলে দিচ্ছে না তুমি নারী-শিশু ধর্ষণ কিংবা নির্যাতন করো। হয়তো পরিবার বুঝতেই পারছে না তাদের সন্তান কিভাবে অবক্ষয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছ। বাবা মা হয়তো ছেলের সাথে বসে টিভিতে এডাল্ট সিন দেখছে। উচ্চবিত্ত ছেলেটি পার্সোনাল রুমে আর গ্রামের ছেলেটি জমির আইলে বসে মোবাইলে পর্ন দেখছে সে খবর পরিবার রাখছে না। ছেলেকে ৭-৮ বছরেই স্মার্ট ফোন দিয়েছেন স্মার্ট হতে। বাবা মা মোবাইলে ব্যস্ত আছেন, ছেলেও মোবাইলে ব্যস্ত। বাহ! কি চমৎকার! ছেলেটি কোন শব্দই করে না। সারাক্ষণ কম্পিউটারে কি নিয়ে যেন ব্যস্ত থাকে। অথবা সন্তানকে বাইরে কারও সাথে মিশতে দিচ্ছেন না, খারাপ হয়ে যাবে ভয়ে। এতে আপনার শিশুর সহমর্মিতা, ব্যক্তিত্ব ও সামাজিক মূল্যবোধ কিছুই বিকশিত হচ্ছে না। ফলে অপরাধের মানসিকতা নিয়ে গড়ে ওঠছে আপনার সন্তান। এ দায় পরিবারের ওপরেই বর্তাবে সর্বাগ্রে।
তাছাড়া বাচ্চারা দেখে শেখে। বাচ্চা দেখছে, তার বাবা, তার মাকে মারছে, পরিবারে সারাক্ষণ অশান্তি লেগেই আছে। এতে ছেলিটি বিরক্তি ও প্রতিশোধ প্রবন হয়ে বেড়ে উঠছে। অপরদিকে, যৌথ পরিবার প্রথা ভেঙে পড়ায় ছেলের অপরাধ মা-বাবার চোখে পড়ে না। সে কোন অপরাধ করলে মা বাবা বলছে যে, ছেলেরা একটু দুষ্টামি করেই, তাছাড়াও সে অনেক ছোট! তাছাড়াও অনেক পরিবারে কন্যা শিশু থেকে ছেলেকে প্রধান্য দেয়া হয় বেশি। তখন ছেলেটি ধরেই নেয় যে পুরুষ হওয়ার কারণে তার কোন অপরাধ, অপরাধ নয়। এভাবে সে হয়তো প্রথমে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়। পর্যায়ক্রমে এসব মানসিক উৎসাহ তাকে বিকৃত সহিংসতার কাজ করতে সহায়তা করে।
২। নৈতিকতা শিক্ষার অভাব:
ছেলেটি বাবাকে দেখছে সাধারণ কেরানী বা ড্রাইভার হয়েও বিলাসবহুল জীবন যাপন করছে। সমাজে টাকার উপর ভিত্তি করে মানুষকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। শিক্ষা, নম্রতা বা ভদ্রতাকে দুর্বলতা মনে করছে সমাজ। তাছাড়া স্কুলে কলেজে, মাদ্রাসায় যিনি শিক্ষা দিচ্ছেন তিনি নৈতিকতার প্রান্তিক পর্যায়ে রয়েছেন, তাঁদের অনেকেরই কথা কাজে মিল নেই। তাই ছেলেটি ঘরে বাইরে তার রোল মডেল হারিয়ে নীতি নৈতিকতার শিক্ষার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। অপরদিকে ছেলেটি দেখে ক্ষমতার দাপট দেখাতে পারলে অর্থ বিত্ত জস খ্যাতি সবই অর্জিত হয় সহজে। এভাবে শিশুটি তরুণ হয়ে ওঠে ত্রুটিপূর্ণ মনণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। আর ত্রুটি ও বিকৃতভাবে বেড়ে উঠা তরুণটি ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে শো ডাউন করতে সচেষ্ট থাকে।
৩। নারীকে হীন করে দেখার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি:
কি পরিবার, কি সমাজ সবক্ষেত্রে নারীকে দমিয়ে রাখা, টিটকেরি ফাজলামি করা ( গরিব হলে তো কথাই নেই, গরিবের বউ সবার ভাবী), তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার মানসিকতা সমাজে এখনও প্রবল। যৌনতার ক্ষেত্রে নারীর কোন ইচ্ছা বা স্বাধীনতার বা কোন মূল্য নেই। নারীকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য বা হীন মানসিকতা নারীর প্রতি সহিংসতার জন্ম দিচ্ছে৷
৪। ক্ষমতার দাপট:
নোয়াখালীর ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায় ঐখানে ঐ তরুণরা নারীর ওপর কেবল যৌন হয়রানি করছে বিষয়টা, তা নয়। এখানে একটা ক্ষমতার দাপটও দেখিয়েছে। ভিডিও চিত্রে দুর্বৃত্ত হিসাবে যাদের দেখা গেছে, তাদের বেশিরভাগের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে হবে। কৈশোর থেকে সদ্য তারুণ্যে পা দেয়া এই বয়সটিতে ক্ষমতা প্রদর্শনে এক ধরণের মানসিকতা কাজ করে।
৫। বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা:
বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা বা সহজে জামিন পাওয়ার ফলে এসব অপরাধী ভাবে সে বুঝি খালাস পেয়েই গেছে। ফলে সে বা তার সাঙ্গ পাঙ্গরা ভিকটিমকে ভয় ভীতি বা মধ্যস্থতার মাধ্যমেই সমাধানের চাপ দিতে থাকে। ক্ষেত্রে বিশেষ গ্রাম্য সালিশি ধর্ষকের সাথেই ভিকটিমের বিয়ে দিয়ে দেয়। এভাবে অপরাধীকে পুরস্কার বা অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ফলে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়।
৬। জেন্ডার বা যৌন শিক্ষার অভাব:
পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রে সঠিক যৌনশিক্ষা ও জেন্ডার শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় তরুণরা ত্রুটিপূর্ণ মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠছে।
মনস্তত্ব বিশেষজ্ঞ সিগমান্ড ফ্রয়েড বলেছেন যে, “ক্ষুধাবৃত্তির মতো যৌনাকাঙ্ক্ষা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কেউ যদি সেই চাহিদা যৌক্তিকভাবে মেটাতে না পারে, তখন যে অযৌক্তিকভাবে সেটা অর্জনের চেষ্টা করবে। একজন তার যৌন চাহিদা নিবৃত্ত করতে না পারলে তার ভেতরে পারভার্সন চলে আসে এবং সেটা বিকৃত উপায়ে সে অর্জনের চেষ্টা করে।” এ কারণে সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে বলে ফ্রয়েড মনে করেন।
৭। সামাজিক প্রচার প্রচারণার অভাব:
সামাজিক সচেতনতা বা প্রচারের অভাবে ভিকটিম বা তার পরিবার ধর্ষণকে নিজেদের অপরাধ বা অদৃষ্ট মনে করে (ঐ মাগি তোর চলন ভাল না)। ফলে সে বিষয়টি গোপনে চেপে যায় বা আইনের আশ্রয় নিতে চায় না।
প্রতিকারঃ
বাস্তবে ধর্ষণ ধর্ষকের লজ্জা। এক্ষেত্রে যদি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়, তবে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে উঠবে। পাশাপাশি পারিবারিক সচেতনতা ও সু-শিক্ষা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, মটিভেশনাল সেশন, সভা সেমিনার এবং সামাজিক মাধ্যমসহ সকল গণমাধ্যমে প্রচার প্রচারণার বাড়ানো গেলে স্বল্প সময়ে এ ধরনের অপরাধ বহুলাংশে কমে আসবে।
তবে দীর্ঘমেয়াদী সুফল পেতে হলে রাষ্ট্রীয় পলিসি আবশ্যক। তরুণদের স্বপ্ন দেখাতে হবে। তাদের সামনে আদর্শ তুলে ধরতে হবে। সর্বোপরি, সমাজ থেকে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণ চিরতরে দূর করতে হবে। অর্থাৎ সমাজকে তার নিজস্ব চেহারার ফিরিয়ে আনতে যা যা দরকার তা রাষ্ট্রকে করতে হবে। নতুবা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ক্ষমা করবে না।
লেখক: জি এম কিবরিয়া।
প্রধান সমন্বয়ক