মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অসাম্প্রদায়িকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে যখন রাজাকার-আল বদর হিসেবে শুধু দাড়ি-টুপি ও পাঞ্জাবি পরা ব্যক্তিদের উপস্থাপন করা হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে আয়োজিত সমাবেশে দাহ করার জন্য রাজাকারের যেসব কুশপুত্তলিকা তৈরি করা হয় সেখানেও দেখা যায় বাস্তব জীবনে ওই ব্যক্তির সাথে দাড়ি-টুপির কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও তার কুশপুত্তলিকায় টুপি পরানো হয়েছে। অথবা এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যাতে ওই কুশপুত্তলিকা যে দাড়ি-টুপি পরা একজন ব্যক্তির তা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে কোনো ব্যঙ্গ চিত্র অথবা ছবি আঁকা হলে সেখানেও দেখা যায় ছবিতে দাড়ি-টুপি পরা ব্যক্তিদেরই যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহিৃত করা হয়েছে। ফলে সাধারণভাবে তরুণ প্রজন্মের কাছে এমন বার্তা যাচ্ছে যে, রাজাকার মানেই দাড়ি-টুপি আর পাঞ্জাবি পরা ব্যক্তি।
কিন্তু বাস্তবে, দাড়ি-টুপি পরা ব্যক্তি মানেই কি রাজাকার? এ প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলার কোনো সুযোগ নেই। কারণ মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের অনেকেই ছিলেন দাড়ি-টুপি আর পাঞ্জাবি পরা সাচ্ছা মুসলমান। বর্তমানে দাড়ি-টুপি ও পাঞ্জাবি বয়সের ভারে নুব্জ্য অধিকাংশ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার জীবনের অন্যতম অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছে। প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বলে, একাত্তরে টুপি দাড়ি রাখা মাওলানারা যেমন রাজাকার হয়েছিলেন, তেমনি প্যান্ট, স্যুট টাই পরা সবুর খান, শাহ আজিজুর রহমান, খাজা খয়ের উদ্দিন, ফজলুল কাদের চৌধুরী প্রমুখ উচ্চ শিক্ষিত বাঙালিরাও ওই দলে যোগ দিয়েছিলেন। কম সংখ্যায় হলেও বহু হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোক শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। বামপন্থিদেরও অনেকেই ছিলেন পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগী।
অন্যদিকে বামপন্থি-ডানপন্থি প্যান্ট শার্ট আর গেঞ্জি পরা তরুণদের পাশাপাশি দাড়ি-টুপি ও পাঞ্জাবি পরা হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। পাকিস্তানি হানাদারদের মোকবেলায় বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিতে তারা একটু কুণ্ঠিত হননি। প্রকৃতপক্ষে, মুক্তিযুদ্ধ যেমন কোনো এক শ্রেণির লড়াই ছিল না, তেমনি যারা পাকিস্তানিদের সহযোগী ছিলেন তারা কোনো এক বিশেষ পোশাক পরিধান করেছিলেন এমনটি সত্য নয়। তাই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে রাজাকারের কুশপুত্তলিকা তৈরি অথবা প্রতিচিত্র আঁকতে দাড়ি-টুপির ব্যবহার বন্ধ করা দরকার। রাজাকারের প্রতিচিত্র অথবা কুশপুত্তলিকায় দাড়ি-টুপির ব্যবহার করা হলে ওই একই পোশাক পরিধানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করা হয়। আর এতে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনাও হয় প্রশ্নবিদ্ধ।
দুই.
পাকিস্তানি হানাদার ও তাঁদের এ দেশীয় দোসররা ইসলাম রক্ষার নামে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালোরাত হতে বাঙালি নিধনযঞ্জে নেমেছিল। আর এদেশের ইসলামের নাম ব্যবহার করে রাজনীতি করা তথা সক্ষমতার স্বাদ উপভোগে উন্মত্ত কথিত জনবিছিন্ন ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা হয়েছিলেন পাকিস্তানি হানাদারদের প্রধান সহযোগী। তবে এর অর্থ এই নয় যে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি ও তাদের এদেশীয় দালালরা কেবল বিধর্মী হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে হত্যা করেছিল। যদিও তারা ইসলাম ধর্ম রক্ষার নামে গণহত্যায় মেতে উঠেছিল। কিন্তু তাদের দ্বারা নিহত হয়েছিলেন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের মানুষ। আর ওই হত্যার উৎসবকে যদি ধর্মগত দিক থেকে ভাগ করা হয়; তবে নির্যাতিত ও হত্যার শিকার নারী-পুরুষের সংখ্যাগরিষ্ঠই ছিলেন ইসলাম ধর্মের অনুসারী মুসলিম সে কথা নিংসঙ্কোচে বলা যায়।
জাহানারা ইমাম এর ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থ মতে, ‘এক মহিলা নামাজ পড়ছিলেন। সেই অবস্থায় তাকে টেনে রেপ করা হয়। আরেক মহিলা কোরান শরিফ পড়ছিলেন, শয়তানরা কোরান শরিফ টান দিয়ে ফেলে তাকে রেপ করে।’ পাকিস্তানি হানাদাররা হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে ধর্ম ও সম্প্রদায়ের বাছবিছার করেনি এই বর্ণনার থেকে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে!
তিন.
পাকিস্তানিরা ইসলাম রক্ষার নামে বাঙালিদের বিরুদ্ধে হত্যার উৎসবে নামলেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কোনো মুসলিম ইসলাম পরিত্যাগ অথবা মহানবী (সা.) সম্পর্কে কোনো কটূক্তি করেনি। বরং মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা নিয়মিত নামাজ, রোজা ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুশাসন নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন। অন্যদিকে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসলামের লেবাজধারী সবাই রাজাকার হয়ে গিয়েছিলেন এই ধারণাও সঠিক নয়। বহু পীর-মাশায়েখ, মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেম, তাবলিগ জামাতের আমির, সাধারণ তাবলিগ, হাফেজে কোরআন, আলেম, ওলামা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। যারা সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারেননি তারাও বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করেছেন।
মামা-ভাগনে মাওলানা আবদুর রহমান ও আবদুর রব যেমন সশস্ত্র সংগ্রামে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পাকিস্তানি হায়নাদের বিরুদ্ধে, তেমনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন মাওলানা খায়রুল ইসলাম যশোরী। ছারছীনার গদিনশীন পীর আল্লামা শাহ আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ পাকিস্তানিদের দোসর হিসেবে কাজ করলেও ওই বংশের আর এক কামেল ব্যক্তি শাহ মুহাম্মদ ছিদ্দিক (র.) ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যকারী।
যশোরের নোয়াপাড়ার পীর খাজা রফিকউজ্জামান যেমন একাত্তরে মুজিব বাহিনীর দুর্ধর্ষ কমান্ডার ছিলেন; তেমনি চট্টগ্রামের পটিয়া মাদ্রাসার কারী মাওলানা জেবুল হাসান হানাদার পাকিস্তানিদের গোলার আঘাতে শাহাদাত বরণ করেন। মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরীর (রহ.) প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম খাদেমুল ইসলাম গওহারডাঙ্গা মাদরাসা রাজাকারের প্রশিক্ষণ নেয়ায় দুই ছাত্রকে বহিষ্কার করে।
সাধারণ মানুষের মতো পাকিস্তানিদের গোলার আঘাতে প্রাণ দিয়েছেন বহু পীর, আওলিয়া, মাওলানা, পরহেজগার বুজুর্গ মানুষ। যশোর রেল স্টেশন মাদরাসা প্রাঙ্গণে ওই মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের গণকবরই একথার বড় প্রমাণ। তাই দাড়ি-টুপি পরা মানুষ মানেই রাজাকার কথাটি সবৈব সত্য নয়।
মো. আবুসালেহ সেকেন্দার, সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর নিজস্ব। www.sunbd24.com এর সম্পাদকীয় অবস্থানের সঙ্গে এসব অভিমতের মিল আছেই এমন হবার কোনো কারণ নেই। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে www.sunbd2424.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না।)