"ইস! আমি যদি অলৌকিক কিছু পেতাম! যেমনঃ আলাদিনের চেরাগ, পরশ পাথর ইত্যাদি!" এটি পৃথিবীর সব দুর্বল মানুষের বাসনা। সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীর সবচেয়ে অলৌকিক বস্তুটিই মানুষকে দান করেছেন, তা হলো মানুষের মস্তিষ্ক। অথচ মানুষ একটি বারের জন্যও ভেবে দেখে না যে, পৃথিবীর এত সমৃদ্ধি বা সভ্যতা কিভাবে হলো?
ভেবে দেখুন, আমি এখন লিখছি, অথচ কোন কাগজ কলম বা কালি ব্যবহার করছি না! আমার বাবা যখন স্কুলে পড়তেন তখন তিনি গাছের পাতায়, বাঁশের কঞ্চি দোয়াতে চুবিয়ে লিখতেন! অথচ পৃথিবীর এত সমৃদ্ধি আপনার হতাশার চোখেই পড়ে না। তাই অলৌকিক শক্তির খুঁজে বাবার আস্তানায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন নতুবা নিজেকে ব্যর্থ ভেবে হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছেন!
এখানে প্রথম সমস্যা হলো, মানুষ যে এত বড় অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী তা জানেন না! আর দ্বিতীয় সমস্যা হলো, এই অলৌকিক বস্তুটি পরিচালনার যে ম্যানুয়াল আছে তা মানুষ পড়েন না! আর ম্যানুয়াল না পড়েই অধিকাংশ মানুষ মস্তিষ্ক নামক দুনিয়ার সবচেয়ে জটিল ও কার্যকরী মেশিনটি পরিচালনা করতে চাচ্ছেন বলেই এটি সঠিক ও যথার্থভাবে কাজ করছে না। ফলে তিনি ব্যর্থ মানুষের কাতারে চলে যাচ্ছেন।
এই ম্যানুয়াল হলো জ্ঞান অর্জন।
অপর দিকে, একদল মানুষ এ মেশিনের সুষ্ঠু ব্যবহার করে নতুন নতুন মেশিন বা প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছেন। সহজে বলতে গেলে, এই মেশিন বা প্রযুক্তির ব্যবহারই মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে এক অনন্য মাত্রার উচ্চাতায় আসীন করেছে। আর এভাবেই ধারাবাহিকাভাবে মানুষ সহস্র বছর ধরে বিস্ময়কর সব সৃষ্টি করে চলেছে এবং সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করছে।
যেমন ধরুন, আগুন আবিষ্কার। এক আগুনই মানুষকে সভ্যতার দিকে লক্ষ বছর এগিয়ে নিয়েছিল। তারপর চাকা আবিষ্কার। আরও লক্ষ বছর এগিয়ে গেল মানুষ।
এভাবেই আরেকটি বড় ধাক্কা "শিল্প বিপ্লব"। ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়। এরপর ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ আবিষ্কার ও তার ব্যবহারে দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব এবং ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেটের আবিষ্কার ও কম্পিউটারের বহুবিধ ব্যবহার তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের সূচনা করে। আর এভাবেই মানুষ এগিয়ে যেতে থাকে সমৃদ্ধ এক বিশ্ব সভ্যতার দিকে।
আমি কোন মানুষকেই ছোট করে দেখছি না। আজ থেকে ৫০০০ বছর আগে যিনি তার ছেলেকে বলেছিলেন যে, অন্য প্রাণী বা শীত-বর্ষার আক্রমণ থেকে বাঁচতে, এই গুহাটিতে আশ্রয় নিও, তাকেও আজকে সহস্র সেলুট জানাই। মানুষের তিল তিল করে গড়ে উঠা সব অর্জনের উপর ভিত্তি করেই আবির্ভাব হয়েছে এক একটি নতুন বিপ্লব। যেমন ধরুন, আজকের ডিজিটাল বিপ্লব। যা নিয়ে এখন সারা দুনিয়ায় তোলপাড় চলছে। আর এর নামই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব।
চার শিল্পবিপ্লবঃ
প্রথম: ১৭৮৪ সাল, বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার;
দ্বিতীয়: ১৮৭০ সাল, বিদ্যুতের আবিষ্কার;
তৃতীয়: ১৯৬৯ সাল, ইন্টারনেটের আবিষ্কার;
এবং চতুর্থ: ২০১৩ সাল, ডিজিটাল বিপ্লব।
ডিজিটাল বিপ্লব কী?
সহজে বলতে গেলে স্মার্টফোনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পরিবর্তন, ইন্টারনেট অব থিংস, যন্ত্রপাতি পরিচালনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ, রোবোটিকস, জৈবপ্রযুক্তি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো বিষয়গুলোর প্রভাবে মানব সভ্যতার বিকাশ ও যে পরিবর্তন লক্ষণীয় হচ্ছে, তাই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব।
অর্থাৎ ৪র্থ শিল্প বিপ্লবটির ভিত হচ্ছে ‘‘জ্ঞান ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’’ ভিত্তিক কম্পিউটিং প্রযুক্তি, রোবটিক্স, আইওটি, ন্যানো প্রযুক্তি, ডেটা সাইন্স বা বিগ ডেটা ইত্যাদি।
কি কি পরিবর্তন লক্ষ্যণীয় হচ্ছে?
বিশ্ব ব্যাংকের জরিপ মতে, ইন্টারনেটে এখন এক দিনে বিশ্বে ২০ হাজার ৭০০ কোটি ই-মেইল পাঠানো হয়, গুগলে ৪২০ কোটি বিভিন্ন বিষয় খোঁজা হয়। এক যুগ আগেও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে এ পরিবর্তনগুলো ছিল অকল্পনীয়।
মানুষের জীবনমান উন্নয়নে প্রভাবঃ
একদল বিশেষজ্ঞ বলছেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে সব মানুষেরই আয় ও জীবনমান বাড়বে। বিশ্বের পণ্য সরবরাহ প্রক্রিয়াতেও ডিজিটাল প্রযুক্তি আনবে ব্যাপক পরিবর্তন।
১। ড্রোনের ব্যবহারঃ ড্রোন ব্যবস্থার মাধ্যমে আপনি প্রত্যন্ত এক গ্রামে বসেই কম খরচে পেয়ে যাবেন সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত কোন ঘড়ি কিংবা কুমিল্লার রসমালাই।
২। Internet of Thinks (IoT): ইতোমধ্যে গুগল হোম, অ্যামাজনের আলেক্সার কথা আমরা জেনেছি; যার মাধ্যমে আপনি অফিসে বসেই ঘরের বাতি, সাউন্ড সিস্টেম ও গেট ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। ধরুন, বৃষ্টির দিনে আপনি খিচুড়ি খেতে পছন্দ করেন। এটি আপনার স্মার্ট চুলা মনে রাখবে। যখনই বাইরে বৃষ্টি হবে তখনই সে খিচুড়ি রান্নার অনুমতি চাইবে, আপনি বাসার দরজা খুলেই খিচুড়ির সু-ঘ্রাণ পেয়ে যাবেন, আর আপনাকে দেখে রোবট সঙ্গে সঙ্গেই টেবিলে সেই খিচুড়ি পরিবেশন করবে। কি জিভে জল এসে গেল?
৩। ক্লাউড কম্পিউটিং: এটি নতুন কিছু নয়। শুধু ইন্টারনেট কানেকশন থাকলেই ক্লাউড সার্ভারে আপনার তথ্য, ছবি, ভিডিওসহ হাসি কান্নার সকল ইতিহাস জমা হতে থাকবে আজীবন। পরবর্তী জেনারেশন সহজেই বিশ্লেষণ করে নিতে পারবে তার পূর্ব পুরুষদের সামগ্রিক চিন্তা ও চেতনাকে।
৪। Artificial Intelligence (AI) : কম্পিউটার বিজ্ঞানের উৎকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত হল কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স যে চারটি কাজ করে তা হল ১। কন্ঠ শুনে চিনতে পারা, ২। নতুন জিনিস শেখা, ৩। পরিকল্পনা করা এবং ৪। সমস্যার সমাধান করা।
যেমনঃ আপনার মোবাইল ফোনটি আপনার ফেস না দেখলে ওপেন হয় না, এটাই আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স। এটি গ্রাহকের অভ্যাস ও প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী কাস্টমাইজ সেবা প্রদান করে থাকে।
৫। চালকবিহীন গাড়িঃ আপনি বৃহস্পতিবারে সারাদিন কাজ করে রাতে আপনার ব্যক্তিগত গাড়িতে উঠলেন, নির্দিষ্ট বাটন চেপে ঘুমিয়ে গেলেন। ভোর বেলায় "খোকা এলি" ডাকে আপনার ঘুম ভাঙতেই চোখ মেলে দেখবেন আপনি নিরাপদে কুড়িগ্রামের নিজ গ্রামে পৌছে গেছেন।
এই তো গেল সব সুবিধার কথা। এবার আসুন জেনে নেই চ্যালেঞ্জ গুলো কি কি?
চ্যালেঞ্জঃ
১। রোবটের ব্যবহারঃ ডিজিটাল বিপ্লবের ফলে রোবট ও যন্ত্রপাতির ব্যবহার বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। ফলে মানুষের কর্মসংস্থানে ভাটা পরবে। কর্মহীন মানুষের জীবন যাপন হয়ে যেতে পারে মানবেতর। তাছাড়াও পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠী আরও পিছিয়ে যেতে পারে।
২। ড্রোনের ব্যবহার ও সাইবার অপরাধঃ এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ঝুঁকি বাড়াবে। যেমনঃ বাংলাদেশ ব্যাংকের এতগুলো টাকা নিমিশেই হাওয়া হয়ে গেল। আর নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করতে পারে।