গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইনডেক্স-২০২০ অনুযায়ী সামরিক শক্তিতে বিশ্বের ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৪৬তম, ভারত ৪র্থ এবং মিয়ানমার ৩৫তম। তবুও মিয়ানমারের চোখে ঘুম নেই! আমরা দেখেছি, এ বছর হঠাৎই মিয়ানমার ২/৩টি যুদ্ধ জাহাজ সেন্ট মার্টিন এলাকায় মোতায়েন করে। বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর কয়েকটি যুদ্ধ জাহাজ অগ্রসর হতেই পালিয়ে গেল তারা।
আমি আসলে বাংলাদেশের সামরিক শক্তির ফিরিস্তি দিতে এই প্রবন্ধ লিখছি না, লিখছি এক ভাষা, এক সংস্কৃতি ও এক জাতি যে একটি বৃহৎ শক্তি সে বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে। আলোচনার সুবিধার্থে আরেকটু সামরিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন মনে করছি।
যেমনঃ বিভিন্ন সামরিক বিশ্লেষণে শুনেছি "ইস্ট বেঙ্গল রেজিম্যান্ট" এর নাম শুনলেই নাকি বিশ্বের অনেক সমরবিদের রক্ত হিম শীতল হয়ে যায়!
কেন? আতঙ্কে।
কিসের আতঙ্ক?
এই প্রশ্নের উত্তর নিম্নবর্ণিত গল্পে আপনারা পেয়ে যাবেন আশা করছিঃ ইস্ট বেঙ্গল রেজিম্যান্ট গঠন হয় ১৯৪৮ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি। শুরু থেকেই এই বাহিনী নিয়ে পাকিস্তানীদের ঠাট্টা, বিদ্রুপ ও মশকরার যেন শেষ নেই। বাঙালি ভীতু, বেটে, শক্তিহীন ও শ্যামলা ইত্যাদি। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুতে আইয়ুব খান কাশ্মীর অভিযান পরিচালনা করলে ভারত সেপ্টেম্বর ৫ তারিখে করাচি অভিমুখে অভিযান শুরু করে। তখন ভারতের সেনা প্রধান মিঃ জয়ন্ত নাথ চৌধুরী ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি ৬ সেপ্টেম্বর সকালে লাহোরে চা খাবেন।
নির্ঘাত মৃত্যু ভেবে চালাক আইয়ুব খান ইস্ট বেঙ্গল রেজিম্যান্টকে ফ্রন্ট লাইনে পাঠিয়ে দেন। কিন্ত আশ্চর্যের বিষয় ছিল যে, যুদ্ধ শুরুর এক ঘন্টার মধ্যেই ভারত ১৯টি ট্যাংক হারিয়ে হতভম্ব হয়ে পড়ে কিছুটা পিছু হটে। পরে রনকৌশল পরিবর্তন করে তারা প্রচন্ড শক্তি নিয়ে পুনঃ আক্রমণ করে। কিন্ত সেদিন বাঙালী তাদের রনকৌশল পরিবর্তন করেননি।
কি ছিল সেই কৌশল? বুকে ট্যাংক বিধ্বংসী গ্রেনেড বেঁধে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও ট্যাংকের নিচে শুয়ে পড়া। সেদিনের বাঙালির দেশপ্রেম ও বীরত্বের কাছে পরাজিত হয়ে ভারতের প্রধান সেনাপতির আর লাহোরে চা খাওয়া হলো না। বিপরীতে তিনি ৩০০ ট্যাংক ও হাজার হাজার সৈন্য হারিয়ে রনে ভঙ্গ দেন। এরপরও ইস্ট বেঙ্গল রেজিম্যান্ট বাংলাদেশ জন্মের পূর্বেই আরও দুটি যুদ্ধে/অভিযানের জয় লাভ করে।
এভাবেই বাঙালীর বীরত্ব গাঁথা দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আর সেই বীরত্ব চাক্ষুষ করে পাঞ্জাবি, বেলুচ, সিন্দী সৈন্যদের মনে ঢুকে পড়ে ভয়। যদিও তারা বাহিরে বাহিরে বীর ইস্ট বেঙ্গলকে হিংসা ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য অব্যাহত রাখে। পরিনতিতে, সেই ভয়ই ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনীর মনোবলকে চুর্ণ বিচুর্ণ করে দেয়। আর বাঙালি বীরত্বের জয়মালা পরিধান করে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন করে। আবারও বাঙালিদের বীরত্ব গাঁথা ছড়িয়ে পড়ে দেশে দেশে।
বর্তমান সময়েও জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনগুলোতে যেখানে আতঙ্ক, দুর্গম ও ঝুঁকিপূর্ণতা; সেখানেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এই বীরত্বের সাথে যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি। ফলে মিয়ানমারসহ অন্য প্রতিবেশীদের এত দুশ্চিন্তা, এত ভয়, এত মাথা ব্যথা।
১। কেন বাংলাদেশ নিয়ে মিয়ানমারের এত আতঙ্কিত, যেখানে সামরিক সক্ষমতায় মিয়ানমার ৩৫তম আর বাংলাদেশ ৪৬তম?
২। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিয়ে অন্য প্রতিবেশীরা কেন দুশ্চিন্তা গ্রন্থ?
৩। কেন বাংলাদেশের অর্থনীতি কিংবা সামরিক সম্ভাবনার কথা দেশে বিদেশে বিপুলভাবে আলোচিত হচ্ছে?
এর সহজ উত্তর, এক ভাষা; এক জাতি; এক দেশ। তার সাথে যুক্ত হয়েছে কৌশলগত অবস্থান। তার বিপুল সংখ্যক নদ-নদী আর অপার সম্ভাবনার বঙ্গপোসাগর।
সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর গুরুত্ব অপরিসীম।যদি জাতিগত, ভাষাগত, সংস্কৃতিগত ভিন্নতা থাকে, তবে একটি দেশের নাগরিক হলেও জাতিগত বিদ্বেষ বা স্বার্থের কারনে একটি জাতি অপর জাতিকে বিপদের মুখে ফেলে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে। তাছাড়া ভাষার ভিন্নতা থাকলে যুদ্ধের প্রয়োজনে রনকৌশল তাৎক্ষণিক পরিবর্তন করা যায় না। অপরদিকে, সাংস্কৃতিক ভিন্নতায় মানুষের আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়না।
বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর জন্য এক জাতি, একদেশ, একভাষা ও একই সংস্কৃতি একটি বড় ধরনের আশীর্বাদ। সেজন্য ভিনদেশী সমরবিদদের এ দেশীয় বাহিনী নিয়ে এত ভয়।
তাছাড়া "বঙ্গপোসাগরের গভীরতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ যেমন একাধিক গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপন করে এ অঞ্চলের বড় অর্থনৈতিক হাব হতে পারে ঠিক তেমনি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও আধুনিক নৌবাহিনী গঠন করতে পারে।" কথা গুলো আমার নয়, এগুলো ওয়াশিংটন পোস্টের বিশ্লেষণ।
গত সপ্তাহে ওয়াশিংটন পোস্টে খবর বেরিয়েছে যে, "বাংলাদেশ হচ্ছে পরবর্তী চীন। দিল্লিকে প্রথমেই ঢাকার মোকাবেলা করতে হবে। খবরে আরো প্রকাশ, ৯০ এর দশকে অর্থনীতি খুলে দেবার পর, ভারতের প্রধান লক্ষ্য ছিলো চীনকে পরাজিত করা। ৩ দশকের চেষ্টায় ভারত তো সফল হয়ইনি, বরং বাংলাদেশ দ্রুততার সঙ্গে তাদের পেছনে ফেলে দিচ্ছে। ভারতের আর বৈশ্বিক ভাবমূর্তি বলতে তেমন কিছুই থাকছে না। বিশ্বের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু এখন বাংলাদেশ।" -দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট।
পত্রিকাটি যেভাবে বিশ্লেষণ করেছে তা হলো, "বাংলাদেশ করোনা কালে যেভাবে নিজের অর্থনীতিকে সামাল দিয়েছে, তাতে অভিভূত পশ্চিমা অর্থনীতিবীদরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশকে আটকে রাখা কারও পক্ষেই আর সম্ভব নয়। বাংলাদেশ পূর্ববর্তী এশিয়ান টাইগারদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই ভালো করছে। বাংলাদেশ কম দক্ষতার রপ্তানিযোগ্য পণ্যকে ব্যবহার করে নিজেদের ভিত্তি মজবুত করেছে। এভাবে এগিয়েছে ভিয়েতনামও। কিন্তু তারাও বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে পড়ছে। চীনও একই পদ্ধতিতে এগিয়েছিলো। তাই অর্থনীতিবীদরা বলছেন, ভারত নয়, বাংলাদেশই পরবর্তী চীনের অবস্থানে যাচ্ছে।"
আমি মনে করি, এদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পিছনেও নিয়ামক হিসাবে আছে সেই এক ভাষা; এক জাতি; এক দেশ।
পাকিস্তান যখন তাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলো করত, তখন আঞ্চলিক জাতিগত প্রধান্যের ভিত্তিতে তারা সেই পরিকল্পনাগুলো করতেন। তখন বেশি প্রধান্য পেত পাঞ্জাব, আর সবচেয়ে অবহেলিত থাকত বাংলা। এদেশ সম্পূর্ণ এক জাতিসত্তাভুক্ত, তাই জাতিগত বা আঞ্চলিক বৈষম্যের প্রশ্নই উঠে না।
অপরদিকে, দেশের প্রতিটি প্রান্তের মানুষজন নিবেদিত থাকে একে অপরের প্রতি, যেন এক আত্মিক সুতায় বাঁধা। এই বিষয়ে বাঙালিদের নিয়ে বিদেশের একটি গল্প প্রচলিত আছে। যেমন বিদেশে একজনের করোনা আক্রান্ত হলে অপর বাঙালির আর রেহাই নেই। কারন বাঙালিরা দলগতভাবে বিদেশে থাকে ও চলাফেরা করে। অন্য জাতির সাথে তেমন মিশে না।
যেমনঃ বাংলাদেশ থেকে যারা বিদেশে যায়, তারা অধিকাংশই কম শিক্ষিত। বিদেশী ভাষা, সংস্কৃতি বা রাস্তা-ঘাট চেনা তাদের জন্য অত্যন্ত দূরহ। বাংলাদেশীরা একই জাতি সত্ত্বার বলে পুরাতন কোন বাংলাদেশীর কাছ থেকে সহজে ও দ্রুত সবকিছু শিখে বিদেশী সংস্কৃতির সাথে খাপ খাইয়ে ফেলে। শুধু তাই নয়, একজন আরেকজনকে বিদেশে নিতে সচেষ্ট থাকে। আর এভাবেই রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েই চলেছে।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মতে, খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগেও বাংলা ভাষার অস্তিত্ব ছিল। এত মধুর ও সমৃদ্ধ ভাষা পৃথিবীতে বিরল। শুধু তাই নয়, বাংলা ভাষা একটি শক্তি, সম্পদ, সম্মান, ঐতিহ্যের নাম। এই ভাষা বাঙালি জাতিসত্তার পরিচায়ক। বাংলা ভাষা মানে বাঙালির অস্তিত্ব, বাঙালির জাতিসত্তা। বাঙালিদের মধ্যে এই ভাষার মাধ্যমেই জাতিসত্তার উপলব্ধি বা উন্মেষ ঘটেছিল। দিনটি ছিল ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। ঐ দিনের পর ১৯৭১ সালে পাকিস্তান টের পেয়েছিল বাঙালির ভাষা ও জাতিসত্তা কি জিনিস।
মোটকথা, এক ভাষা; এক জাতি; এক দেশ। এর অর্থ একটি বৃহৎ শক্তি। এই বৃহৎ শক্তিকে সংগঠিত হয়ে কাজে লাগাতে হবে।
যেমনঃ ১। জাতীয় সম্পদ ও মূল্যবোধগুলোকে চিহ্নিত করে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে জনসাধারণের অন্তরে সেগুলো অনুধাবনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে;
২। এই সম্পদগুলোকে সবার উপরে গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি করতে হবে। যে কোন জাতীয় ইস্যুতে দলমত সবাইকেই নিয়ে ঐক্যমতের ভিত্ততে কাজ করার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে;
৩। দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীকে জাতীয় সম্পদ আখ্যায়িত করে সর্ব বিতর্কের উর্ধ্বে রাখার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে;
৪। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গ্রাম শহরের বৈষম্য না করে সমতা ভিত্তিক উন্নয়নকে প্রাধান্য দিতে হবে। সেই সাথে ধনী-দরিদ্রের তারতম্য বা বৈষম্য বহুলাংশে কমিয়ে আনতে হবে; ইত্যাদি।
বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ এক দেশ, এক জাতি, এক ভাষা ও এক সংস্কৃতি। এই শক্তিকে নস্যাৎ করে দেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে বিদেশী শক্তি যেমন সক্রিয়, তেমনি যুগে যুগে মীর জাফর, রাজাকার ও মোস্তাকরা সক্রিয় রয়েছে। তাই এই অমূল্য শক্তি ও জাতিসত্তাকে হৃদয়ে ধারণ করে বঙ্গপোসাগর কেন্দ্রীক জিও পলিটিক্স ও অর্থনৈতিক কৌশলে সাহসিকতা ও বিচক্ষণতার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে দেশকে, দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে হবে। বাংলাদেশের কোন ভয় নেই, আমরা জেগে আছি।