নিউইয়র্কে মহামারি করোনার ধাক্কা সবচেয়ে বেগবান। মহামারির প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পরই লকডাউন শুরু হয়েছিল। মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছিল। সাড়ি সাড়ি লাশ বহনের ক্ষমতা হারিয়েছিল অ্যাম্বুলেন্স ও অন্য যানবাহন। লাশের দাফন-কাফনসহ আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়ায় লোক-সংকট দেখা দেওয়ায় গণকবরের ঘটনাও ঘটেছে এই সিটিতে।
এক ধরনের ভুতুড়ে সিটিতে পরিণত হলেও বাংলাদেশ কন্স্যুলেট জেনারেল একেবারে নীরব হয়নি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভার্চুয়াল অথবা অনলাইন কিংবা টেলিফোনে তারা দুর্দশায় পতিত প্রবাসীদের পাশে ছিলেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সংগতি রেখে ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসক কন্সাল জেনারেল সাদিয়া ফয়জুননেসা মানবসেবার ক্ষেত্রে এক অনন্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। মৃতদের কাছে যাওয়া বা তার স্বজনের কাছে গিয়ে সমবেদনা প্রকাশের সুযোগ না থাকলেও ফোনে সেটি করেছেন তিনি। একইসাথে স্বজনহীনদের লাশ দাফনে প্রয়োজনীয় কার্যাদি সম্পন্নে বাংলাদেশ সোসাইটির সাথে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন সাদিয়া।
শুধু তাই নয়, আক্রান্তদের তথ্য জানার পরই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা-পরামর্শ প্রদানের জন্যে স্বদেশি কয়েকজন মহৎপ্রাণের চিকিৎসক-সমন্বয়ে একটি টিমও গঠন করেন কন্সাল জেনারেল। সকলেই ঘরে স্বেচ্ছায় বন্দি থাকলেও সেই সীমিত পরিসরেই অতি জরুরি কন্সাল সার্ভিসেও সহকর্মীদের সরব রেখেছিলেন তিনি।
কন্স্যুলেট ভবনে সেবাপ্রার্থীদের খোঁজখবর নিচ্ছেন কন্সাল জেনারেল সাদিয়া ফয়জুননেসা
উল্লেখ্য, নিউইয়র্কে মহামারির শিকার আড়াই শতাধিক প্রবাসীর মধ্যে বাংলাদেশ সোসাইটির সভাপতি কামাল আহমেদ, সহ-সভাপতি আবুল খায়ের এবং নির্বাহী সদস্য বাকির আজাদও রয়েছেন। এখনও কমিউনিটির সেবামূলক কাজে পরিচিত বেশ কয়েকজন চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাজারও প্রবাসী আক্রান্ত হয়ে নিজ বাসায় চিকিৎসা গ্রহণ করছেন। লকডাউন কিছুটা শিথিল হলেও সংক্রমণের হার বেড়েছে কয়েকগুণ।
এসব দিক বিশেষ দৃষ্টিতে রেখেই কন্স্যুলেট অফিস অনলাইন ও পোস্টাল সার্ভিসের পাশাপাশি পূর্ব-অনুমতি গ্রহণকারীরা কন্স্যুলেটে উপস্থিত হয়েও সেবা নিচ্ছেন। নানাবিধ কারণে প্রচলিত জীবন-ব্যবস্থা যেমন থমকে দাঁড়িয়েছে, ঠিক তেমনি অনেক অফিসও স্থবিরতায় আক্রান্ত হয়েছে। শুধু জেগে আছে নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কন্স্যুলেট।
বলা যেতে পারে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই তারা সরব রয়েছেন। কেউ মারা গেলে তা ই-মেইলে জানালেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের তথ্য দ্রুততম সময়ে ই-মেইলেই জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া, পোস্টাল-সার্ভিসে পাওয়া আবেদনের তথ্যও স্বল্প সময়ে সার্ভিস প্রার্থীকে জানানো হচ্ছে। পাসপোর্ট ইস্যু, নবায়ন, এনভিআর ইত্যাদি কার্যক্রমের গতি-প্রকৃতিও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে জানানো হয় যাতে কেউ দুশ্চিন্তায় না থাকেন।
‘মুজিব বর্ষের কূটনীতি-প্রগতি ও সম্প্রীতি’ স্লোগানে উজ্জীবিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সার্বিক নির্দেশনায় নিউইয়র্ক অঞ্চলের প্রবাসীরা এই চরম সংকটেও কন্স্যুলার সার্ভিস থেকে বঞ্চিত হননি। কন্স্যুলেটে মার্চ থেকে অক্টোবরের কার্যাবলি উপস্থাপন করলেই এ চিত্র ভেসে উঠবে প্রতিটি প্রবাসীর। আর এভাবেই ডিজিটাল বাংলাদেশ রচনার অভিপ্রায়ে ধীরলয়ে হাঁটছে নিউইয়র্ক অঞ্চলের এই অফিসটি-তা অনুমিত হবে বিবেকবান প্রতিটি প্রবাসীর কাছেই।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, লকডাউন পরবর্তী সময়ে (জুন-অক্টোবর) নিউইয়র্ক স্টেট প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী, ৮ জুন হতে সীমিত আকারে নিউইয়র্ক সিটি খুলে দেওয়া হয়। সে নির্দেশনা অনুযায়ী সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে ই-মেইলের মাধ্যমে গৃহীত অ্যাপয়েন্টমেন্টের ভিত্তিতে সেবা গ্রহণকারীকে কনস্যুলেটের ভিতরে সশরীরে উপস্থিত হয়ে সেবা প্রদান পুনরায় শুরু করা হয়।
‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ নীতি অনুসরণ করে কনস্যুলেটের প্রবেশ দ্বারে সেবাগ্রহণকারীদের তাপমাত্রা স্বাভাবিক নিশ্চিত হওয়ার পর ‘কোভিড-১৯’ বিষয়ক ফরম পূরণের মাধ্যমে প্রবেশ করানো হচ্ছে। উল্লেখ্য, নিউইয়র্ক সিটি প্রশাসনের আরোপিত জনসমাবেশজনিত নির্দেশনাগুলো মেনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট গ্রহণের মাধ্যমে সীমিতসংখ্যক সেবাপ্রার্থী কনস্যুলেটে প্রবেশ করছেন।
কনস্যুলেটের হলরুমে কনস্যুলার সেবা প্রার্থীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে (সকলের জন্য হ্যান্ড সেনিটাইজের ব্যবস্থা, ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে চেয়ার স্থাপন এবং কাউন্টারে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধমূলক ট্রান্সপ্যারেন্ট গ্লাস সংযোজন) ইত্যাদি। করোনা প্রাদুর্ভাবের পরিপ্রেক্ষিতে কনস্যুলেটের ওয়েবসাইটে সংযোজিত অভিনব অ্যাপয়েন্টমেন্ট গ্রহণের ব্যবস্থা, প্রয়োজনবোধে ডাকযোগে কনস্যুলার সেবাগ্রহণ নিরাপদ, কার্যকর ও ফলপ্রসু বলে সেবাপ্রার্থীরা মতপ্রকাশ করছেন।
১৩ জুলাইয়ে অনলাইন ডাক-সেবা (মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট রি-ইস্যু, নো-ভিসা রিকোয়ার্ড, ভিসা, জন্মসনদ, দ্বৈত নাগরিক সার্টিফিকেট, সত্যায়ন, সার্টিফিকেট) চালু করা হয়েছে। ৩ আগস্ট অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্টের মাধ্যমে সশরীরে সেবা (হাতেলিখা পাসপোর্ট হতে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট গ্রহণ, সকল প্রকার পাওয়ার অব এ্যাটর্নি সম্পাদন এবং জীবিত সনদ) গ্রহণের জন্য কন্স্যুলেটের বিদ্যমান ওয়েবসাইটে অ্যাপয়েন্টমেন্ট সিস্টেম চালু করা হয়। সেবা দুটি প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে এবং তারা এ ডিজিটাল পদ্ধতিকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন।
ডিজিটাল ডাকসেবা চালু করার পর থেকে জুলাই-অক্টোবর সময়ে ৫৪৬১টি ডাকসেবা প্রদান করা হয়। মার্চ-অক্টোবরে একাধিক হটলাইনে ৬০০০ জনের অধিক এবং দাফতরিক নিয়মিত ফোনে প্রায় ২৯০০০ জনকে কনস্যুলার সেবা প্রদান করা হয়েছে। ‘জুন-অক্টোবর’ সময়ে প্রায় ৪৫০০ জনকে অ্যাপয়েন্টমেন্টের মাধ্যমে কনস্যুলেটে সশরীরে সেবা প্রদান করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ‘মার্চ-অক্টোবর’ সময়ে কনস্যুলেট জেনারেল হতে ৫০০০ এর অধিক পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়, যা গত বছরের একই সময়ে ইস্যুকৃত পাসপোর্ট সংখ্যার প্রায় সমান।
নিউইয়র্কে করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত ও মৃতের হার অন্য স্টেটের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ায় ফেডারেল সরকারের নির্দেশে ২২ মার্চ হতে নিউইয়র্কেও লকডাউন ঘোষণা করা হয়। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে জনস্বাস্থ্যের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করে একাধিক হটলাইন (২৪/৭), ই-মেইল, ওয়েবসাইট, ফেসবুক, ডাকযোগে এবং করোনাজনিত সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অ্যাপয়েন্টমেন্টের ভিত্তিতে সশরীরে কনস্যুলেটে আগমনসহ কনস্যুলার ও অন্যান্য মানবিক সেবা কার্যক্রম কনস্যুলেট অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষত লকডাউনকালীন (মার্চ-মে) সময়ে আতঙ্কিত নিউইয়র্ক সিটিতে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশি-আমেরিকানদের জন্য বিভিন্ন সেবা কার্যক্রমে নিরবচ্ছিন্নভাবে নিয়োজিত ছিলেন।
জরুরি যেকোনো প্রয়োজনে হটলাইন নম্বরে ফোন, ই-ইমেল অথবা ডাকের মাধ্যমে সেবাগ্রহণ করার জন্য কনস্যুলেটের ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজের মাধ্যমে বাংলাদেশি-আমেরিকানদের বারবার অনুরোধ করা হয়েছে। ই-মেইল ও ফোনের মাধ্যমে কনস্যুলার সেবাপ্রার্থীদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হয়েছে। এমনকি খাদ্য-সংকটে পড়া প্রবাসীদের স্থানীয় প্রশাসনের রান্না করা খাবার বিতরণের সময় ও স্থান সম্পর্কেও ধারণা দেওয়া হয়েছে।
কনস্যুলেটের উদ্যোগে স্থানীয় বাংলাদেশি-আমেরিকান ডাক্তারদের সহযোগিতায় মার্চ- মে’ সময়কালে যখন নিউইয়কর্ সিটি করোনা প্যানডেমিকের এপিসেন্টার ছিল তখন অধিকাংশ ডাক্তারের চেম্বার বন্ধ থাকার কারণে কম্যুনিটির চিকিৎসা পরামর্শ নিতে ব্যাপক অসুবিধা হচ্ছিল। সেই জরুরি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কনসাল জেনারেলের ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি স্বেচ্ছাসেবক “চিকিৎসকপুল” গঠন করা হয় এবং আগ্রহী ব্যক্তিদের চিকিৎসক পুলের সাথে কনস্যুলেটের ইমেইল/হট-লাইন নম্বরের মাধ্যমে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হয়। এর দ্বারা স্থানীয় বাংলাদেশি-আমেরিকানরা ব্যাপকভাবে উপকৃত হন।
উল্লেখ্য, কোভিড-১৯ সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগে যারা যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন ভিসায় এসে আটকা পড়েন, কনস্যুলেট তাদের ভিসা নবায়নের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে, স্থানীয় সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ভিসা নবায়নের নির্দেশিকাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করেছে।
বাংলাদেশি-আমেরিকানদের সুবিধার্থে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণের পাশাপাশি প্রিন্ট মিডিয়ায় নিয়মিত হালনাগাদ তথ্য পাঠানোসহ কনসাল জেনারেল নিয়মিতভাবে স্থানীয় টিভি চ্যানেলেও সরাসরি হালনাগাদ প্রয়োজনীয় তথ্য বাংলাদেশি-আমেরিকানদের সামনে উপস্থাপন করেন।
যুক্তরাষ্ট্রে আটকে পড়া বাংলাদেশি নাগরিকদের বিশেষ বিমানযোগে স্বদেশে ফিরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস, নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটদ্বয়ের সাথে সমন্বয়পূর্বক কাতার এয়ারওয়েজের দুটি চার্টার্ড ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়। যার একটি ওয়াশিংটন ডিসি থেকে ১৫ মে এবং অপরটি নিউইয়র্ক থেকে ৬ জুন যাত্রা করে। এতে আটকেপড়া বাংলাদেশি ৩৫৯ নাগরিক দেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পান।
কনসাল জেনারেল সাদিয়া ফয়জুননেসা এই কনস্যুলেট জেনারেলের আওতাধীন অঙ্গরাজ্যগুলোতে (নিউইয়র্ক, নিউজার্সী, নিউ হ্যাম্পশায়ার, কানেকটিকাট, রোড আইল্যান্ড, ম্যাসাচুসেটস এবং ভারমন্ট) বসবাসরত বাংলাদেশি-আমেরিকান কমিউনিটির সকলকে শীতে করোনার দ্বিতীয় সংক্রমণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে স্বাস্থ্যবিষয়ক বিধি সঠিকভাবে প্রতিপালনের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন।
সানবিডি/নাজমুল/০১:৫১/২৮.১১.২০২০