একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিতর্কিত বক্তব্যের রেশ কাটতে না কাটতেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কটাক্ষ করে বক্তব্য দিলেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। এর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তানরা।
তারা বলছেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বক্তব্য চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও সংবিধান অস্বীকার করেছেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চলমান ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে খুব পরিকল্পিতভাবেই তিনি এ বক্তব্য রেখেছেন। একে কোনোভাবেই মূর্খামি বলা যাবে না।
অনতিবিলম্বে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের সমস্ত রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়া উচিত। একইসঙ্গে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করে এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার করা উচিত বলেও মন্তব্য করেছেন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানরা।
শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় শহীদ বুদ্ধিজীবী প্রসঙ্গে বলেন, ‘২৫ মার্চ যেসব সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে তারা পাকিস্তানিদের হামলার বিষয়ে অজ্ঞাত ছিল। কিন্তু ১৪ ডিসেম্বর যেসব বুদ্ধিজীবী নিহত হয়েছে, তারা পাকিস্তানিদের হামলা ও বরবরতা সম্পর্কে জানতো। এমনকি শেষদিন পর্যন্ত তারা পাকিস্তান সরকারের অধীনে চাকরি করেছেন, অফিসে গিয়েছেন এবং নিয়মিত বেতন নিয়েছেন। তাহলে তারা শহীদ হন কীভাবে?’
তিনি বলেন, বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধা জানাতে ফুল দেয়া নির্বোধের কাজ। তারা নির্বোধের মতো মারা গেলো, আর আমাদের মতো নির্বোধেরা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে ফুল দেয়।’
শনিবার গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের এ ধরনের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয়, শহীদ বুদ্ধিজীবী শিল্পী আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ, শহীদুল্লা কায়সারের মেয়ে অভিনেত্রী শমী কায়সার, চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের ছেলে নির্মাতা অনল রায়হান এবং শহীদ ডা. আবদুল আলিম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরীর শম্পার কাছে।
আলতাফ মাহমুদ কন্যা শাওন মাহমুদ বলেন, ‘গয়েশ্বর সাহেবের কথাটা শোনার পর থেকে আমি ঘুমাতে পারছি না। আমি সশরীরে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে চাই। জিজ্ঞেস করতে চাই এ ধৃষ্ঠতা তিনি কোথা থেকে পাচ্ছেন। কিন্তু আমি তার ঠিকানা জানি না। দয়া করে তার ঠিকানা দিয়ে আমাকে সহযোগিতা করবেন।’
গয়েশ্বরের বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হওয়া উচিত এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার বলেও মন্তব্য করেন শাওন মাহমুদ।
তিনি বলেন, ‘এদের বিরুদ্ধে আর বক্তৃতা বিবৃতি, মানববন্ধন করে লাভ নেই। এবার লড়াইটা করতে হবে সামনা-সামনি। নতুন প্রজন্মকে এ লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে।’
একই প্রসঙ্গে শহীদুল্লাহ কায়সারের সন্তান অভিনেত্রী শমী কায়সার বলেন, ‘এসব নিয়ে কথা বলতে স্বস্তিবোধ করি না। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টি মীমাংসিত এবং কিছু মানুষ পরীক্ষিত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাদের অবস্থান কী?
শমী বলেন, ‘এসব বক্তব্য মূলত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুনভাবে নতুন প্রজন্মের কাছে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য দেয়া হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে নতুন প্রজন্মকে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানলে বিভ্রান্তি এমনিতেই কেটে যাবে।’
শহীদ জহির রায়হানের ছেলে, নির্মাতা অনল রায়হান বলেন, ‘বিএনপি এদেশে একটি জনপ্রিয় দল। এদের বিশাল ভোট ব্যাংক আছে। দলটির লোকজনের এসব বক্তব্য দেশ ও দেশের মানুষের জন্য অপমানকর। কয়েকদিন আগে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে সংশয় প্রকাশের কি আছে। মুক্তিযুদ্ধের পর একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়, তার একটি ঘোষণাপত্র আছে, সেটি সব মহলে গৃহিত এবং স্বীকৃত। এত বছর পর তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অর্থ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রাষ্ট্রের সেই ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধ, এ রাষ্ট্রের সংবিধান, সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করা। এটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা মানে বুঝতে হবে তাদের অন্য উদ্দেশ্য আছে। এমনকি এসব বক্তব্যকে মুর্খামী বলে উড়িয়ে দিলে হবে না, তারা এসব বক্তব্য দিচ্ছেন অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে। এসব বক্তব্য বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ’
অনল বলেন, ‘গয়েশ্বরতো তার নেত্রীর চাইতে এক ধাপ এগিয়ে ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কটাক্ষ করেছেন, নির্বোধ বলেছেন। এটা ছোটখাটো ধৃষ্টতা নয়, এটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল। রাষ্ট্রের উচিত তার বিরুদ্ধে অনতিবিলম্বে মামলা করা এবং দৃষ্টান্তপূর্ণ শাস্তির বিধান করা।
এ ধরনের ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্যের জন্য অনতিবিলম্বের গয়েশ্বর রায়ের সমস্ত রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়া উচিত মন্তব্য করে অনল রায়হান বলেন, ‘শুধু তা করলে হবে না। গয়েশ্বরকে প্রকাশ্যে প্রত্যেক শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।’
শহীদ ডা.আলিম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী শম্পা বিএনপি নেতাকর্মীদের কথাবার্তাকে কুতর্ক ও বাঙালি জাতীয়তাবোধ নৎসাতের এক নিবিড় ষড়যন্ত্র বলে মন্তব্য করেছেন।
তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের দোসর বিএনপি-জামায়াত কোনো দিনই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে মেনে নিতে পারেনি। পাকিস্তান গত কয়েক দিন আগে বাংলাদশের গণহত্যাকে অস্বীকার করেছে। খালেদা শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি আছে বলে মন্তব্য করেছেন। আসলে এসব কুতর্ক এক-একটা নিবিড় ঘড়যন্ত্র। বাঙালি জাতীয়তাবোধ, বাঙালির চেতনা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার মতো বিষয়গুলোকে ঘোলাটে করে বাঙালি জাতি পরিচয় বাঙালি সত্ত্বা থেকে এ দেশের মানুষকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র এসব।’
ডা. নুজহাত শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অস্বীকার করার জন্যই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কলঙ্কিত করতে চাচ্ছে পাকিস্তান-আইএসের দোসরা।’
তিনি বলেন, ‘প্রথম দিকে স্বাধীনতা দিবস কেন? কেন বুদ্ধিজীবী দিবস? এসব নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক হয়েছে। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচন, ৭১’র স্বাধীনতা যুদ্ধ, ২৫মার্চ কালো রাত, নয় মাসের যুদ্ধ, ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা সবই এদেশের উৎপত্তির ইতিহাস। মূলত এদেশের মানুষ পরিচয়হীন করতেই এসব করে যাচ্ছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরাজিত শক্তিরা।’
মুনীর চৌধুরী, ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরীর মতো ব্যক্তিদের নিয়ে এ ধরনের মন্তব্য করায় গয়েশ্বর রায়কে নির্বোধ আখ্যা দিয়ে এ বুদ্ধিজীবী কন্যা বলেন, ‘গয়েশ্বর রায় বলেছেন শহীদ বুদ্ধিজীবীরা এদেশে কী করেছে? তিনি তার উত্তরে বলেন বাংলাদেশে শুধু একটি ফ্রন্টে যুদ্ধ হয়নি। বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ হয়েছে। আমার বাবা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। আমার মায়ের কাছ থেকে শুনেছি তিনি আলো ধরে রাখতেন আর বাবা অপারেশন করতেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিএমএর জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন। একজন ডা. হিসেবে তার দায়িত্ব ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করা।’
জার্মানে কেউ জাতীয়তাবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুললে তাকে বিচারের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান করা হয় উল্লেখ করে ডা. নুজহাত বলেন, ‘স্বাধীনতা, বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ জাতীয় সংবেদনশীল ও জাতীয়তাবোধ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে তার বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রেখে আইন প্রণয়ন করা উচিত।’
সানবিডি/ঢাকা/এসএস