করোনা মহামারিতে জাপানের বাজার ব্যাতিত ইউরোপের দেশগুলোতে বাজার হারিয়েছে খুলনা অঞ্চলের সাদা সোনা খ্যাত হিমায়ীত চিংড়ির ব্যবসায়ীরা।
করোনার প্রকোপ বৃদ্ধির পর ইউরোপিয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে শুধু রফতানিই নয়, দামও কমে যায় এই সাদা সোনার।
চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিলে বড় ধাক্কা এলেও কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে খুলনার হিমায়িত চিংড়ি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে এত কিছুর পরও সাড়ে চারশ কোটি টাকার লোকসানের মুখে পড়তে হবে রফতানিকারকদের।
মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত জাপানের বাজার পেয়েছে খুলনাঞ্চলের হিমায়িত চিংড়ি। একইসাথে আরও ১৪টি দেশে কম-বেশি চিংড়ি রফতানি হচ্ছে। বৃহত্তর খুলনার ৫৮টি হিমায়িত চিংড়ি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান বিদেশে চিংড়ি রফতানি করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, করোনার কারণে চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিলে খুলনাঞ্চলের চিংড়ি রফতানিতে বড় ধরনের ধাক্কা আসে। চাষি, ফড়িয়া, আড়ৎদার ও রফতানিকারক কম-বেশি সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হন।
অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, এক প্রকার পানির দরেই বিক্রি হতে শুরু করে এই অঞ্চলে উৎপাদিত চিংড়ি। সাতশ টাকার চিংড়ি মাছ ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়ে তিনশ টাকা দরে বিক্রি করেন। এতে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়তে হয় চাষিসহ সংশ্লিষ্টদের। এরইমধ্যে করোনার মধ্যেই গত ২০ মে আম্ফানের আঘাতে শ্যামনগর, আশাশুনি ও কয়রার ভেসে যায় কয়েক হাজার চিংড়ির ঘের।
খুলনা বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের সূত্রে জানা যায়, ১৪৮ কোটি ১৭ লাখ টাকা মূল্যের চিংড়ি আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৪ হাজার ৬৩৫টি চিংড়ির ঘের ভেসে যায়।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো সূত্র জানায়, মে মাসে ১ কোটি ৪ লাখ ডলার, জুন মাসে ১ কোটি ৭২ লাখ ডলার, জুলাই মাসে ৯৩ লাখ ৩ হাজার ডলার, ২ লাখ ৬৮ হাজার ৮৩৭ ইউরো, আগস্ট মাসে ৭০ লাখ ৭৫ হাজার ডলার, ৫ লাখ ২৫ হাজার ইউরো, সেপ্টেম্বর মাসে ২৩ লাখ ১৭ হাজার ডলার, ৪ লাখ ৩ হাজার ইউরো, অক্টোবর মাসে ৩০ লাখ ৪৮ হাজার ডলার, ২ লাখ ২৯ হাজার ৪৪৯ ইউরো, নভেম্বর মাসে ১৬ লাখ ৪৯ হাজার ডলার ও ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৬৯৪ ইউরো মূল্যের হিমায়িত চিংড়ি রফতানি হয়। যেসব দেশে চিংড়ি রফতানি হয় তার মধ্যে জাপানই শীর্ষে।
এই সূত্রটি আরও জানায়, বাংলাদেশ থেকে চিংড়ি আমদানিকারক অন্যান্য দেশগুলো হচ্ছে বেলজিয়াম, ফ্রান্স, রাশিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, পর্তুগাল, ডেনমার্ক, রোমানিয়া, ইতালি, গ্রীস, সাইপ্রাস, সুইজারল্যান্ড ও চীন।
সেন্ট মার্টিনস হিমায়িত চিংড়ি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের কমিশন ম্যানেজার প্রবীর চক্রবর্তী জানান, ইউরোপে খুলনাঞ্চলের হিমায়িত চিংড়ি রফতানি কমেছে। তবে জাপানে রফতানির পরিমাণ বেড়েছে।
তিনি জানান, ইতোপূর্বে প্রতি মাসে খুলনাঞ্চল থেকে ২০ কন্টেইনার চিংড়ি রফতানি হলেও এখন রফতানি হচ্ছে ৫ কন্টেইনার। প্রতিটি ৪০ ফুট দৈর্ঘ্য কন্টেইনারের ধারণক্ষমতা ১৬ হাজার কেজি এবং ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের কন্টেইনারে ধারণ ক্ষমতা ৯ হাজার কেজি। ইতোপূর্বে প্রতি পাউন্ড ৭ ডলারে বিক্রি হলেও এখন ১ ডলার দাম কমেছে।
বাংলাদেশ শ্রিম্প অ্যান্ড ফিস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহমুদুল হক তার এক প্রবন্ধে খুলনাঞ্চলের চিংড়ি চাষ সম্পর্কে উল্লেখ করেন, ডুমুরিয়া উপজেলার রুদাঘরা ইউনিয়নের বিলখুকশিয়া অঞ্চলে গুচ্ছ পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করে হেক্টর প্রতি ৩৩৪ কেজির পরিবর্তে ২ হাজার কেজি বছরে উৎপাদন হচ্ছে। উন্নত পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের জন্য বিপিসি ও বিএসএফএফ ডুমুরিয়ার বান্দায় কয়েকটি গুচ্ছ পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সর্পোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন বলেন, চিংড়ি দামি ও সৌখিন খাদ্যপণ্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নয়। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে যে মন্দা ও অবরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে এই পণ্যের চাহিদা গেছে কমে। ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রেতারাও গত ফেব্রুয়ারি থেকে এই পর্যন্ত ২৯০টি ক্রয়াদেশ বাতিল করেছেন যাতে ৪৬০ কোটি টাকা লোকসান হবে বলে ব্যবসায়ীরা হিসাব করে দেখেছেন।
বাগেরহাট জেলা চিংড়িচাষি সমিতির সভাপতি ফকির মহিতুল ইসলাম সুমন বলেন, বর্তমানে বাজারে ২০ গ্রেডের চিংড়ি প্রতি কেজি ৫৫০ টাকা থেকে ৬০০ টাকায় নেমেছে, যা আগে ৭০০ টাকা থেকে ৭৩০ টাকার মধ্যে ছিল। এসব চিংড়ি উৎপাদনে ৫০০ টাকার মতো খরচ হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে জেলার ৬৯ হাজার চিংড়িচাষি লোকসানের শঙ্কায় রয়েছেন।
সানবিডি/নাজমুল