অধ্যাপক ডাক্তার প্রাণ গোপাল দত্ত। প্রখ্যাত চিকিৎসক হিসাবে সমাদৃত। পাশাপাশি আওয়ামী বুদ্ধিজীবী হিসাবে পরিচিত। এক দিনে তার এই পরিচয় গড়ে ওঠেনি। স্বাধীনতা পদকের মতো রাষ্ট্রীয় অনুগ্রহ পেয়েছেন। একাত্তরে তিনি ফ্রণ্টে ছিলেন, সবচেয়ে আলোচিত ছিল সেই ফ্রণ্ট। শেখ মণির নেতৃত্বাধীন মুজিব বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টর। লিখতেন গোপন চিঠিপত্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন দুই দফায়। এমনকি শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত কানের চিকিৎসকও তিনি। সম্প্রতি আত্মজৈবনিক এক সাক্ষাৎকারে তিনি ব্যক্তিজীবনের অনেকগুলো বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেছেন। এর মধ্যে উঠে এসেছে সোভিয়েত ইউনিয়নে তার পড়ালেখার সময়কার স্মৃতিও। সেখান থেকে নির্বাচিত অংশ আজ এখানে তুলে ধরছি।
প্রশ্ন : সোভিয়েত সমাজটাকে কেমন দেখেছেন?
ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত : আমি কিন্তু ছাত্র ইউনিয়ন করিনি। ছাত্রলীগ করেছি, বঙ্গবন্ধুকেই আজ অবধি নেতা মান্য করি। তার পরেও আমার কাছে এখনও মনে হয়, সোভিয়েত সমাজ ব্যবস্থা অত্যন্ত সুন্দর একটা সমাজ ব্যবস্থা ছিল। আমি পরবর্তীতে উচ্চতর পড়ালেখা করতে লন্ডন গিয়েছি, জার্মানি গিয়েছি। কিন্তু সোভিয়েত এদের চেয়ে অনেক সুসংহত, সুন্দর ও মানবিক ছিল। আমি লন্ডন ও জার্মানিতে ভিক্ষুক দেখেছি। কিন্তু সোভিয়েত দেশে কোনোদিন কোথাও কোনো ভিক্ষুক আমার চোখে পড়েনি। সে দেশে কোনো ব্রোথেল বা পতিতালয় ছিল না। কোথাও কখনও কোনো যৌনকর্মী দেখিনি।
সোভিয়েত দেশে সরকার ব্যাপক নিপীড়ন চালাত বলে পশ্চিমা পুঁজিবাদীরা গত এক শতাব্দী ধরে প্রচার করে আসছে। কিন্তু আমি গিয়ে দেখেছি এর উল্টো। মানুষ আইনকে সামাজিক বিধি হিসেবে গণ্য করত। আমি অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা মনে করতেন যে, দেশে যেসব আইন চালু আছে, তা তাদের সমাজের বিকাশের জন্যই দরকার। মোটকথা, আইনকে মানুষ শ্রদ্ধা করত। মানুষ কোনো সমস্যায় পড়লেই রাষ্ট্রের দ্বারস্থ হতো।
আমি একবার গভীর রাতে একটা ট্রামে করে ফিরছিলাম অ্যানিমেল হাউজ থেকে। যেসব পশুর ওপর আমার থিসিসের পরীক্ষা হতো সেগুলোর রক্তের নমুনা নিয়ে। তো কয়েকজন অ্যালকোহলিক যুবক আমার পাশে এসে আমাকে ঘিরে বসল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তারা আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করল। ডাক্তারি করি শোনার পর তারা আমার হাত ধরে দেখল। একে অপরকে বলল, ম্যাককায়া! অর্থাৎ কোমল হাত। বুঝাতে চাইল আমি কায়িক শ্রম করি না, এক প্রকার বুর্জোয়া আর কি! এটা হয়তো খুব কোনো অপরাধ না। কিন্তু ড্রাইভার এটা দেখে রেগে বলল, ওকে ডিস্টার্ব কর না। আমি কিন্তু মিলিশিয়াদের জানাব। ওরা পরের স্টপেজেই নেমে গেল।
দুই মাতাল একবার আমাদের হাসপাতালের এক নার্সকে ধর্ষণ করে তাকে হত্যা করেছিল। সেই মেয়েটি ছিল অসম্ভব সুন্দরী। ধর্ষণ ও হত্যার সাজা ছিল ওপেন ফায়ার। আসামিদের খুঁজে বের করে বিচার করতে মাত্র ২১ দিন লেগেছিল। সামাজিক অপরাধ আমি তেমন একটা দেখিনি। কত জায়গা থেকে কত জায়গায় গিয়েছি। কোনোদিন আমার একটা পয়সাও চুরি হয়নি। কেউ কোনোদিন ছুরি ধরেনি, ঘুষ নিতে বলেনি। উল্টো দেখেছি, তারা একে অপরকে সাহায্য করতে উৎসাহী ছিল।
মাংসটা সেদেশে সিরিয়াল ধরে কিনতে হতো। রুশীরা সামনে থাকলে আমাদের এগিয়ে দিত, কারণ লাইনের শেষ পর্যন্ত মাংস না পাওয়া যাতে পারে। পুরুষরা নারীদের এগিয়ে দিত, বড়রা শিশুদের, তরুণরা বৃদ্ধদের। এই প্র্যাকটিসটা কিন্তু সব জায়গায়ই দেখেছি। কোথাও কোনো স্থান পরিদর্শনে গেলাম। হয়তো বাইরে ঠাণ্ডা, দ্রুত ভেতরে যেতে পারলেই শান্তি। লাইনে তখন একই রকম হতো। অক্টোবর বিপ্লবের সময় সেদেশে চালের কেজি ছিল ৮০ কোপেক। ১৯৮৩ সালেও আমি সেই দামই দেখে এসেছি। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির কোনো নিয়ম সেখানে ছিল না।
রুশ জনগণকে আমার কাছে শান্তিপ্রিয়, মমতাময় ও ভারিক্কি চালের অর্থাৎ কম কথার প্রাজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ মনে হয়েছে! আমাদের মতো চটুল না আর কি। একদিন ট্রাম বিকল হয়ে গেল। আমি হাঁটছিলাম, আমার হাতে কিছু জিনিসপত্র ও ব্যাগ ছিল। একজন বৃদ্ধ নারী এসে বললেন, সিনক্, আমি তোমাকে সাহায্য করি, ব্যাগটা আমাকে দাও, আমার হাত খালি আছে। আমি রাজি হলাম না। তিনি আমাকে বললেন, তুমি কি আমাকে তোমার মায়ের মতো মনে কর না? আমি থমকে গেলাম, তার হাতে ব্যাগটা দিলাম। আরও একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি। সাধারণত আমাদের মতো পদের মানুষরা কেউ মিথ্যা বলেন না এবং প্রচণ্ড দায়িত্বশীল।
তারপর ধরুন, আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় ডাক্তারদের সম্মান কোথায় বেশি। আমি তো জার্মানি, ইংল্যান্ড, রাশিয়া তিনটাই দেখেছি- এক কথায় বলব সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেখানে রোগীরা এসে বলবে, তুমি যা খুশি করতে পার, আমার দায়িত্ব তোমার হাতে ছেড়ে দিলাম। আমার হাসপাতালে দেখেছিলাম, এক রোগীর কানে নয়বার অপারেশন হয়েছিল, নয়বারই আমরা ব্যর্থ হই। ডাক্তাররা তাকে বললেন, তুমি মস্কো যাও। সেখানে তো চিকিৎসার জন্য কারও কোনো ব্যয় ছিল না। সবই রাষ্ট্রের দায়িত্বে। কিন্তু সে গেল না, বলল তুমি প্রয়োজনে আরও ১০ বার কর।
আর যেকোনো রোগী সুস্থ হওয়ার পর তার ডাক্তারকে তিনটি ফুল ও এক বোতল ভদকা উপহার দিত। আমিও পেতাম, প্রথমে আমার দেশিরা এসে সেগুলো খেত। কিন্তু খাওয়ার পরে যে হৈ হল্লা করত, এটা আমার ভালো লাগত না। আমাদের একজন গার্ড আমাকে একদিন বললেন, তুমি এই যন্ত্রণা সহ্য কর কেন? আমি বললাম, এগুলো কি করব? সে বলল, আমাকে দিও, আমি বিক্রি করে তোমাকে রুবল এনে দেব। আগেই বলেছি, রাশিয়ায় জিনিসপত্রের দাম কম ছিল। আমি ওই মদ বিক্রির টাকায় দেশে ফেরার সময় এক কন্টেইনার ভর্তি করে ফ্রিজ, টিভি, সেলাই মেশিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সাংসারিক জিনিসপত্র সবই কিনে এনেছিলাম। মেডিকেল ইথিকস অনুযায়ী রোগী সুস্থ হয়ে ফিরে গেলে তার দেয়া উপহার ডাক্তার নিতে পারেন, এটা অনৈতিক নয়।
আরেকটা ঘটনা বলি। আমি একটা অপারেশন করছিলাম, আমার বস দিমিত্রি মাইক্রোস্কোপের অবজার্ভার টিউবে বসা। আমি কানের মধ্য থেকে একটা স্টেপিস উঠাব, উঠাতে গিয়ে তার নিচের লেবিরিনটা একটু ফেটে গেল। লেবিরিন ফাটলে সেখান থেকে একটা ফ্লুইড বেরিয়ে আসে। তিনি রোগীকে জিজ্ঞেস করে বুঝলেন, মাথা ঘুরাচ্ছে! বললেন, হ্যাঁ এ সময় একটু মাথা ঘোরাতে পারে। আমাকে সরিয়ে তিনি কানের অন্য অংশ থেকে একটু ফ্যাট নিয়ে লেবিরিনটা সিল করে দিলেন। পরে রোগীকে বললেন, তোমার এই কানে আমরা অপারেশন করতে পারব না, আমরা ফেইলড হয়েছি। কিন্তু আমাকে বকা দেয়া, গালি দেয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। অন্য সময়েও কোনো ডাক্তারকে এরকম কিছু করতে দেখিনি। ওই রোগীও কিন্তু বলেননি যে, এই বাংলাদেশির কারণেই এমনটা হলো কিনা! মানুষগুলো এমনই ছিল।
অথচ দেখেন বাইরের বিশ্বে একটা বিপ্লব ও একটা চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের বরাতে এই সরল মানুষগুলোর কেমন একটা বিধ্বংসী পরিচয় দাঁড়িয়ে গেছে। এ থেকে আমি প্রোপাগান্ডার শক্তি টের পাই। আগেই বলেছিলাম, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কী ধরনের চক্রান্ত হয়েছিল! সোভিয়েতও একই পরিণতি ভোগ করেছে। পুঁজিবাদী বিশ্বের চক্রান্তকে তারা মোকাবিলা করতে পারেনি। চীনা সমাজতন্ত্র দেখিনি, তাই তাদের আলাপ বাদ দিয়েই বলব, বাস্তবে সোভিয়েতের মতো আধুনিক সমাজ পৃথিবীতে এখনও একটাও হয়নি।
প্রশ্ন : সোভিয়েত শিক্ষা, মেডিকেল শিক্ষা নিয়ে তো নানা আলাপই জারি আছে। আপনি তো ইউরোপের অন্য দেশগুলোতেও পড়ালেখা করেছেন। সোভিয়েত শিক্ষাপদ্ধতির সঙ্গে এর একটা তুলনা করুন।
ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত : ওখানে আমাদের দেশ থেকে সাধারণত উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ছেলেমেয়েরা যেত। আমি গিয়েছি এমবিবিএস পাস, আরও তিন বছর চাকরির অভিজ্ঞতা ও বিয়ে করার পর। ফলে আমার একটা ম্যাচিউরিটি ছিল। মানুষের দেখার চোখটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নে জিন্স কাপড় ছিল না। কিন্তু ওদের কাছাকাছি মানের আরেকটা কাপড় ছিল, আমাদের কাপড়ের চেয়ে যার গুণগত মান অনেক ভালো। আমরা যখন জিন্স পরে যেতাম, রুশীরা আমাদের সঙ্গে কাপড় বদলাতো। ওদের তিনটা প্যান্ট দিয়ে আমাদের কাছ থেকে একটা জিন্স পেতে চাইতো। সেখানে হয়তো বিভিন্ন ডিজাইনের কাপড় কম ছিল, বিলাসদ্রব্যও কম পাওয়া যেত। এখন এটা দেখে কেউ যদি মনে করে, সোভিয়েতে মানুষের স্বাধীনতা ছিল না, তাহলে সেটা তার দেখার সমস্যাই বলব। কারণ চালের ৮০ কোপেকটা কেন তার নজরে পড়ছে না?
পৃথিবীর কোনো পুঁজিবাদী দেশও এটা বিশ্বাস করে না যে, সোভিয়েত শিক্ষাপদ্ধতি খারাপ বা দুর্বল ছিল। বরং সোভিয়েত চিকিৎসক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তারা উচ্চধারণাই পোষণ করেন। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষকেই কেবল সোভিয়েত শিক্ষা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করতে দেখেছি। এর একটা কারণ হচ্ছে, সোভিয়েতে পড়ালেখা করতে টাকা লাগত না। আর আমাদের মানুষেরা পয়সা ছাড়া কিছু পেলে তার মূল্য দেয় না, এটা তো জানা কথাই। আমাদের দেশের যেসব ডাক্তার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে ইউরোপ বা আমেরিকা থেকে পড়ালেখা করে এসেছে, তারা এটা বলে ও বিশ্বাস করে যে, সোভিয়েতের মেডিকেল পড়ালেখা ভালো ছিল না। কারণ ওটাই, টাকা ছাড়া পড়লে কি আর পড়ালেখা হয় নাকি!
ল্যারিঞ্জেমি নামে গলার ক্যান্সারের একটা অপারেশন আছে, সিগোলোভিচকে আমি ওটা করতে দেখেছি দেড় থেকে পৌনে দুই ঘণ্টার মধ্যে। ইংল্যান্ডে দেখেছি, তিন থেকে ছয় ঘণ্টা সময় লাগে। তবে এটা ঠিক যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কেউ কেউ পড়ার নামে রাশিয়া গেলেও তারা আসলে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য সেখানে গিয়েছিলেন। তারা হতাশার মধ্যে ছিলেন, পড়ালেখাটা তাদের উদ্দেশ্যও ছিল না। এদের কাউকে দেখে এরকম ধারণা তৈরি হতে পারে। আবার শেষদিকে স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনায় সোভিয়েত ইউনিয়নও অস্থির ছিল। কিন্তু যারা পড়তে গিয়েছে, তাদের ওরা পড়িয়েছে। আর তাদের শিক্ষাপদ্ধতি ছিল একটু বেশি ব্যবহারিক, অন্যদিকে ইউরোপের শিক্ষাপদ্ধতি বেশি তাত্ত্বিক।
তাছাড়া শুধু আমাদের দেশের মানুষরা ওখানে পড়ত তা তো নয়! সমাজতান্ত্রিক বলয়ে থাকা সব ইউরোপ, ল্যাটিন, এশিয়ার দেশগুলো এবং ল্যাটিন, এশিয়া ও আফ্রিকার নিপীড়িত রাষ্ট্রগুলোর শিক্ষার্থীদের তারা নিত। অন্যদের তারা নিত না। তাদের নীতি ছিল গরিবদের শিক্ষা দেয়া, আর যেহেতু শিক্ষা ফ্রি, তাই ধনী দেশের মানুষদের তারা নিত না। সোভিয়েত দেশের যে মানুষদের বর্ণনা আমি দিলাম, শিক্ষার্থীকে কিছু শেখানোর না থাকলে তারা কখনই সেসব শিক্ষার্থীকে সে দেশে ডেকে নিত না। এত অনৈতিক হলে আমরা ওরকম মানুষের দেখা পেতাম না।
সূত্র : [আত্মজৈবনীক সাক্ষাৎকার] ব্যাতিক্রমী চিকিৎসক-শিক্ষাবিদ -অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত।