কঠোর পদক্ষেপেও বিমা খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে পারেনি নিয়স্ত্রক সংস্থা
আপডেট: ২০১৫-১২-৩০ ২১:৩৩:৫৭
বছর জুড়ে কঠোর অবস্থানে ছিলো বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। ২০১৫ সালে অনিয়মের কারণে বাতিল করা হয়েছে একটি বিমা কোম্পানির ব্যবসার নিবন্ধন সনদ। জরিমানার কবলে পড়তে হয়েছে ওই কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সব সদস্যকে। অন্য একটি কোম্পানিকে কোটি টাকার উপরে জরিমানা করা হয়েছে। একাধিক কোম্পানিতে নিরীক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে এরপরও বিমা খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারিনি বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
আইডিয়ারের কঠোর অবস্থানের মধ্যেও গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা, অবৈধভাবে অর্থ খরচ, চেক জালিয়াতি, ভূয়া এজেন্ট, মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদে অযোগ্য ব্যক্তি, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ জাল, অতিরিক্ত কমিশন, বাকি ব্যবসাসহ সকল ধরণের দুর্নীতি আর অনিয়ম হরহামেশাই চলছে বিমা খাতে। বিমা কোম্পানিগুলোতে আইন লঙ্ঘন করে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে ব্যয় করা হচ্ছে। ক্ষেত্র বিশেষে অকারণেই আইডিআরএতে ফাইল আটকে রাখা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থায় দক্ষ জনবলের অভাব ও উচ্চ পদে নিয়োগে অনিয়মের কারণেই বিমা খাত থেকে পুরোপুরি অনিয়ম দুর করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভন হচ্ছে না।
অভিযোগ আছে, ব্যপক অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা অধিদফতর বিলুপ্ত করা হয়। এরপর ২০১১ সালে গঠন করা হয় নতুন নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। কিন্তু দুর্নীতির কবল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি নতুন নিয়ন্ত্রক সংস্থাটিও।
নতুন নিয়ন্ত্রক সংস্থায় বার বার দুর্নীতি পরায়ন ও অযোগ্য ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে। ফলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো তেমন কোন পদক্ষই নিতে পারেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। ক্ষেত্রবিশেষে আগের নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্নীতিও ছাড়িয়ে গেছে নতুন নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।
এমনকি বর্তমান দিয়েত্বে থাকা ৪ জন সদস্যের মধ্যে দুইজনের যোগ্যতা নিয়ে বিমা খাতে নানা গুঞ্জন রয়েছে। এই দুই সদস্যকে বিমা বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলেও তাদের কেউ কখনো কোন বিমা কোম্পানির শীর্ষ পদে চাকরি করেনি। এদের মধ্যে একজনের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ওই সদস্য সাধারণ বিএ পাশ। অথচ বিমা কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত রাখা হয়েছে মাস্টার্স পাশ।
এছাড়া দুর্নীতার অভিযোগ থাকা একজনকে সম্প্রতি আইডিআরএর উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং এর এক নিরীক্ষা প্রতিবেদন এই উপদেষ্টার বিরুদ্ধে ব্যপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠে আসে। তিনি অনুমোদনহীন ভুয়া এজেন্টের মাধ্যমে প্রগ্রেসিভ লাইফ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা অত্মসাত করেন। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি মামলাও করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ জানিয়েছেন, আমাদের লোকবল সংকট রয়েছে। যে কারণে অনেক ক্ষেত্রে হয়তো সঠিক সময়ে সব কাজ করা সম্ভব হয় না। তারপরও বিমা খাতকে আমরা নিয়মের মধ্যে আনতে কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, বিমা খাতের উন্নয়নে ও গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষায় আইডিআরএ থেকে আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। প্রয়োজন হলে কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণেও আইডিআরএ পিছপা হবে না। ইতিমধ্যে গুরুতর অনিয়মের কারণে স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্সের নিবন্ধন সনদ বাতিল করা হয়েছে। আইন লঙ্ঘন করে গ্রাহকের টাকা খরচ করায় ২০১৫ সালে ৪টি জীবন বিমা কোম্পানি নিরীক্ষক করেছে আইডিআরএ। এই কোম্পানিগুলোর মধ্যে সরকরি প্রতিষ্ঠান জীবন বিমা কর্পোরেশনসহ আছে পদ্মা ইসলামী লাইফ, ন্যাশনাল লাইফ, মেঘনা লাইফ, প্রগতী লাইফ ও সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি। এছাড়া বেশকটি সাধারণ বিমা কোম্পানিকে মোটা অঙ্কের জরিমনা করা হয়েছে।
বিমা খাতের সার্বিক বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভিন্ন কোম্পানির মূখ্য নির্বাহীরা বলেন, স্ট্যান্ডার্ড ইক্যুরেন্সের নিবন্ধন বাতিল করা আইডিআরএ’র একটি সাহসী পদক্ষেপ। কিন্তু সকল ক্ষেত্রে আইডিআরএ এ ধরণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। এমনকি ক্ষেত্রে বিশেষে স্বজনপ্রীতিও ঘটছে।
তারা বলেন, বিমা খাতে বর্তমানে যে অনিয়ম আছে তার জন্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ও আইডিআরএ অনেক অংশে দায়ী। অর্থমন্ত্রী নিজেই যোগ্যতাহীন ও দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রক সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে রেখেছেন। যে কারণে এমন নিয়ন্ত্রক সংস্থা দিয়ে বিমা খাত থেকে দুর্নীতি ও অনিয়ম দুর করা সম্ভব হচ্ছে না।
সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে আইডিআরএ গঠনের পর থেকেই প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। প্রথম ধাপে নিয়োগ দেয়া সদস্যদের বিদায় করে দেয়ার পরও এ দ্বন্দ্বরে অবসান হয়নি। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রণালয়ে এক পক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে পাল্টা পাল্টি অভিযোগ করেছে।
বিমা আইন পাশের পর একে একে ৫টি বছর পার হলেও তৈরি করা হয়নি আইনের অধিকাংশ বিধি ও প্রবিধানমালা। গত ৫ বছরে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে মাত্র ৯টি প্রবিধানমাল। আর এখনো আলোর মুখ দেখেনি ১৭টি বিধি ও প্রবিধানমাল। অথচ এই বিধি ও প্রবিধানমালা হলো আইনের ব্যাখ্যা। সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী আইডিআরএতে লোকবল নিয়োগ দেয়া হয়নি। মন্ত্রনালয় থেকে গত ফেব্রুয়ারিতে আইডিআরএ’র জনবল কাঠামো অনুমোদন করা হয়। কিন্তু এরপর ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও তার বাস্তবায়নে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে ভাড়া করা (চুক্তি ভিত্তিক) লোকবল দিয়েই চলছে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
সরকারি বিমা প্রতিষ্ঠান জীবন বিমা কর্পোরেশনসহ ১৭টি জীবন বিমা কোম্পানি শেষ বছরে ৩০৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা অবৈধভাবে খরচ করেছে। কেম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের হিসেবে এ অবৈধ ব্যয় করা হয়। এর আগের পাঁচ বছরে একইভাবে ১ হাজার ৪৭৮ কোটি ১ লাখ টাকা অবৈধভাবে ব্যয় করে প্রতিষ্ঠানগুলো। অর্থাৎ শেষ ৬ বছরে দেশের জীবন বিমা কোম্পানিগুলো অবৈধভাবে ব্যয় করেছে ১ হাজার ৭৮৫ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
বিমা পলিসির মেয়াদ শেষে বিমা দাবি পরিশোধ অথবা গ্রাহকের মৃত্যুজনিত বিমা দাবির টাকা পরিশোধে জীবন বিমা কোম্পানিগুলো হরহামেশাই টালবাহানা করছে। দিনের পর দিন কোম্পানিতে ধন্যা দিয়েও গ্রাহক তার কোনো সমাধান পাননি। এর সঙ্গে নতুন যোগ হয়েছে গ্রাহকের বিমা দাবির চেক জালিয়াতি।
এছাড়া অতিরিক্ত কমিশন দেয়া ও বাকি ব্যবসার অভিযোগ ২০১৫ সালে আইডিআরএ ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্সকে ৩ কোটি টাকা জরিমনা করেছে। এছাড়া বছরটিতে ৩ লাখ থেকে ৪৭ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হয়েছে আরও ২৭টি কোম্পানিকে।