চলতি অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতির বৃত্ত এখনো ভাঙতে পারেনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সর্বশেষ গত নভেম্বর মাসে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ২৪ শতাংশ। তবে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে প্রায় ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে।
এনবিআর সূত্র জানায়, আগামী ছয় মাসে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে রাজস্ব প্রশাসনে ‘সুশাসন’ প্রতিষ্ঠাসহ ইতোমধ্যেই বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
‘সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ নিয়ে চলতি বছরের শুরুতেই (১২ জানুয়ারি) এনবিআর চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেন নজিবুর রহমান। প্রত্যয় ব্যক্ত করেন সরকারের বেঁধে দেয়া রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের। এনবিআর চেয়ারম্যানের কতিপয় পদক্ষেপ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বছরজুড়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। এর মধ্যে কাস্টমস ক্যাডারের জ্যেষ্ঠ দুই সদস্যের বাধ্যতামূলক ও স্বেচ্ছা অবসর অন্যতম। গত মে মাসে কাস্টমস ক্যাডারের জ্যেষ্ঠ সদস্য জাহানারা সিদ্দিকীকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে তাকে অবসরে পাঠানো হয়েছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। এরপর ১ ডিসেম্বর স্বেচ্ছায় অবসরে যান আরেক সদস্য হুসেইন আহমেদ।
এ ছাড়া গত ১৬ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এনবিআর চেয়ারম্যানের একটি ডিও বিতর্কের জন্ম দেয়। ডিও লেটারে কাস্টমস ক্যাডারের ৪১ জন কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠানোর অনুরোধ করেন তিনি। এ সব নিয়ে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বছরজুড়ে গুঞ্জন ও বিতর্ক ছিল। অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের অভিযোগের ভিত্তিতে অসাধু কিছু কর্মকর্তাকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। যা সব মহলে প্রশংসিত হয়।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে ৮ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা। তবে মাসওয়ারী ভিত্তিতে গত নভেম্বরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। প্রথম চার মাসে আদায়ের মোট প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ। জুলাই দশমিক ৫৫ শতাংশ, আগস্টে ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ ও সেপ্টেম্বরে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ।
চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৫৪ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা। এ সময়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬২ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রা তুলনায় ঘাটতির পরিমাণ ৮ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা। বিগত অর্থবছরে একই সময়ে আদায় ছিল ৪৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
তবে মাসওয়ারী ভিত্তিতে নভেম্বরে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১২ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের নভেম্বরে আদায় হয়েছিল ৯ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এ মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
রাজস্ব ঘাটতির কারণ হিসেবে এনবিআর বলছে, অর্থনীতির গতি অনুযায়ী অর্থবছরের শেষের অংশে রাজস্ব আদায় বেশি হয়ে থাকে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন বছরের শেষের দিকে বেশি হয়। আগের বছরগুলোতে শেষের ছয় মাসে বেশি টার্গেট ধরা হতো। বর্তমান অর্থবছরে কৌশলগত কারণে এবং কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য সকল মাসে সমান টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে।
এনবিআরের মতে, চলতি অর্থবছরে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বিগত সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ধরা হয়েছে। স্বাধীনতার পর হতে এ পর্যন্ত এনবিআরের গড় রাজস্ব আদায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ এর মধ্যে সীমিত ছিল। গত অর্থবছরে (২০১৪-১৫) রাজস্ব আদায়ে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। বর্তমান বছরে রাজস্বের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে প্রায় ২৯ শতাংশ।
বিশাল এ লক্ষ্যকে তাড়া করতে রাজস্ব আয় বাড়ানো, জনগণের মধ্যে করভীতি দূর ও করসেবা পৌঁছে দিতে রাজস্ব সংলাপের উদ্যোগ নেয় এনবিআর। বাজেটের আগে পরামর্শক সভার বাইরে প্রথমবারের মতো ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এ ধরনের সংলাপ আয়োজন করে এনবিআর। যা ব্যবসায়ী মহলে প্রশংসিত হয়। রাজস্ব সংলাপে ব্যবসায়ীরা মন খুলে তাদের অভিযোগ জানান। এনবিআর চেয়ারম্যানও সে মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন।
জানা গেছে, এনবিআর চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদানের পর এনবিআরের গতিশীলতা, স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে ‘সিএফআই’র স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান (সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা) নিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাজ শুরু করেন নজিবুর রহমান। ‘দুষ্টের দমন, শিষ্টের লালন’-এ নীতিতে কাজ করতে কর্মকর্তাদের উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। ব্যবসায়ীদের সাফ জানিয়ে দেন, অসৎ ব্যবসায়ীদের নিবারণ করা হবে। আর সৎ ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করা হবে। এর অংশ হিসেবে সৎ ব্যবসায়ীদের গ্রিন চ্যানেল ব্যবহার ও অসৎ ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরির কাজ হাতে নেন, যা ব্যবসায়ীসহ সব মহলে প্রশংসিত হয়।
উল্লেখ, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অংশ হিসেবে এ বছরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পেজ খোলে এনবিআর। এ পেজে এনবিআরের বদলি, পদোন্নতি-সংক্রান্ত যাবতীয় আপডেট তথ্য দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া এনবিআর চেয়ারম্যানের নির্দেশে কর অঞ্চল ও ভ্যাট কমিশনারেটগুলোও নিজস্ব ফেসবুক পেজ খুলেছে। এ সব পেজে অভিযোগের ভিত্তিতে ভ্যাট ফাঁকি রোধে অভিযান চালিয়েছে কমিশনারেটগুলো।