প্রতিবছরের মতো এ বছরও উত্থান-পতনের মধ্যে লেনদেন হয় পুঁজিবাজারে। তবে চলতি বছরের শুরুতে রাজনৈতিক সংকটে মন্দার কবলে পড়ে দেশের পুঁজিবাজার। সেই মন্দা থেকে উত্তরণ ঘটতে না ঘটতেই ব্যাংকের অতিরিক্ত বিনিয়োগ সমন্বয় ইস্যুতে ফের মন্দা শুরু হয় বাজারে। মূলত এ দুই ইস্যুতেই কুপোকাত বাজার। কর্তৃপক্ষের নানা পদক্ষেপেও মন্দার কবল থেকে বের হতে পারেনি পুঁজিবাজার। এতে সব ধরনের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। মন্দার জন্য রাজপথে বিভিন্ন সময়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করে বিনিয়োগকারীরা।
তবে গত কয়েক বছরের তুলনায় বিক্ষোভের মাত্রা ছিল কম। মন্দা বাজারেও অতিরিক্ত প্রিমিয়ামের মাধ্যমে কোম্পানিগুলোকে আইপিও অনুমোদন দেয়া, বাজারে ধস ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি করেন বিনিয়োগকারীরা। এছাড়া ব্যাংকগুলোর এক্সপোজার লিমিট কমানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরেরও পদত্যাগ দাবি করেন বিনিয়োগকারীরা।
চলতি বছরে অন্যতম আলোচিত বিষয় ছিল পুঁজিবাজার সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম চালু। চলতি জুন মাস থেকে শুরু হয়েছে ট্রাইব্যুনালের কাজ। শেষ পর্যন্ত ৫টি মামলার রায় ঘোষণা করে পুঁজিবাজার ট্রাইব্যুনাল। এরমধ্যে দুটি মামলায় আসামিরা খালাস ও অপর ৩টি মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও আর্থিকদণ্ড প্রদান করেছে। তবে আলোচিত চিটাগাং সিমেন্ট মামলার শুনানি শেষে রায় ঘোষণার তারিখও ঘোষণা করেছিলেন ট্রাইব্যুনালের বিচারক। কিন্তু উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে শেষ পর্যন্ত রায় ঘোষণা করতে পারেনি ট্রাইব্যুনাল। এ মামলার অন্যতম আসামি হলেন ডিএসই’র সাবেক প্রেসিডেন্ট রকিবুর রহমান।
২০১৫ সালে নতুন কিছু বিধান কার্যকর হয়েছে এবং বেশ কিছু বিধানে সংশোধনী আনা হয়েছে। স্টক এক্সচেঞ্জের জন্য ‘লিস্টিং রেগুলেশন-২০১৫’ অনুমোদন দিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা। নতুন এ রেগুলেশনে আইপিও প্রসপেক্টাসে মতামত দেয়ার ক্ষমতা পেয়েছে দেশের উভয় স্টক এক্সচেঞ্জ। এছাড়া ইস্যুয়ার কোম্পানির পরিচালক, কর্মকর্তা এবং নীরিক্ষক প্রতিষ্ঠানের নিকট ব্যাখ্যা চাওয়া, ইস্যুয়ার কোম্পানি পরিদর্শনের ক্ষমতা স্টক এক্সচেঞ্জেকে দেয়া হয়েছে রেগুলেশন্সে। নতুন এ রেগুলেশন্সের মাধ্যমে স্টক এক্সচেঞ্জের ক্ষমতা আগের তুলনায় বেড়েছে।
এছাড়া বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ‘অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট রুল-২০১৫’ নামে নতুন রুল প্রণয়ন করেছে। মূলত প্রাইভেট ইক্যুয়িটি ও ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফাইন্যান্সের মাধ্যমে তালিকাবহির্ভূত কোম্পানিতে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতেই এ বিধি প্রণয়ন করা হয়েছে। ‘পাবলিক ইস্যু রুল’ নামে নতুন একটি রুলের খসড়া অনুমোদন করেছে কমিশন। জনমত যাচাইয়ের এটি প্রকাশ করেছে কমিশন। পাবলিক ইস্যু রুলে আইপিওতে প্রিমিয়ামের জন্য বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে আবেদনের বিধান রাখাসহ আইপিওতে কোটা সংরক্ষণের বিষয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এছাড়া বেশ কিছু সংশোধনীসহ মিউচ্যুয়াল ফান্ড বিধিমালায় পরিবর্তনে খসড়া অনুমোদন দিয়েছে বিএসইসি। খসড়া বিধিমালায় মিউচ্যুয়াল ফান্ডের পোর্টফোলিও মাসিক ভিত্তিতে নিজস্ব ওয়েব সাইটে প্রকাশ, বে-মেয়াদি ফান্ডের জন্য ট্রেডিং প্লাটফরম চালুর বিধান রাখা হয়েছে এতে।
ব্যাংকের পরিবর্তে ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে আইপিও আবেদন গ্রহণের বিষয়টি ছিল বাজারের জন্য একটি ইতিবাচক ঘটনা। ২৫ মে থেকে ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে আইপিও আবেদন গ্রহণ শুরু হয়। আইপিও আবেদনে বিনিয়োগকারীদের বিড়ম্বনার অবসান ঘটেছে।
পুঁজিবাজারে লেনদেনের জন্য নতুন সফটওয়্যার সংযোজন করেও লেনদেন বিভ্রাট থেকে মুক্ত হতে পারেনি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। কারিগরি ত্রুটির কারণে বেশ কয়েক দফা নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অনেক দেরিতে লেনদেন শুরু হয়েছে ডিএসইতে। এতে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের।
প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) অনুমোদনের যথার্থতা নিয়ে বরাবরের মতো এবারও সমালোচনা ছিল। তারপরও ২০১৫ সালে ১১টি কোম্পানির আইপিও আবেদন সম্পন্ন হয়েছে। কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজার থেকে অভিহিত মূল্যে ৩৭৪ কোটি ৬ লাখ ৬২ হাজার টাকা এবং প্রিমিয়াম মূল্যে ৪৫৬ কোটি ৫৫ লাখ ৫৯ হাজার ২শত টাকা প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে। অর্থাৎ ১২টি কোম্পানি ২০১৫ সালে পুঁজিবাজার থেকে ৮৩০ কোটি ৬২ লাখ ২১ হাজার ২০০ টাকা সংগ্রহ করেছে।
২০১৫ সালের শুরুতে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ডিএসই ব্রড ইনডেক্স (ডিএসইএক্স) ছিল ৪৮০০ পয়েন্টর উপরে। আর এখন তা নেমে এসেছে ৪৫০০ পয়েন্টের ঘরে। অপরদিকে বছরের বেশিরভাগ সময় জুড়েই লেনদেন ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার ঘরেই সীমাবদ্ধ ছিল।
পুঁজিবাজার সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, দেশের অর্থনীতির অন্যসব সূচক এগিয়ে গেলেও পুঁজিবাজার পিছিয়ে গেছে। পিছিয়ে যাওয়ার মতো কোন ঘটনাও ঘটেনি। কিন্তু তারপরেও প্রায় ৩০০ মূল্য সূচক নাই। এদিক দিয়ে ২০১৫ সাল বিনিয়োগকারীদের জন্য ভালো ছিল না।
এদিকে বাজারের মন্দা ঠেকাতে ব্যাংকের অতিরিক্ত বিনিয়োগ সমন্বয়ে সময়সীমা ২ বছর বাড়ানোর বিষয়ে ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী। বছরের শেষদিকে ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি কোম্পানির মূলধনকে শেয়ারবাজার এক্সপোজার হিসাবে গণ্য না করার বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাজারে অস্থিরতা প্রশমনের এমন প্রয়াসে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়লেও বছরজুড়ে বিরাজমান মন্দার কারণে লোকসান গুনতে হয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। সার্বিকভাবে আরও একটি হতাশাজনক বছর পার করেছে পুঁজিবাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।