দৈনিক কি পরিমাণ চাল খাই আমরা?
সান বিডি ডেস্ক আপডেট: ২০২১-০১-২০ ১৬:২১:৩৫
আমাদের দেশে চাল সংকটের পেছনে অনেক কারণের একটি হলো, জনপ্রতি চালের চাহিদা সংক্রান্ত তথ্যের অসঙ্গতি। আমরা দৈনিক যে পরিমাণ চাল এক জন ব্যক্তির গড়ে ভোগ করি তার পরিমাণ নিয়ে একেক সংস্থার একেক রকম হিসাব চালু আছে।
চাল নিয়ে এখন হই-চই চলছে। কারণ চাল আছে, আবার চাল নেই। তার মানে সরবরাহে কোথায়ও একটা ফাঁক তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশে চালের চাহিদা এবং মাথাপিছু চাল খাওয়ার পরিমাণ নিয়ে রয়েছে বিভ্রান্তি। বিতর্ক আছে ধান উৎপাদনের প্রকৃত পরিমাণ এবং তার থেকে চাল পাওয়ার পরিমাণ নিয়েও। বলা হচ্ছে, চালের উৎপাদন বাড়ছে, যার বিপরীতে মাথাপিছু ভোগ কমছে। এতে চাহিদার তুলনায় দেশে চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। অথচ বাস্তবে দেশে এখন ঘাটতি বিরাজ করছে।
বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন, চাল অতি স্পর্শকাতর পণ্য। তাই এর প্রকৃত উৎপাদন ও মজুদ নিয়ে সঠিক পরিকল্পনার জন্য মাথাপিছু চাল ভোগের বা ব্যবহারের সঠিক তথ্য থাকা জরুরি। কেননা, ভোগের তথ্য অনুযায়ীই চালের চাহিদা নিরূপণ করা হয়। একই সঙ্গে নেয়া হয় মজুদ উদ্যোগ। সেখানে সঠিক তথ্য না থাকলে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পর্যায়ে গলদঘর্ম হতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাস্তবে চালের মাথাপিছু ভোগ এবং বাৎসরিক চাহিদার প্রকৃত পরিমাণ নিয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য নেই, যার ওপর নির্ভর করে সরকার তার বাৎসরিক ক্রয় পরিকল্পনা গ্রহণ এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনায় পদক্ষেপ নেবে।
আরও জানা যায়, ধান এবং চাল নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সংস্থার রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন হিসাব। প্রকৃত উৎপাদন তথ্যও পরিষ্কার নয়। কৃষি মন্ত্রণালয় ধানের যে হিসাব দেখায়, ওই হিসাবকেই খাদ্য মন্ত্রণালয় চাল হিসেবে দেখায়। অথচ এক কেজি ধানে কত গ্রাম চাল হয় বা এক মণ ধান থেকে কত কেজি চাল পাওয়া যায়– সে হিসাবটিও জনসমক্ষে পরিষ্কার করা হচ্ছে না।
তাছাড়া ধান-চালের উৎপাদনের তথ্য সাধারণত মাঠ পর্যায়ের হিসাব। মাঠের এই ধান ভোক্তা পর্যায়ে আসতে নানা মাত্রায় আগে-পরে উৎপাদন ক্ষতি হয়। সেই ক্ষতির পরিমাণ ৮-১০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর বাইরে প্রাণিখাদ্য হিসেবেও চালের কয়েক লাখ টন ভোগ হয়, যার হিসাব ব্যবস্থাপনায় আমলে আনা হয় না। এ জন্য উৎপাদন ও ভোগ সব ক্ষেত্রেই সঠিক তথ্য থাকা প্রয়োজন।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বিশেষজ্ঞদের এ দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, ‘ধান-চালের উৎপাদন, চাহিদা ও ভোগ তথ্যে কিছুটা গড়মিল রয়েছে। এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আরেক প্রতিষ্ঠানের হিসাবে কম-বেশি হচ্ছে। এটা হওয়া উচিত নয়। খাদ্য মন্ত্রণালয় চেষ্টা করছে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বিত একটি পদ্ধতিতে অপেক্ষাকৃত সঠিক হিসাবটি বের করার।’
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম জানান, ‘উৎপাদন ও ভোগের তথ্য সঠিক না হলে নীতি প্রণয়নে বিশেষ করে আমদানি-রপ্তানির বিষয়ে সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।’
বিদায়ী ধান উৎপাদন মৌসুমে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেয়া হয়, অভ্যন্তরীণ খাদ্য চাহিদা পূরণ করেও চলতি বছরের জুন পর্যন্ত কমপক্ষে ৩০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। সেখানে বলা হয়েছে, অতিবৃষ্টিতে কয়েক দফা বন্যায় ৩৫টি জেলার আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সারা বছরের উৎপাদন ও চাহিদা বিবেচনা করলে দেশে খাদ্য ঘাটতির ‘আপাতত কোনো আশঙ্কা নেই’।
সংস্থাটি দেশে মাথাপিছু দৈনিক চাল খাওয়া বা ভোগের পরিমাণ জানায় ৪০৫ গ্রাম। জনসংখ্যার হিসাব ধরা হয় ১৬ কোটি ৭০ লাখ। অথচ ব্রির গত বছরের আগস্টে প্রকাশ করা এই প্রতিবেদনের পূর্বাভাস গত বছর নভেম্বরেই ভুল প্রমাণিত হয়। চলতি বছর জুন পর্যন্ত ৩০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকা তো দূরের কথা, জানুয়ারিতেই সংকটের আশংকায় সরকার জি-টিু-জি (দুই সরকারের মধ্যে লেনদেন) পদ্ধতিতে সাড়ে চার লাখ টন চাল আমদানি করতে বাধ্য হচ্ছে। একইভাবে রপ্তানিমুখী বাংলাদেশ এখন চাল আমদানির পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে বেসরকারি খাতেও।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাথাপিছু দৈনিক চাল খাওয়ার পরিমাণ ৪১৬ গ্রাম। এ হিসাবে বার্ষিক জনপ্রতি চালের ব্যবহার ১৫২ কেজি। দেশে মোট বার্ষিক চালের চাহিদা সেক্ষেত্রে ২ কোটি ৫৮ লাখ ৪০ হাজার টন। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবটি ছিল ২০১৯ সালে দেশে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫৫ লাখসহ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও বিদেশিদের সংখ্যা মিলে মোট ১৭ কোটির।
অথচ চালকল মালিকরা দাবি করছেন, দেশে এ মুহূর্তে বিদেশিসহ মোট জনসংখ্যা ২০ কোটি। এই হিসাবে চালের চাহিদা ৩ কোটি ৪ লাখ টন।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে দেশে দৈনিক মাথাপিছু চাল খাওয়ার পরিমাণ ছিল ৪১৬ গ্রাম। সর্বশেষ হিসাব খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুযায়ী ২০১৬ সালে তা কমে ৩৬৭ দশমিক ২ গ্রামে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) ২০১৬ সালের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশে মাথাপিছু দৈনিক চাল খাওয়ার পরিমাণ ৪৬০ গ্রাম। অন্যদিকে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) গবেষণা তথ্যমতে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে মানুষের দৈনিক মাথাপিছু চাল খাওয়ার পরিমাণ ছিল ৩৯৬ দশমিক ৬ গ্রাম। সংস্থাটির ২০১৬ সালের হিসাবে ছিল ৪২৬ গ্রাম।
চালসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের চাহিদা, ভোগ, উৎপাদনে অস্বাভাবিকতা ও সমন্বয়হীনতা পর্যালোচনা করেছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ড. আর এম দেবনাথ। তিনি বিবিএসের ‘খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০১৬’ তথ্য ধরে ১৯৯৫ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ২১ বছরের মাথাপিছু চালের ভোগ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে স্ববিরোধী তথ্য পেয়েছেন।
তিনি এক তথ্যে পেয়েছেন, দেশের মানুষের ভাত খাওয়ার পরিমাণ কমছে। ১৯৯৫ সালে মাথাপিছু চালের ভোগ ছিল ৪৬৪ গ্রাম। ২০১০ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৪১৬ গ্রামে। ২০১৬ সালে তা নেমে আসে ৩৬৭ গ্রামে। অপর তথ্য পর্যালোচনা করে তিনি তথ্যের বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
ড. আর এম দেবনাথ দাবি করেন, বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী সাড়ে ১৬ কোটি লোক ধরলে বছরে চাল লাগার কথা মাত্র ২ কোটি ২১ লাখ টন। অথচ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ৪৮ লাখ টন। হিসাব সঠিক হলে ওই সময় দেশে চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা ১ কোটি ২৭ লাখ টন। তার প্রশ্ন: এই উদ্বৃত্ত চাল গেল কই?
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জের (পিই) চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ ড. মাসরুর রিয়াজ জানান, তথ্যের অসঙ্গতি উন্নয়ন পরিকল্পনা ব্যাহত করে। তাই জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট হিসাবটি হওয়া উচিত অধিকতর গ্রহণযোগ্য। এক্ষত্রে হিসাব বের করার ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রযুক্তিনির্ভরতা বাড়াতে হবে। এর জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকেও শক্তিশালী করা দরকার।