গো মাংস ভক্ষণ কি হিন্দু ধর্মে নিষিদ্ধ? পর্ব ১
আপডেট: ২০১৬-০২-১২ ১২:১১:০৫
[গো মাংস ভক্ষণ করেছে এই সন্দেহে ভারতের উত্তর প্রদেশে পিটিয়ে হত্যা করা মোহম্মদ আখলাকের স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত]
নরেন্দ্র মোদীর হিন্দুত্ববাদী ভারতে গো হত্যা নিয়ে মানুষ ক্রমশ হিংস্র থেকে হিংস্রতর হয়ে উঠছে। কিন্তু হিন্দু ধর্মে বা হিন্দু সংস্কৃতিতে আদিকাল থেকে গোমাংস ভক্ষণ চলে এসেছে।
ঋকবেদে প্রায়শই বলদের মাংস রান্না করে দেবতাদের বিশেষত বৈদিক দেবতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার কথা উল্লেখ রয়েছে। ঋগ্বেদে উল্লেখ আছে, তিনি (ইন্দ্র) বলেছেন, “তারা আমার জন্য কুড়িটি অপেক্ষাও ১৫ টি অধিক রন্ধন করে।” অন্য জায়গায় বলা হচ্ছে যে “তিনি ষাঁড়ের মাংস, এক বা একশো মহিষের মাংস, বা অগ্নিপক্ক ৩০০ মহিষ, অথবা এক হাজার মহিষ ভক্ষন করেন।”
ঋকবেদে ইন্দ্রের পরেই গুরুত্বের দিক থেকে দ্বিতীয় হলেন অগ্নি যার সম্পর্কে ঋকবেদে ২০০ টি স্তোত্র রয়েছে। অগ্নি সম্পর্কে ঋকবেদ বর্ননা করা হয়েছে “যার খাদ্য হলো বলদ ও বন্ধ্যা গাভী”। ঋকবেদে এমন কিছুই নেই যা থেকে মনে হতে পারে যে, গবাদি বা অন্যান্য পশুর মাংসের প্রতি দেবতাদের বিরূপ মনোভাব ছিল। বরং, অশ্ব, ঋষভ, উক্ষন(বলদ), বশা( বন্ধ্যা গাভী) ও মেষ বলি দেওয়া হত তাঁদের উদ্দ্যেশে।
ঋকবেদে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ন দেবতা হলেন সোমদেব, যার নাম এসেছে মত্ততা সৃস্টিকারী এক পানীয়ের উৎস উদ্ভিদের নাম থেকে। এ কথা বলা হয় যে বৈদিক যজ্ঞ গুলির মধ্যে মৌলিক ও আদর্শ যজ্ঞের নিদর্শন হলো সোমের উদ্দেশে সাধিত যজ্ঞ, যাতে গবাদি পশু ও অন্যান্য প্রানী উৎসর্গ করার কথা উল্লেখ আছে। ঋগবৈদিক দেবতাদের খাদ্যসূচীতে বিশেষ বৈচিত্র্য নেই। দুধ, মাখন, যব, ব্লীর্বদ, ছাগ ও মেষ ছিল তাদের স্বাভাবিক খাদ্য , যদিও তাদের মধ্যে কারও নিজস্ব পছন্দ থাকত। যেমন, ইন্দ্র বিশেষ করে ষাঁড় পছন্দ করতেন এবং পথের রক্ষাকর্তা পূষন দন্তবিহীন হওয়ায় যা পেতেন তাই নরম মণ্ড করে খেতেন।
পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে যজ্ঞের বিস্তৃত বিবরন আছে ও প্রায়শই আচার অনুষ্ঠানে গবাদি পশু হত্যার উল্লেখ আছে এবং কেবল গোপথ ব্রাহ্মনেই একুশটি যজ্ঞের উল্লেখ রয়েছে। ইন্দ্রের উপদেশে একটি বৃষভ মরুৎদের উদ্দেশে একটি গরু এবং অশবিন্দের উদ্দেশে একটি তাম্রবর্ন গরু উৎসর্গ করা হয়েছিল। অধিকাংশ বারোয়ারি যজ্ঞেই ( যেমন, অশ্বমেধ, রাজসুত্র এবং বাজপেয়) নানা ধরনের পশুর মাংস, বিশেষত গরু/বলদ/ষাড়ের মাংস প্রয়োজন হত।
বৈদিক বারোয়ারি যজ্ঞগুলির মধ্যে প্রসিদ্ধতম হচ্ছে অশ্বমেধ যজ্ঞ, যার উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায় ঋকবেদে এবং ব্রাহ্মণগুলিতে যার সম্বন্ধে আলোচনা আছে, সেটিতে ৬০০-র অধিক পশু এবং পাখি নিহত হত এবং এটির অন্তিম পর্বে ২১ টি নির্জীবকৃত গরুকে বলি দেওয়া হতো, যদিও তৈত্তিরীয় সংহিতায় (৬.১১-২০) ঘোড়া , ষাঁড়, গরু, ছাগল, হরিণ, নীলগাইসহ ১৮০ টি পশু গননা করে দেখানো হয়েছে।
রাজসূয় ও বাজপেয় যজ্ঞগুলিতে গোসব (গো বলি) একটি গুরুত্বপূর্ন উপাদান ছিল। শতপথ ব্রাহ্মণে পরবর্তীকালে বলা হচ্ছে যে একটি নির্বীজকৃত ছিট ছিট দাগবিশিষ্ট গরুকে মরুৎদের উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়েছে। একই ভাবে, অগ্নিস্টোম যজ্ঞে একটি নির্বীজকৃত গরুকে বলি দেওয়া হতো। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ অনুসারে পঞ্চশারদীয়াসব (দর্শপুর্নমাস) যজ্ঞানুষ্ঠানের একটি গুরুতবপূর্ন অঙ্গ হল তিন বছরের সতেরটি কম বয়সী গাভীকে অগ্নিদগ্ধ করা। যেই অগ্নিদগ্ধ গাভী যজ্ঞকর্তা ভক্ষণ করবেন। যজ্ঞের আগের দিনে যজ্ঞকর্তা বন্য ফল মূল খেয়ে থাকতেন।
আদি ও পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য থেকে যজ্ঞে গো বলি প্রদানের যে ব্যাপক গুরুত্ব ছিল তাঁর বহু প্রমান রয়েছে। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে দ্যার্থহীনভাবে যজ্ঞে গো বলি উল্লেখ রয়েছে, যা খাদ্য হিসেবেই গ্রহন করা হতো, তাছাড়া অগস্ত্যকে একশত ষাঁড় বলি দেওয়ার জন্য প্রশংসা করা হয়েছে। ঐতয়ের ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে যে মানুষ , ঘোড়া, ষাঁড়,(বলদ) ছাগল ও ভেড়া বলিদানের যোগ্য প্রানী এবং কিমপুরুষ, গৌরমৃগ, গবয়, ঊট এবং শরভের (তরুণ হস্তী) মাংস যজ্ঞ-বলি উপযুক্ত নয় এবং তা খাওয়া উচিত নয়।
কেবল যজ্ঞানুষ্ঠান গুলিতেই নয়, দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ, ঘরোয়া অনুষ্ঠানেও গবাদি ও অন্যান্য পশু হত্যা করা হতো। পরবর্তী বৈদিক ও বৈদিকোত্তর গ্রন্থরাজিতে কৃষি ও অন্যান্য কাজকর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বহু আচার ও অনুষ্ঠানের উল্লেখ রয়েছে এবং তাদের কয়েকটিতে গবাদি ও অন্যান্য পশু হত্যা বাধ্যতামূলক ছিল। কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আচার গুলি—যে গুলির পরবর্তী বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে স্থায়ী রুপ নিতে শুরু করে—সেগুলির মধ্যে শলাকাবিদ্ধ ষাঁড় কে যজ্ঞে বলি দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে বেশ কিছু গৃহ্যসূত্রে। এই যজ্ঞে রুদ্রের জন্য একটি শলাকাবিদ্ধ ষাঁড়কে হত্যা করা হয়, তার লেজ ও চামড়া আগুনে নিক্ষেপ করা হয় এবং সাপেদের জন্য, তাঁর রক্ত ছড়িয়ে দেওয়া হয় কুশ বা দর্ভ ঘাসের ওপর। কৃষিকাজের উদ্ভব জন্ম দিয়েছিল স্থায়ী বসতির, যার জন্য আবাস নির্মানের বিশদ ও জটিল নিয়মাবলীর প্রেক্ষাপট তৈরী হয় যার উল্লেখ রয়েছে শাস্ত্রে। বহু নিয়মের মধ্যে অন্তত দুটি ছিল একটি কালো গরু বা সাদা ছাগল বলি দেওয়া।
পরবর্তী বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে শাস্ত্রে একটি আগ্রহ উদ্রেককারী আচারের কথা ক্রমাগত উল্লেখিত হচ্ছে যেটা অথিতিদের আপ্যায়নের সঙ্গে যুক্ত এবং সেটির নাম অর্ঘ্য। সেই অর্ঘ্য দেয়া হতো মধুপর্কের সাথে একটি গো বোধ করে। প্রাচীনকাল থেকেই অতিথিদের সন্মানে পশুহত্যা চলে এসেছে। ঋগ্বেদে অতিথিনীর্জা শব্দের উল্লেখ আছে যার অর্থ ব্যাখ্যা করা হয়েছে –অতিথিদের (খাদ্যের) পক্ষে উপযোগী গরু, এবং অন্তত একজন বৈদিক বীরের— অতিথিগব – নাম করা হয়েছে যে নামটির আক্ষরিক অর্থ হলো অতিথিদের জন্য গরু বধ। বিয়ের মত আনন্দনুষ্ঠানেও গরু হত্যা করা হতো। যেমন, একটি ঋক বৈদিকি স্তোত্রে বিবাহানুষ্ঠানে গো বধের উল্লেখ করা আছে, এবং পরবর্তীকালে ঐতরেয় ব্রাহ্মণে বলা হচ্ছে যে “ রাজা বা সন্মানীয় কোনো ব্যাক্তি অতিথি হয়ে এলে লোকে একটি ষাঁড় বা গরু হত্যা করে”। মধুপর্ক শব্দটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় জৈমিনিয় উপনিষদ-ব্রাহ্মণে এবং বেশ কয়েকটি গৃহ্যসূত্রে তা বিশদে আলোচনা করা হয়েছে। বিশেষ অতিথি যেমন, শিক্ষাগুরু, পুরোহিত, স্নাতক শ্বশ্রূপিতা, পিতৃকুল বা মাতৃকুলের গুরুজন বন্ধু ও রাজার সন্মানে এটি অনুষ্ঠিত হতো। তাদের অভ্যর্থনায় কেবল দই ও মধুর সংমিশ্রন (যা থেকে মধুপর্ক নামটি এসেছে) দেওয়া হতো না আরও গুরুত্বপূর্ন হলো একটি গরুকে ঝলসানো হতো বা অতিথিদের ইচ্ছানুসারে সেটিকে ছেড়ে দেওয়া হতো , যদিও কোনো অবস্থাতেই গোমাংস বা অন্য প্রকারের মাংস ছাড়া অনুষ্ঠান সম্পন্ন হতো না। বেশ কয়েকটি গৃহসূত্রে মধুপর্ক অনুষ্ঠানটির স্বাধীন বর্ননা রয়েছে বা বিবাহের অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসাবে তাকে বর্ননাকরা হয়েছে।পরবর্তী কালে পাণিনি অতিথি অর্থে গোঘ্ন শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
এমন অনেক ক্ষেত্রে গবাদি পশু হত্যা করা হতো যা আমাদের কাছে তুচ্ছ কারণ বলে মনে হয়। দীর্ঘজীবী পুত্র সন্তান লাভের আশায় কোনো ব্যাক্তি ঔপনিষেদিক নিদান অনুযায়ী ( ভেড়া গরু বা অন্য প্রানীর মাংস ঘি ভাত সহযোগে খেতেন, এমনকি জন্মের ছয় মাস পরে সেই শিশুটিও পাখির ( যেমন ভারদ্বাজি, তিত্তির কৃককস ইত্যাদি) মাংস ও মাছ খেতে পারত।
গবাদি পশু হত্যার রীতি মৃতের সৎকারের ক্ষেত্রেও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। যেমন, সৎকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি ঋগ বৈদিক স্তোত্রে একটিতে মৃতদেহ আচ্ছাদনের জন্য গোচর্ম ও চর্বি ব্যবহারের উল্লেখ আছে, এবং অথর্ববেদের এক স্থানে একটি ষাঁড়ের কথা বলা হয়েছে যেটিকে সম্ভবত মৃতের সঙ্গে দাহ করা হচ্ছে যাতে সেটি স্বর্গযাত্রা করতে পারে।
পুত্র সন্তানের জন্ম অথবা পুত্র বা কন্যার বিবাহ প্রভৃতি আনন্দানুষ্ঠানের শুরুতে অন্যান্য পশু ছাড়াও গরু বা ষাঁড় বা উভয়ই শ্রাদ্ধে বলি দেওয়া হতো, যেখানে আভ্যুদায়িক ( নান্দিমুখ ও বলা হয়) করা হতো পূর্বপুরুষদের আত্নাকে খুশী করার জন্য। আরেক ধরনের শ্রাদ্ধ, যাকে বলা হতো অষ্টকা বা একাষ্টকা, এবং যেগুলির সম্পর্কে গৃহসূত্র গুলিতে বিশদ আলোচনা আছে, যেগুলির ক্ষেত্রে গোহত্যার কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। এ কথা বলা হয়েছে যে অষ্টকা পালনকারী ব্যাক্তি বলির জন্য গরুটিকে প্রস্তুত করেন এবং রান্না করা মেদচ্ছদটি পূর্বপুরুষের আত্মার উদ্দেশে উৎসর্গ করেন ।
শ্রাদ্ধের মতোই আন্যান্য অনুষ্ঠানেও গবাদি পশু বলি দেওয়া হতো সমাজের সকলের জন্য।যেমন, ব্রাহ্মণদের দ্বারা পালিত গবাময়ন নামক বৎসরের একটি নির্দিষ্ট সময়ের যজ্ঞানুষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য ছিল পশুবলি। এটির পরিসমাপ্তি ঘটতো এক জাঁকজমকপূর্ণ মজাদার উৎসব মহাব্রত পালনের মাধ্য দিয়ে, যেখানে মিত্রাবরুণ ও অন্যান্য দেবতাদের উদ্দেশে তিনটি বন্ধ্যা গাভী উৎসর্গ করা হতো। এই খুশী- মজা-হুল্লোড়ের উৎসবটির শাস্ত্রীয় বর্ণনা থেকে মনে হয় যে আরও অনেক বেশি গবাদি পশু বলি দেওয়া হতো। একইভাবে, বিভিন্ন শ্রৌতসূত্র গুলিতে আলোচিত এবং পূর্বেকার ও পরেকার আচারগুলির সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত গৃহমেধ অনুষ্ঠানটি ছিল এক ধরনের প্রাচুর্য ময় সামাজিক ভোজের অনুষ্ঠান যেখানে কঠোরভাবে আচারগত বিধিনিষেধ না মেনেই নৃশংসভাবে ও অপবিত্রভাবে অসংখ্য গরু হত্যা করা হতো।
একটি ধর্মসূত্র অনুসারে গরু ও ষাঁড়ের মাংস পবিত্র এক তা খাওয়া যেতে পারে। সুতরাং, একটি বিস্ময়কর নয় যে মিথিলার অত্যন্ত শ্রদ্ধের ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যের প্রিয় খাদ্য ছিল গোমাংস। বলা হয়, তিনি এই বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন যে গরু ও ষাঁড়ের মাংস ভক্ষণ করবেন, ততদিন, যতদিন তা নরম (অংসল) থাকবে।
অনেকগুলি প্রামাণিক সূত্রের সাক্ষ্য অনুযায়ী গোমাংসসহ অন্যান্য গবাদি পশুর মাংস সাধারণভাবে আইনসংগত খাদ্য ছিল। একটি শাস্ত্র অনুসারে ষাঁড়ের মাংস উৎসর্গ করার উপযুক্ত, আরেকটি শাস্ত্র অনুসারে “ধর্মের কারণে বলিদত্ত পশুদের” পুরোহিতগণ ও অন্যান্য ব্রাহ্মণরা উভয়েই খেতে পারে।
বলিদত্ত গরু সাধারণ মানুষ ও তাদের পুরোহিতদের খাদ্য জোগায়, এবং শতপথ ব্রাহ্মণ দ্বিধাহীনভাবে জানাচ্ছে যে “মাংসই শ্রেষ্ঠ খাদ্য।
বিস্তৃত সময়কালে গরুসহ গবাদি পশু হত্যার বিষয়টি প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক উপকরণ দিয়ে সমর্থিত। ভারতের প্রখ্যাততম প্রত্নতত্ত্ববিদ প্রয়াত এইচ.ডি.সাংকালিয়া’র মতানুসারে এক লক্ষ বছর থেকে দশ হাজার বছর পূর্বের প্লিস্টোসিন যুগের সমগ্র সময়কাল জুড়ে “অন্যান্য যে কোনো পশুর তুলনায় গরু/ বলদের হাড় অনেক বেশি করে এবং বেশি স্থানে নদী ও অন্যান্য সঞ্চয়স্থলে আবিষ্কার করা গেছে।”
খননকার্য থেকে পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে হরপ্পা সভ্যতার সৃষ্টিকর্তারা গবাদি পশুর মাংস খেত যার যার সপক্ষে প্রাসঙ্গিক প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণ ছড়িয়ে আছে সিন্ধু প্রদেশ, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, কচ্ছ, সৌরাষ্ট্র এবং তটবর্তী গুজরাটে। হরপ্পা সাংস্কৃতিক এলাকার বাইরে প্রচুর পরিমাণে প্রাণীজ অবশেষে পাওয়া যায় যেগুলি তাম্রপ্রস্তর যুগের খাদ্য-সংস্কৃতির প্রতি দিক নির্দেশ করে, যা গোমাংসসহ গবাদি পশুর বলে চিহ্নিত হয়ে আছে।
এই ধরনের সাক্ষ্য প্রমাণ আরো ভালোভাবে পাওয়া গেছে অত্রঞ্জিখেরা (এটা জেলা) অঞ্চলে, যেখানে প্রাপ্ত মোট দগ্ধ অস্থি-অবশেষের সংখ্যা ৯২৭। এর মধ্যে ৬৪ শতাংশ গরুর হাড়, সেগুলি প্রায়শই কাটা দাগবিশিষ্ট এবং খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকের। সুতরাং, এটা অনুমান করা অসঙ্গত নয় হিন্দুদের কাছে গোমাংস একটি পছন্দসই খাদ্য ছিল।
হরিয়ানার ভগবানপুর (মহাভারতের কুরুক্ষেত্র) অঞ্চলে গবাদি পশুর পোড়া হাড় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গেছে। পাঞ্জাবে রোপার এলাকায়র পরবর্তী পর্যায়ের চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতির যুগের (৬০০-২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বসতিগুলিতে সম্প্রতি গৃহপালিত গবাদি পশু মহিষ, ভেড়া, ছাগল, সুকর,ঘোড়া,কুকুর, মুরগি, কচ্ছপ ও চিতলহরিণের হাড় মিলেছে; যেগুলিতে কাটা দাগ ও পুড়ে যাওয়ার চিহ্ন রয়েছে। যার অর্থ হলো মানুষের খাদ্যের প্রয়োজনে এরা ব্যবহৃত হতো। কৌতূহলের বিষয় হলো , গবাদি পশুর রক্ষাকর্তা কৃষ্ণের নাম-জড়িত মথুরার দ্বিতীয় পর্যায়ের মানব বসতি (আনুমানিক ৪০০-২০০খ্রিস্টপূর্বাব্দ ) থেকেও এই ধরনের সাক্ষ্য-প্রমাণ মিলেছে।
মহাকাব্যের সাক্ষ্যপ্রমাণও এ বিষয়ে দ্ব্যর্থহীন। মহাভারতের অধিকাংশ চরিত্রই মাংসভোজী। রাজা রন্তিদেব, যার রন্ধনশালায় দৈনিক দুই হাজার গরু জবাই করা হতো এবং তার মাংস ও শস্যদানা ব্রহ্মণদের মধ্যে বিতরণ করা হতো, সেই ঘটনা প্রশংসাসূচকভাবে মহাভারতে বর্ণিত হয়েছে। বনবাসে দ্রৌপদির বন্ধনশালায় মোষের মাংস থাকতো।
ভারতীয় চিকিৎসক চরক (খ্রিস্টিয় ১ম-২য় শতক), সুশ্রুত (খ্রি. ৩য়-৪র্থ শতক) ও বাগভট্ট (খ্রি. ৭ম শতক)নানা ধরনের মাছ ও মাংসের এক চিত্তাকর্ষক তালিকা দিয়েছেন এবং এরা তিনজনেই রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে গো-মাংসের ব্যবহার সম্পর্কে মন্তব্য করছেন। প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম-নিরপেক্ষ সাহিত্যেও অনেককাল পরে পর্যন্ত গবাদি পশু ও অন্যান্য পশুর মাংস খাওয়ার নিদর্শন রয়েছে।
এইভাবে, নবম শতক থেকে ধর্মশাস্ত্রের ভাষ্য ও ধর্মীয় সংহিতাগুলির রচয়িতারা গোমাংস ভক্ষণের প্রাচীন প্রথার স্মৃতিকে জাগরূক রেখেছেন এবং তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বিশেষ পরিস্থিতিতে গরুর মাংস খাওয়াকে অনুমোদন করেছেন। যেমন, মেধাতিথি (৯ম শতক), যিনি সম্ভবত একজন কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ ছিলেন, বলেছেন যে কোনো রাজা বা অন্য কোনো সম্মানীয় ব্যক্তির সম্মানে একটি ষাঁড় বা বলদ হত্যা করা হত,এবং তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে আচার অনুষ্ঠানে গোমাংস ভোজন (গোব্যজমাংসম) অনুমোদন করেছেন।
ধর্মশাস্ত্রের টীকা- ভাষ্য রচয়িতারা খ্রিস্টিয় নবম শতক এবং তার পরেও গো-মাংস ভোজনের স্মৃতি সদা জাগরূক রেখেছেন এমকি তাঁদের কয়েকজন বিশেষ ক্ষেত্রে গো-মাংস খাওয়া অনুমোদনও করেছেন। মালবের জনৈক ব্রাহ্মণ বিশ্বরূপ (৯ম শতক), যিনি সম্ভবত শঙ্করের শিষ্য ছিলেন; আধুনিক কর্ণাটকের কল্যাণের নিকটবর্তী স্থানের অধিবাসী বিজ্ঞানেশ্বর (১১শ শতক); আরেকজন দক্ষিণী (দাক্ষিণাত্য) হরদত্ত (১২ শতক); গহরবাল রাজার জনৈক মন্ত্রী লক্ষ্মীধর (১২শ শতক); দেবগিরির যাদবদের একজন মন্ত্রী হেমাদ্রি (১৩শ শতকের শেষার্ধ); সম্ভবত দক্ষিণ ভারতের লোক নরসিংহ/নৃসিংহ (১৪শ শতক) এবং গোপাচলের (গোয়ালিয়র) মিত্র মিশ্র (১৭ শ শতক) প্রাচীন যুগে অতিথি-আপ্যায়ন ও শ্রাদ্ধের মতো কোনো অনুষ্ঠানে গোহত্যার প্রথাকে সমর্থন দিয়েছেন। সম্প্রতি ২০শ শতকে মিথিলার মদন উপাধ্যায় সুপ্রাচীন কালে আচার অনুষ্ঠানে দুগ্ধবতী গাভী হত্যার নিদর্শন ধরেছেন।
তাহলে বর্তমানে হিন্দু ধর্মে গো হত্যা কেন নিন্দনিয়? সেই তত্ত্ব তালাশ করা হবে পরবর্তী পর্বে।
(সংকলিত। রেফারেন্স সমুহ পরবর্তীতে যুক্ত করা হবে)
লেখক: চিকিৎসক, গবেষক