রেলের ইতিহাসে বড় প্রকল্প : পদ্মা সেতুর সংযোগে ব্যয় ৩৪ হাজার কোটি টাকা
প্রকাশ: ২০১৬-০১-০২ ২২:২১:২২
পদ্মা সেতু প্রকল্পের চেয়ে পদ্মা রেললিংক নির্মাণ ব্যয় আরো বেশি বলে জানিয়েছেন রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। রেলের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে বড় প্রকল্প। ঢাকা-ভাঙ্গা ও ভাঙ্গা-যশোর রেললিংক বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা। আর পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এ রেলপথটি সম্পন্ন হলে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত দূরত্ব হবে মাত্র ১৬৬.৩৩ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে যশোর যেতে সময় লাগবে মাত্র সাড়ে ৩ ঘণ্টা। রেললিংক লাইন বাস্তবায়ন করতে গে-ারিয়ার পর থেকে বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীর উপর প্রায় ১৯ কিলোমিটার এলিভেটেড রেলপথ নির্মাণ করা হবে। নির্মাণ করা হবে ৪০টি আন্ডারপাস সেতু ও ৩টি ওভারপাস, যা রেলওয়েতে এই প্রথম।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন থেকেই বিভিন্ন সড়কযানের পাশাপাশি ট্রেনও চলবে এমন চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে রেলপথ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তথা সংশ্লিষ্টদের তাগিদ দিয়েছেন। সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক জরুরি বৈঠক ডেকে এমন তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রকল্পটি ঐতিহাসিক উল্লেখ করে রেললিংক লাইন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক সাগর কৃষ্ণ চক্রবর্তী জানান, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগের পরিকল্পনা এখন চূড়ান্ত। সেতু উদ্বোধনের দিন থেকেই চলবে ট্রেন। আগামী মার্চে নির্মাণকাজ পুরোদমে শুরু হয়ে ২০১৮ সালের মধ্যে রাজধানীর গে-ারিয়া থেকে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া হয়ে পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটার এ রেলপথ প্রকল্পের ফেইজ-১-এর নির্মাণকাজ শেষ হবে। দ্বিতীয় ফেইজে ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত নির্মাণ লাইন নির্মাণ ২০২১ সালে শেষ হবে। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শেষ হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক-চতুর্থাশ জনগোষ্ঠী ও দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিপুল অবদান রাখবে। রেলওয়েতে আমূল পরিবর্তন আসবে।
শুরুতে পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগের অর্থায়নের বিষয়টি নিয়ে অনিশ্চিত ছিল রেল বিভাগ। পরে গত বছরের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেল মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে এসে দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে রেলওয়ের আওতায় আনার জন্য পদ্মায় সংযোগ ও রেলওয়ের চারটি জোন করার নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশনায় পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প-১ ও প্রকল্প ২ নামের প্রকল্প গ্রহণ করে রেল কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে চায়না সরকার থেকে ১৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সহায়তা পাওয়া গেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে দক্ষিণ-পশ্চিমের ২১ জেলার মানুষ নতুন করে রেলসেবার আওতায় আসবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্প-১-এর আওতায় রাজধানীর গে-ারিয়া থেকে বুড়িগঙ্গা নদীর উপর দিয়ে মাওয়া হয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ দশমিক ৩২ কিলোমিটার এই রেলপথ নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু পর্যন্ত ৪৪ দশমিক ৩২ কিলোমিটার, সেতুর উপর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার, সেতু সংলগ্ন দুপাশে ৪ কিলোমিটার ও সেতু থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৩১ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার লাইন নির্মাণ করা হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ভাঙ্গা-নড়াইল-যশোর পর্যন্ত ৯৬ কিলোমিটার লাইন নির্মিত হবে। এ রেলপথে ১২০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চলাচল করতে পারবে। প্রথম ফেইজে মোট ১২৫টি ছোট-বড় রেলসেতু নির্মাণ করতে হবে। দ্বিতীয় ফেইজে নতুন ৮টি রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ করা হবে।
প্রকল্প সূত্রে আরো জানা যায়, বুড়িগঙ্গা এবং ধলেশ্বরী নদীতে নৌচলাচলের জন্য পর্যাপ্ত ক্লিয়ারেন্স দেয়ার লক্ষ্যে গে-ারিয়ার পরে ১৬.৭৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড রেলপথ এবং দুই প্রান্তে ২.২০ কিলোমিটার র্যাম্প নির্মাণসহ মোট ১৯ কিলোমিটার এলিভেটেড রেলপথ নির্মাণ করা হবে, যা রেলওয়েতে এই প্রথম। এছাড়া পদ্মা সেতুর দুপাশে সেতু কর্তৃপক্ষ ০.৫৩ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট নির্মাণ করবে। নবনির্মিত রেলপথ এবং সকড়পথে পৃথক লেভেল করার লক্ষ্যে ৪০টি আন্ডারপাস সেতু এবং ৩টি ওভারপাস নির্মাণ করা হবে। এছাড়া মোট ৩৬০ হেক্টর জমির মধ্যে ৮৬.২৭ হেক্টর সড়ক ও জনপথ থেকে, ১৮.৬৯ হেক্টর সেতু কর্তৃপক্ষ এবং ১০.২৭ হেক্টর সরকারি জলমহাল থেকে পাওয়া যাবে। অবশিষ্ট ২৪৫.৭২ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে।
সেতু উদ্বোধনের দিন থেকেই চলবে ট্রেন এমন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে রেলপথমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক জানান, বর্তমান সরকার উন্নয়নে বিশ্বাসী। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত রেললিংক নির্মাণ ইতিহাস হয়ে থাকবে। রেলওয়েতে চলমান ৪৬টি উন্নয়ন প্রকল্পসহ নতুন এ রেললিংক প্রকল্পটির কাজ শেষ হলে রেলওয়েতে আমূল পরিবর্তন আসবে। ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি পদ্মা সেতুর সংশোধিত প্রকল্পে রেলপথ সেতুর নির্মাণের নকশা চূড়ান্ত করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ইচ্ছায় পদ্মা সেতু দিয়ে রেল সংযোগ স্থাপন সম্ভব হচ্ছে জানিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে তার মন্ত্রণালয়ের পক্ষে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
রেলপথ সচিব ফিরোজ সালাহ উদ্দিন জানিয়েছেন, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকেই রেললিংক লাইন স্থাপনের কাজ পুরোদমে শুরু হবে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন থেকে সকড়যানের পাশাপাশি ট্রেন চলাচল নিশ্চিত করতে তিনিসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ডেকে নির্দেশ দেন। তিনি বিশেষ তাগিদ দিয়ে বলেন, একই দিন পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে সড়কযানের পাশাপাশি ট্রেনও চলবে। ডিপিপি অনুমোদনের আগে ভূমি অধিগ্রহণ এবং পরামর্শক নিয়োগের ইওআই (এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট) আহ্বানের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে। তিনি বলেন, দ্রুত কাজ সম্পন্ন করার জন্য পদ্মা সেতুর উভয় পাশে ৪টি ভাগে কাজ শুরু করা হবে। পদ্মা সেতুর উত্তোলনকৃত বালু রেলপথ তৈরিতে ব্যবহার করা হবে। রেললিংক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে জিটুজি ভিত্তিতে। এজন্য চীনের মনোনীত চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের সঙ্গে নেগোসিয়েশন চূড়ান্ত হয়েছে। কমার্শিয়াল কনট্রাক্ট প্রস্তাব অর্থসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে (সিসিইএ) দ্রুত পাঠানো হবে। পরে যথাক্রমে একনেকে পাঠানো হবে অনুমোদনের জন্য।
রেলওয়ে মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন বলেন, ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা-যশোর পর্যন্ত নতুন রেললাইন স্থাপনের কাজ রেলওয়ের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন প্রকল্প। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে রেলপথ মন্ত্রণালয় তথা সংশ্লিষ্টরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর সকড়যানের পাশাপাশি ট্রেনও চলবে। একই দিন থেকে সকড়যান ও ট্রেন চলাচল করবে পদ্মা সেতু দিয়ে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সারাদেশের সঙ্গে নতুন করে আরো ২১টি জেলা সংযোগ হবে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে।