মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম:
ছুটি মানেই ঘোরাঘুরি। আর যদি তা হয় দীর্ঘ, তাহলে আর পায় কে? সোজা দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ’র দামালেরা চলে যায় নেটওয়ার্কের বাহিরে। সেরকমই এক মোক্ষম সুযোগে, চলে গিয়েছিলাম সুন্দরবনের গহিনে। প্রথমে বাসে চেপে ঢাকা-রায়েন্দা। এরপর শরণখোলা রেঞ্জের স্টেশন অফিস। স্থানীয় গাইড বন প্রবেশের যাবতীয় সরকারী নিয়মাবলী, অনেকটাই সেরে রেখেছিলেন। ফলে স্বল্প সময়ের মধ্যেই, সুন্দরবন প্রবেশের অনুমতি মিলে যায়।
১৮ জনের জন্য প্রায় ৫০জন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন বোটে চড়ে, শুরুতেই চলে গেলাম তেরাবেকা ফাঁড়িতে। নামের সঙ্গে তেরাবেকার স্থাপনা গুলোর যেন মিল রয়েছে। সেখানে কিছুটা সময় চলল ফটোস্যুট। এরপর বলেশ্বর নদীর নির্মল হাওয়া। বোট চলতে চলতে, বগি স্টেশন পাশ কাটিয়ে সুপতি খালে ঢুকে। বোটে বসেই খালের দুপারের নয়নাভিরাম দৃশ্যে চোখ আটকায়।
আরও দেখি বাঘ,কুমির আর বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে জেলেদের মাছ ধরার কঠোর মেহনত।সেই সঙ্গে ইলিশের শেষ নিশ্বাস ত্যাগের লম্পঝম্প। দেখতে দেখতে ভ্রমণ অভিজ্ঞতা’র ঝুলি ভারি হতে থাকে। মধ্য দুপুর গড়িয়ে বোট কচিখালী অভয়াণ্যের ভিতরে, বয়ে যাওয়া খাল দিয়ে এগুতে থাকে।
একটা সময় খালের দুপাশে সুন্দরী আর কেওড়া গাছের ফাঁকে, চোখ পড়তেই বিস্ময়ে সবাই অবাক। হরিণের পাল আপন মনে ঘুরে বেড়ায়। কোন কোন গাছতলায় নির্ভীক মায়াবি নয়নে, সিং ওয়ালা হরিণীর একাকি দাঁড়িয়ে থাকার দুর্লভ দৃশ্য। গাছে গাছে সাদা বকের ঝাক আর ধনেশ পাখির অবাধ বিচরণ,আমাদেরকে নির্বাক করে। অসাধারণ সব মূহুর্ত কাটে, সুপতি খালের ভিতর গোলপাতার হাওয়ায়। সত্যি বলতে সুন্দরবনের আসল সৌন্দর্য,খালের ভিতর দিয়ে ঘুরলেই দেখা সম্ভব।
যেতে যেতে বেলা প্রায় সাড়ে তিনটা। বোট গিয়ে থামে বঙ্গোপসাগরের কুল ঘেঁষা ডিমের চরে।বাঘ আর বৃষ্টিতে ভেজার ভয়ে, দু-চারজন বাদে আর সবাই নেমে যাই চরে। চার নাম্বার আবহাওয়া সংকেতের কারণে, এলোমেলো বাতাসের সঙ্গে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। প্রতিকূল প্রকৃতি অনুকূল ভেবেই, হেঁটে হেটেঁ ডিমের চরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখি। সুন্দরবনে বাঘ মামা’র শিকার ধরার পজিশন নেয়ার সুবিধাজনক স্থান, ছনের বাগানেও ঢুকে পড়ি। ভয়কে জয় করাই দে-ছুট এর দামালদের অহংকার। ছন বাগানে তখন একটি গানের লিরিক মনে পড়ে যায়, পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না। আমরা হয়তো তেমনি এক পাগল। হা হা হা! ইচ্ছেমত বাঘের ঘরে ছবি তুলে, পক্ষির চরের দিকে আগাতে থাকি। ডিমের চরের একপাশে ঘনবন আরেক পাশে উত্তাল সাগর।
উম্মাদ ঢেউ আছড়ে পড়ে যুগল পা’য়ে। হাঁটতে হাঁটতে পক্ষির চর। জায়গাটা কেমন যেন ভৌতিক। মরা গাছের গোড়া গুলো যেন, একেকটা ফসিল। তবে শতশত গাঙচীল আর বকের উড়াউড়ি’র মনোমুগ্ধকর দৃশ্য, বাঘের ভয় আর ভ্রমণ ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে নিমিষেই। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে, পাগলা হাওয়ার মাত্রাও বাড়তে থাকে। তাই আর দরেী না করে বোটে উঠে পড়ি। ছিড়া কটকা পেরুতে পেরুতে রাত নেমে এলো। তাই বড় কটকার এক সুবিধাজনক খালে সারেং নোঙ্গর ফেলল। আজকের রাতটা কাটবে এখানেই।
পরদিন সকালে বড় হোমরা হয়ে বেতমোর নদীতে ভাসলাম। ভাসতে ভাসতে জোয়ারে খেজুরা ভারানী হয়ে শেলা নদীর বুকে, জেগে থাকা নামমহীন এক চরে বোট বাধঁল। যা আগেভাগেই জানিয়ে রেখেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত বনবিভাগের কর্মকর্তা জনাব আবুল কালাম আজাদ। তিনি সহ আমরা চরটিতে নামলাম।তার ভাষ্যমতে পর্যটক হিসেবে দে-ছুট এর ভ্রমণ বন্ধুরাই নাকি প্রথম করল অবতরণ। স্বাভাবিকভাবেই মনের মাঝে বেশ উত্তেজনা। চরের পরিবেশ নিরব, নিস্তব্দ। পাতা ঝড়ার শব্দ পর্যন্ত শোনা যায়। সুন্দরী,কেওড়া,বাইন ও খলশি ইত্যাদি গাছ সহ গোলপাতার গাছে ভরা। মাটি ফুড়ে দন্ডায়মান শ্বাসমূল। এই চরের শ্বাসমূল গুলো কিছুটা ভিন্নরকম। যা দৃষ্টি কেড়ে নেয় সহজেই। চঞ্চলা হরিণের দল ছুটে বেড়ায়। চরটির চারপাশ নয়নাভিরাম নৈসর্গিক সৌন্দর্যে টইটুম্বুর। যা যেকোন নিরস মনের মানুষকেও পুলকিত করবে। ভ্রমণে করে তুলবে আগ্রহী।
এরকম একটি চরের নাম থাকবে না তা কি করে হয়। কিন্তু কেন কি কারণে এখনো পর্যন্ত, এই চরের নাম কিংবা পর্যটকদের পা’ পড়েনি তা বুঝে আসেনি। তাই কালাম সাহেবের অনুরোধে দে-ছুট এর পক্ষ হতে চরটির নাম দেয়া হল সুনসান চর। সুন্দরবনে সুনসান চরের অবস্থান কুকিল মনি ক্যাম্পের পূর্বে আর টিয়ার চর হতে উত্তরে। সুনসান চরটির প্রতি সরকার দৃষ্টি দিলে,নিশ্চিত সুন্দরবন ভ্রমণ পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় জায়গায় পরিণত হবে।
এরপর রওনা দেই কুকিল মনি ক্যাম্পের দিকে। যেতে যেতে টেলিটকে, চলে আসে নেটওয়ার্ক। ততোক্ষণে সারা দেশ মহা উদগ্রীব, আবহাওয়া বার্তা ১০নাম্বার মহা বিপদ সংকেত।সুন্দরবনের উপর দিয়েই নাকি বিকাল ৫টায় প্রথম আঘাত হানবে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। অথচ আমরা কিন্তু সেই বনের গভীরেই, দিব্যি খাইদাই ঘুরি। তবুওত বিপদের আশংকা থেকেই যায়। তাই আর দেরী না করে, সারেং বোট ঘুরিয়ে ছুটে রায়েন্দা। বিকাল যখন পাচঁটা, তখনো আমরা ফিরতি পথে নদীতে ভাসি। আলহামদুলিল্লাহ সবাই ছিলাম নিরাপদ। তখনও বুলবুল এসে পৌঁছায়নি।
সাংবাদিক ও লেখক মার্ক টোয়েন বলেছেন,“আজ থেকে বিশ বছর পর আপনি এই ভেবে হতাশ হবেন যে,আপনার পক্ষে যা করা সম্ভব ছিল তা করতে পারেন নাই।তাই নিরাপদ আবাস ছেড়ে বেরিয়ে পড়–ন।আবিষ্কারের জন্য যাত্রা করুন,স্বপ্ন দেখুন আর শেষমেশ আবিষ্কার করুন।” অথচ এবার ভ্রমণ সঙ্গী বেশী হবার কারণে, দুর্যোগের ভয়ে দে-ছুট এর স্বভাব বিরুদ্ধ ভ্রমণকালীন সময় কমিয়ে, নিরাপদ আবাসের পথ ধরতে হল। যা সব মিলিয়ে স্মৃতির ভান্ডারে, অসমাপ্ত এক রোমাঞ্চকর দুঃখজনক ভ্রমণ গল্প হিসেবেই গেঁথে থাকবে।
যাবেন কিভাবেঃ ঢাকার সায়েদাবাদ হতে বাগেরহাট শরণখোলার রায়েন্দা। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত, বিভিন্ন পরিবহনের বাস সার্ভিস রয়েছে।
থাকা-খাওয়া ও অনুমোদনঃ থাকা-খাওয়া বোটেই। তাই প্রয়োজনিয় বাজার-সদাই, বিশুদ্ধ পানি নিয়েই বোটে উঠতে হবে। রায়েন্দা হতে বোট/ভেসেল ও সুন্দরবন প্রবেশের জন্য সরকারি বিভিন্ন কার্যক্রম আগেই ঢাকা হতে সম্পাদন করে যাবেন। গুগোল সার্চে সুন্দরবন ভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম মিলে যাবে।
টিপস# সুন্দরবন ভ্রমণে বোট,জনপ্রতি ও নিরাপত্তা রক্ষীর জন্য বনবিভাগের নিয়মাবলী অনুসরণ মোতাবেক, রেভ্যিনিউ পরিশোধ বাধ্যতামূলক।
#ভ্রমণের পূর্বে অবশ্যই যাচাইবাছাই করে নিন,যথাযথ ভাবে বনবিভাগের অনুমোদন রয়েছে কিনা।