করোনায়ও কৃষিখাতে চমক: বেড়েছে কৃষিঋণ আদায়
:: আপডেট: ২০২১-০৩-১৮ ১৯:২৪:২৫
মহামারী করোনাভাইরাসে গেল অর্থ-বছরে দেশের প্রতিটি খাতের ন্যায় কৃষি খাতেও বড় ধরণের প্রভাব পরে। যার ফলে কৃষকরা কৃষি ঋণ নিয়ে ফসল ফলাতে অনেকটা দিধান্বিত ছিল। এ কারণে গত অর্থ-বছরে কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। মূলত করোনার প্রকোপের কারণেই কৃষিঋণ বিতরণ ব্যাপকহারে কমে গিয়েছিল।
তবে চলতি অর্থ-বছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) কৃষিঋণ বিতরণ ব্যাপকহারে বেড়েছে। এ ৮ মাসে ১৬ হাজার ১৮০ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। আগের অর্থ-বছরের একই সময়ে বিতরণের পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৯২ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ঋণ বিতরণ বেড়েছে।
এদিকে করোনার মধ্যেও কৃষিঋণ আদায় বেড়েছে। এ সময়ে ১৭ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। আগের বছরের স্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে আদায় হয়েছিল ১৫ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে গত আট মাসে ১ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা বেশি আদায় হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, অর্থ-বছরের প্রথম আট মাসে কৃষি খাতে মোট বিতরণ হওয়া ঋণের মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলো ৭ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। আর ৮ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা বিতরণ করেছে বেসরকারি ও বিদেশি মালিকানার ব্যাংকগুলো।
চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) ২৬ হাজার ২৯২ কোটি টাকা ঋণ বরাদ্দ রেখেছে ব্যাংকগুলো। যা গত অর্থ-বছরের চেয়ে ৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ বেশি। ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক ঋণ বিতরণ করবে ১১ হাজার ৪৫ কোটি টাকা এবং বেসরকারি ও বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে ১৫ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা।
করোনার প্রাদুর্ভাবে দেশের সবখাতে বিরাট প্রভাব পরলেও কিছুটা হলেও সচল ছিল দেশের কৃষি খাতের উৎপাদন। তাই মহামারিতে ঋণ বেশি প্রয়োজন ছিল কৃষকের। কিন্তু ব্যাংকগুলো তাদের সঠিক সময় ঋণ সহায়তা দেয়নি। ফলে প্রথমবারের মতো কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়। এরপর সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংকের চাপে ব্যাংকগুলো আবার কৃষিঋণ বিতরণ শুরু করে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী সরকারি বণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ১১ হাজার ৪৫ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার ৭ হাজার ৩৩১ কোটি ৯২ লাখ টাকা বিতরণ করেছে যার শতাংশ হিসেবে ৬৬দশমিক ৩৮ শতাংশ। সরকারি এ ব্যাংকগুলোর মধ্যে টার্গেটের ৩০ শতাংশও সম্পন্ন করতে পারেনি দুটি ব্যাংক। ব্যাংক দুটি হলো বেসিক ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংক। এর মধ্যে বেসিক ব্যাংক ১৫০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে মাত্র ২৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। রূপালী ব্যাংক ৪০০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার গত আট মাসে বিতরণ করেছে ৮৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা। দুটি ব্যাংক শতাংশ হিসেবে যথাক্রমে ২৬.৮৫ % ও ২০.৮৫%।
সরকারি বাকি ৬ টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে কৃষিখাতের উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ৬ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৪ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। যার শতাংশ হিসেবে ৭২.৮৯%। অগ্রণী ব্যাংক ৬৮০ কোটি টাকার মধ্যে ৩৬৭ কোটি টাকা, বাংলাদেশ ডেভলেপমেন্ট ব্যাংক ১৫ কোটি টাকার ১৪.১৭ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংক ৭৫০ কোটি টাকার ৩৯৯ কোটি টাকা, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ১ হাজার ৮৫০ কোটি টাকার মধ্যে ১ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা, সোনালী ব্যাংক ১২ শত কোটি টাকার মধ্যে ৭১৮ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। এই ব্যাংকগুলো শতাংশ হিসেবে ৭২.৭৯%, ৫৩.৯৯%, ৯৪.৪৭%, ৫৩.৩০%, ৭২.৪৮%, ৫৯.৯১ শতাংশ।
এছাড়া বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বৈদেশিক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ১৫ হাজার কোটি টাকা লক্ষমাত্রার ৮ হাজার ৮৪৮ কোটি কোটি টাকা বিতরণ করেছে যার শতাংশ হিসেবে ৫৮.০৪ শতাংশ। কৃষিখাতের বিতরণকৃত এ ঋণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিতরণ করা হয়েছে শস্য খাতে। এ খাতে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ৮ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা এরপরে বিতরণে এগিয়ে রয়েছে পশু ও পোল্ট্রি ফার্মে। এতে ২ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি ও বৈদেশিক ব্যাংকগুলো কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ করেছেন ১৫ হাজার ৯২ কোটি টাকা। তবে কৃষকের ঋণের টাকার খেলাপিও রয়েছে বড় অঙ্কের। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযাই মোট কৃষিতে বিতরণকৃত ঋণের ৯.৯৩ শতাংশ খেলাপি রয়েছে। যার টাকার হিসেবে ৪ হাজার ৩০২ কোটি টাকার। তারমধ্যে সরকারি ৮টি ব্যাংকের ৪ হাজার ১৭ কোটি টাকা যা শতাংশ হিসেবে ১২.৫৩%। এছাড়া বেসরকারি ও বৈদেশিক ব্যাংকগুলোতে ২৮৫ কোটি টাকা খেলাপি রয়েছে যার শতাংশ হিসেবে ২.৫৩ শতাংশ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, চলতি অর্থ-বছরের আটমাসে কৃষিখাতে লক্ষমাত্রার ৬১.৫৪ শতাংশ বিতরণ করলেও অর্থবছরের শেষে অনেকটাই পুরণ হয়ে যাবে। কারণ কষকরা এ ঋণ ফসল ফলানোর শুরুতে তথা (মৌসুম) অনুযাই নিয়ে থাকে।
কৃষিখাতে ঋণ বিতরণের চেয়ে শতাংশের দিক থেকে আদায়ের পরিমাণ বেশি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কৃষকরা করোনার প্রভাবের কারণে ফসল ও পোল্ট্রি ফার্মে বড় আকারে ইনভেস্টমেন্ট করেনি। এ কারণে তারাই ঋণ কম নিয়েছে। এছাড়া কৃষকরা করোনা প্রভাব থাকা সত্যেও আগামীতে আরও বেশি পরিমাণে ঋণ পাওয়ার প্রত্যাশায় ঋণের টাকাগুলো আদায়ে সক্রিয় ছিল। এ কারণে কৃষি ঋণ আদায় বেশি হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে মোট ৩০ লাখ ৬৬ হাজার ৭৮৬ জন কৃষি ও পল্লিঋণ পেয়েছেন, যার মধ্যে ব্যাংকগুলো নিজস্ব নেটওয়ার্ক ও এমএফআই লিংকেজের মাধ্যমে ১৫ লাখ ১৪ হাজার ৩৬৭ জন নারী প্রায় ৮ হাজার ৩৫৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকা কৃষি ও পল্লিঋণ পেয়েছেন। আলোচিত সময়ে ২৩ লাখ ৫৪ হাজার ৮৮৮ জন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ১৬ হাজার ২৫০ কোটি টাকা এবং চর, হাওর প্রভৃতি অনগ্রসর এলাকার ৭ হাজার ১৭৯ জন কৃষক প্রায় ২১ কোটি ২১ লাখ টাকা কৃষি ও পল্লিঋণ পেয়েছেন।
প্রসঙ্গত, করোনা মহামারির সংকটে কৃষি খাতকে সর্বাত্মকভাবে এগিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় কৃষি খাতে চলতি মূলধন সরবরাহের উদ্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংক