১৯৭১ সাল। পাক হানাদারের নির্মম হত্যাযজ্ঞে রক্তাক্ত জাতি। বাতাসে লাশের গন্ধ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হানাদারের থাবা। বদ্ধ ভূমিতে চাপা লাশ। জোহা হলে আমার মায়ের ইজ্জত লুন্ঠিত। বেয়নেটের আঘাতে খুন শহীদ ড. হাবিবুর রহমান। হানাদারের নির্যাতনে জীবন্ত শহীদ ড. মজিবুর রহমান দেবদাস! লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মহান স্বাধীনতা। যার পেছনে রয়েছে কৃষক, শ্রমিক, তাঁতি, জেলে, লেখক, নারীসহ আম জনতার সংগ্রামের চিহ্ন। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত আর মা বোনদের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত এ মহান স্বাধিনতার যুদ্ধে আম জনতার পাশাপাশি রয়েছে দেশের শিক্ষিত সমাজের অসামান্য অবদান। সেই অবদানের এক বিশাল অংশ রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ জুড়ে। কেননা ৭৫৩ একরের চির সবুজ চত্বরটি সেদিন হায়েনার হিংস্র থাবায় হয়ে উঠেছিল রক্তাক্ত! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব দেশের আপামর জনতা, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাক হানাদার বিরুদ্ধে। অগ্নিশলাকার মতো প্রজ্বলিত হয়ে উঠেছিল যখন এ দেশের গ্রামগঞ্জ, নগর, বন্দরের পথঘাট। ঠিক সেই মূহুর্তে জাতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে পাক হানাদারের বিরুদ্ধে প্রাণপণ সংগ্রাম করেছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র, কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ। শুধু মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ-ই নয়-'৬২ ছাত্র আন্দোলন ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনের মাধ্যমে তাঁরা রেখে গেছেন অসামান্য দৃষ্টান্ত। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রক্টর অধ্যাপক ড শামসুজ্জোহার আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে স্বাধিকার আন্দোলনে যুক্ত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার মুক্ত ক্যাম্পাস গড়তে গিয়ে তাদের অত্যাচার-নির্যাতনে শহীদ হন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের রিডার অধ্যাপক হবিবুর রহমান, ভাষা (সংস্কৃত) বিভাগের অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার, মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মীর আবদুল কাইউমসহ প্রায় ত্রিশজন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থী। ইতিহাসের এই মহানায়কদের স্মৃতি চির অম্লান করতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা শিল্প-
বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ:
দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত নিরাপরাধ মানুষকে তুলে এনে এখানে নির্মমভাবে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। তাদের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার উদ্দেশ্যেই বিশ্বিদ্যালয়ের সমতল ভূমি হতে ৪২ ফুট উচুঁ সিমেন্টের গোলাকার বেদির উপর নির্মিত হয় এই বদ্ধ ভূমি স্মৃতিস্তম্ভ। যা সর্বদা পাকিস্তানি হানাদারদের নৃশংসতার নির্মম চিত্র তুলে ধরে। স্মৃতিস্তম্ভটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদম পশ্চিমে শহীদ শামসুজ্জোহা হলের পাশে অবস্থিত।
বিদ্যার্ঘ ভাস্কর্য:
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে বাঙালিকে নিশ্চিহ্ন করার যে প্রয়াস চালিয়েছিল, তাতে আক্রান্ত হয়েছিল দেশের বৃহত্তম এই বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে হানাদার বাহিনীর একটি বড় অংশ ঘাঁটি গেড়ে বসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। এ সময় যারা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে হানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত করে দেশ স্বাধীনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম মহানায়ক ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গনিত বিভাগের শিক্ষক শহীদ অধ্যাপক হবিবুর রহমান।
১৫ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যরা তাঁর বাসায় অভিযান চালিয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরি ভবনে তাঁকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে। মহান এই মানুষটির সর্বোচ্চ ত্যাগের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা হিসেবে নির্মাণ করা হয় শহীদ হবিবুর রহমান হল।
পরবর্তীতে তিনিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব বুদ্ধিজীবী স্বাধীনতা যুদ্ধে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে গেছেন। তাঁদের স্মৃতিকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে চির স্মরণীয় করে রাখতে নির্মিত হয় ভাস্কর্য 'বিদ্যার্ঘ'। ষড়ভুজ আকৃতির এই ভাস্কর্যটি শহীদ হবিবুর রহমান হলের সামনে অবস্থিত।
সাবাস বাংলাদেশ ভাস্কর্য:
'অবাক তাকিয়ে রয়;
জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার,
তবু মাথা নোয়াবার নয়'।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নির্মিত স্থাপনার মধ্যে অন্যতম 'সাবাস বাংলাদেশ' ভাস্কর্য। বাংলাদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধের যে প্রতীকী ভাস্কর্যগুলো রয়েছে তার মধ্যে প্রকাশ-ভঙ্গির সরলতা,গতিময়তা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার তেজস্বী বহিঃপ্রকাশ ও নন্দনতাত্ত্বিক দিক থেকে এই ভাস্কর্যটি অনবদ্য।
স্বাধীনতার জ্বলন্ত প্রতীক হিসেবে স্থাপিত এই ভাস্কর্যটি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতীকী চিত্র। যারা রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে হানাদারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল লাল সবুজের পতাকা। চিত্রশিল্পী নিতুন কুণ্ডের কালজয়ী এই ভাস্কর্যটি সর্বদা ক্যাম্পাসের মূল ফটকের পাশে দাঁড়িয়ে সংগ্রাম ও বিজয়ের কথা বলে।
শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়