জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ক্ষুধার কারণে মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছে বিশ্বের লাখো মানুষ। বর্তমানে ৩৬টি দেশের তিন কোটি মানুষ মৃত্যু থেকে মাত্র একগজ দূরে অবস্থান করছে। অপরদিকে দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে বেশিরভাগ বাড়িতে একজন ব্যক্তির বছরে খাবার অপচয়ের পরিমাণ গড়ে ৭৪ কেজি। যুক্তরাজ্যের প্রতিটি বাড়িতে অপচয় করা হয় প্রতি সপ্তাহে একটি পরিবারের আট বেলার খাবার। মোট খাবার অপচয়ের ১৭ শতাংশ হয় রেস্তোরাঁ ও দোকানে। কিছু খাবার নষ্ট হয় কারখানা ও সাপ্লাই চেইনে। এর অর্থ হলো, মোট খাবারের এক-তৃতীয়াংশ কখনো খাওয়াই হয় না।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন কমে গেছে। করোনার কারণে শ্রমিক সংকট ও খাদ্য সংরক্ষণে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। দীর্ঘদিন পরিবহণ বন্ধ থাকায় এবং পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় ও সুষ্ঠু বণ্টনের অভাবে খাদ্য সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। ফলে অনেক দেশে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া তৈরি খাবার নষ্ট হয়ে যাওয়া বর্তমানে একটি সাধারণ ঘটনা।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধারণার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ খাবার অপচয় হচ্ছে বলে জাতিসংঘ থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, খাবারের অপচয় বেশি হচ্ছে ধনী দেশগুলোতে। এর বিপরীতে দরিদ্র দেশগুলোর মানুষ খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবে দরিদ্র দেশগুলোর ধনীরা প্রতিদিন যেটুকু খাবার কেনেন সেটুকুর সদ্ব্যবহার করেন না। খাবার অপচয় করেন।
উন্নত দেশগুলো দৈনিক যে পরিমাণ খাবার অপচয় করে, সেটা যদি না করত তাহলে দরিদ্র মানুষ সে খাবার খেতে পারত। খাবার অপচয়ের ফলে কয়েকশ’ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত থেকে যাচ্ছে। করোনার প্রথম ঢেউয়ের প্রভাবে আয় এবং সামাজিক যত্ন কমে যাওয়ায় অনেকে ডাস্টবিনের খাবার কুড়িয়ে খেতে চেষ্টা করেছে। এতে আরও বেশি স্বাস্থ্যহীনতা দেখা দিচ্ছে। ঘন ঘন লকডাউন ও ঘরের বাইরে যাওয়ার ভীতি থাকায় নষ্ট খাবার থেকে তৈরি বর্জ্য একদিকে বাসার ভেতরের পরিবেশ নষ্ট করছে, অন্যদিকে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের অভাবে সময়মতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান না চালানোর ফলে খাবার পচে-গলে পরিবেশের ক্ষতি করছে।
বর্তমানে করোনার দ্বিতীয় এবং কোথাও কোথাও তৃতীয় ঢেউয়ের অশনিসংকেত শোনা যাচ্ছে। করোনার নতুন স্ট্রেইন বের হওয়ায় যুবক ও শিশু-কিশোরদের মধ্যে সংক্রমণের মাত্রা বেড়েছে। পাশাপাশি করোনা সম্পর্কে মানুষের উদাসীনতা বেড়েছে বহুগুণ। ফলে একটি পরিবারের সব সদস্য আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। একটি পরিবারের মা-শিশুসহ সবাই আক্রান্ত হলে সেবা-যত্ন নেওয়ার কেউ থাকবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে।
এদিকে বিশ্বব্যাপী টিকা নিয়ে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি ও টিকা রাজনীতি শুরু হয়েছে। টিকার মান ও কার্যকারিতা নিয়ে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে অর্থাভাবে গরিব দেশগুলো এখনো টিকা সংগ্রহ করতে পারেনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে এখনো কোনো কার্যকর টিকা সহায়তার ঘোষণা না আসায় দরিদ্র মানুষের করোনা মোকাবিলা নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে। উপরন্তু ধনী দেশগুলো জাতিসংঘের প্রতি তাদের নিয়মিত ক্ষুধা মোকাবিলার বাজেট কমিয়ে দিয়েছে অথবা বন্ধ করেছে। এজন্য ২০২১ সালে আফ্রিকা মহাদেশসহ বিভিন্ন দরিদ্র দেশে ক্ষুধার তীব্র সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এজন্য জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস উদ্বেগ প্রকাশ করে ৫৫০ কোটি ডলারের জরুরি সাহায্য চেয়েছেন।
আলো ঝলমল প্রাসাদের পাশের বস্তিবাসী কিংবা কর্মহীন মানুষের খবর প্রতিদিন আমরা ক’জনই বা নিতে পারি? অসহায়, ভিক্ষুক, দরিদ্র রোগী, বেদনার্ত প্রতিবেশীদের খোঁজখবর নেওয়ার সময় আমাদের নেই। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে মানুষ আবারও ঘরের দরজা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলে সার্বিক পরিস্থিতি কী হবে তা সহজেই অনুমেয়। এর সঙ্গে খাদ্য সংকট শুরু হলে এর ভয়াবহ পরিণতি কী হতে পারে তা বলাই বাহুল্য।
আমি নিরাশ হই না। শুধু চাই, ২০২০ সালের মতো ভয়ংকর দিন আবার ফিরে না আসুক। এখন বিশ্বে বছরে ১০০ কোটি টন খাবার নষ্ট হয়ে যায়। সেটা কি আমরা রক্ষা করতে পারি না? অন্তত ভুখানাঙ্গা মানুষের ক্ষুণ্নিবৃত্তির জন্য একটি বিশেষ তহবিলে সেই অর্থ জমা দিয়ে নিজেদের ভোগ-বিলাস কিছুটা কমিয়ে মানবতার সেবা করা যায় না? শুধু ক্ষুধার কারণে মৃত্যুঝুঁকিতে লাখো মানুষ-এ কথাটি আধুনিক সভ্যতার ধ্বজাধারী বিলাসী মানুষকে কি কোনো নির্মম পরিহাসের বার্তা শোনায় না?
ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান