২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বসতঘরের পাশে আড়াই একর জায়গার ওপর চারটি গরু নিয়ে 'ফারহানা ডেইরি ফার্ম' নামে একটি দুঙ্খামার গড়ে তোলেন গৃহবধূ ফারহানা ইয়াছমিন। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে তার খামারে রয়েছে ৩৫টি গাভি। প্রতিদিন এসব গাভি ২৫০ লিটার দুধ দেয়। দুধ বিক্রি করে তিনি প্রতিদিন ১৫ হাজার টাকা এবং মাসে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা আয় করেন। ৩৫টি গাভির দাম প্রায় কোটি টাকা।
পটিয়া পৌর সদরের গোবিন্দরখীল এলাকার ফারহানা ইয়াছমিন জীবনযুদ্ধে সফল এক নারী। যিনি সব বাধা পেছনে ফেলে হয়েছেন স্বাবলম্বী। তিনি এখন সবার কাছে অনুকরণীয় উদ্যোক্তা। ২০১৯ সালে সফল খামারি ও অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী হিসেবে চট্টগ্রাম বিভাগ ও পটিয়ার উপজেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন ফারহানা ইয়াছমিন।
ফারহানা পটিয়া পৌর সদরের ৯নং ওয়ার্ডের গোবিন্দরখীল এলাকার তালুকদার বাড়ির বাসিন্দা। বিএসসি পাস করার পর ১৯৯৯ সালে গোবিন্দরখীল এলাকার শফিউল আলম মনির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ফারহানা। ফারহানার স্বামী জীবনবীমা করপোরেশনের কর্মকর্তা। ২০০৩ সালে ফারহানাও যোগ দেন জীবনবীমা করপোরেশনে উন্নয়ন কর্মকর্তা হিসেবে। তাদের সংসারে রয়েছে ৩ পুত্রসন্তান।
খামার প্রসঙ্গে বলেন, অনেকটা শখের বশে তিনি বিভিন্ন জাতের চারটি বিদেশি গাভি কিনে 'ফারহানা ডেইরি ফার্ম' গড়ার কাজ শুরু করেন। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে বসতঘরের পাশে আড়াই একর জমির ওপর 'ফারহানা ডেইরি ফার্ম' গড়েন তিনি। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে তার খামারে বিভিন্ন জাতের ৩৫টি গাভি ও বাচ্চা রয়েছে। তার খামারে দু'জন শ্রমিক কাজ করেন। পরিবারের সব সদস্য গরুর দুধ দোহন করতে জানেন। প্রথম দিন থেকে ফারহানা ও তার স্বামী এবং তাদের সন্তানরা খামারটি দেখভাল করে আসছিলেন। তবে বছরখানেক ধরে দু'জন শ্রমিকও কাজ করে যাচ্ছেন তাদরে সঙ্গে। শ্রমিকদের বেতন আর গাভিগুলোর নিয়মিত খাবারের খরচ বাদ দিয়ে মাসে প্রায় দুই লাখ টাকার মতো আয় হয় ফারহানার। খামারে বিদেশি জাতের গরু থাকলেও সবগুলোর পরিচর্যা করা হয় দেশীয় পদ্ধতিতেই।
ফারহানার খামারের বর্জ্য থেকে উৎপাদিত হচ্ছে বায়োগ্যাস। তার জন্য খামারের পাশেই রয়েছে বায়োগ্যাস প্লান্ট। ওই প্লান্ট থেকে নিজেদের পরিবারের জ্বালানি চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি প্রতিবেশী আরও ৪ পরিবারের চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। এতে শুধু ফারহানাই স্বাবলম্বী হননি, সে সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এলাকার বহু বেকার মানুষেরও। আবার ফারহানার সাফল্য দেখে উৎসাহিত হয়ে অনেকে নতুন নতুন খামার গড়েছেন। এতে এলাকায় দুগ্ধ খামার গড়ে তোলার ব্যাপারে এলাকাবাসী বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
স্থানীয় তরুণ জহির তালুকদার বলেন, 'কৃষি কাজে কলের লাঙল ও আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কারণে দেশি গরু দিন দিন কমে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে দেশি গরুর দুধ, চাষাবাদ এবং অন্যান্য উপকারিতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি আমরা। এ অবস্থায় কয়েকটি বিদেশি গাভি দিয়ে ফার্ম গড়েন ফারহানা। এখন তার খামারে অনেক গরু। প্রচুর দুধ পান ফারহানা। তার গরুর দুধ আমাদের এলাকার চাহিদা মিটিয়ে অন্য এলাকায়ও যায়।'
খামারি ফারহানা ইয়াছমিন খান বলেন, 'চারটি গাভি দিয়ে খামারটি গড়ে তুলি। বর্তমানে খামারে ৩৫টি গাভি রয়েছে। প্রতিদিন ২৫০ লিটার দুধ পাই। প্রতি লিটার দুধ ৬০-৭০ টাকায় বিক্রি হয়। সে হিসাবে প্রতিদিন প্রায় ১৫-২০ হাজার টাকার দুধ বিক্রি হয়। বলতে পারেন মাসে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকার দুধ বিক্রি হয়। গাভির খাবার, বিভিন্ন জিনিসপত্র, ওষুধ এবং শ্রমিকদের বেতন দিয়ে মাসে দুই-তিন লাখ টাকার মতো লাভ থাকে। তিনি আরও বলেন, 'ছোট পরিসরে শুরু করলেও এখন খামারটি বড় করা জরুরি। কারণ ৩৫টি গাভি এখানে রাখা কষ্টকর। তাই খামারটি বড় করার চেষ্টা চলছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে খামারটি আরও বড় করতে পারতাম।'
এ ব্যাপারে উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা শাহনাজ বেগম বলেন, 'গরুর খামার তৈরি করে অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী হিসেবে ফারহানা উপজেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি পুরস্কৃতও হয়েছেন।'
পটিয়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা যগু চক্রবর্তী বলেন, 'পৌর সদরের গোবিন্দরখীল এলাকায় একটি গাভির খামার আছে বলে আমরা জেনেছি। আশপাশের এলাকায় ওই খামার থেকে দুধ সরবরাহ করা হয়। খামারটি করে মালিক স্বাবলম্বী হয়েছেন। এটি যুব সমাজের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। বিশেষ করে শিক্ষিত বেকার যুবকদের জন্য এটি অনুকরণীয়। খামারে নিত্যনতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করে ব্যবসার উন্নতি করা যায়। শিক্ষিত যুবকরা এসব কাজে এগিয়ে এলে দেশের কৃষি ব্যবস্থাপনা আরও সমৃদ্ধ হবে। খামারিদের সার্বিক সহায়তা দেওয়া হবে।'