সাংসদের গুলিতে রক্তাক্ত শিশু
প্রকাশ: ২০১৫-১০-০৩ ১০:০২:২০
সকালে চাচার সঙ্গে হাঁটতে বেরিয়েছিল আট বছরের শিশু শাহাদাত হোসেন (সৌরভ)। কিন্তু সাংসদের ছোড়া গুলিতে রক্তাক্ত হয়ে তাকে যেতে হয়েছে হাসপাতালে। তার দুই পায়ে তিনটি গুলি লেগেছে।
শাহাদাতের পরিবার ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল শুক্রবার সকালে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে আওয়ামী লীগের সাংসদ মন্জুরুল ইসলাম ওরফে লিটনের গুলিতে আহত হয় চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র শাহাদাত। তাকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্সও আটকে দিয়েছিল সাংসদের সমর্থকেরা। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগে ভর্তি করা হয়।
সাংসদ মন্জুরুল ইসলামের মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। পরে বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গায় বাড়িতে গেলে সাংসদের স্ত্রী গাইবান্ধা জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক খুরশিদ জাহান বলেন, ‘এমপি ঘুমিয়ে আছেন। তাঁকে ডাকা যাবে না।’
শিশুকে গুলি করার ব্যাপারে জানতে চাইলে খুরশিদ জাহান বলেন, ‘সুন্দরগঞ্জ-বামনডাঙ্গা সড়কের ব্র্যাক মোড়ে কিছু লোক এমপির গাড়ি ঘিরে ধরেছিল। জামায়াত-শিবির ঘিরে ধরেছে মনে করে আমার স্বামী ফাঁকা গুলি ছুড়েছে। ওই গুলিতে শিশু আহত হয়েছে কি না, আমার জানা নেই।’
শাহাদাতের পরিবার থাকে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার দহবন্দ ইউনিয়নের গোপালচরণ গ্রামে। সে গোপালচরণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। প্রতিদিনের মতো গতকাল সকালে চাচা শাহজাহান আলীর সঙ্গে হাঁটতে বেরিয়েছিল শাহাদাত। সকাল পৌনে ছয়টার দিকে বাড়ির পাশে সুন্দরগঞ্জ-বামনডাঙ্গা সড়কে ব্র্যাক মোড় এলাকায় গুলিবর্ষণের ঘটনাটি ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, সাংসদ মন্জুরুল ওই সড়ক দিয়ে পাজেরো চালিয়ে বামনডাঙ্গা থেকে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা শহরে যাচ্ছিলেন। সাংসদ ব্র্যাক মোড় এলাকায় গিয়ে গাড়ি থামান এবং গাড়িতে বসে জানালা দিয়ে শাহাদাতের চাচা শাহজাহানকে ডাকেন। কিন্তু শাহজাহান ভয়ে দৌড় দিলে সাংসদ ক্ষিপ্ত হয়ে ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্র বের করে শাহজাহানকে লক্ষ্য করে কয়েকটি গুলি ছোড়েন। দুটি গুলি শিশুটির ডান পায়ে ও একটি বাঁ পায়ে লাগে। এরপর স্থান ত্যাগ করেন সাংসদ। গুলির শব্দ পেয়ে স্থানীয় লোকজন ছুটে যান। তাঁরা শাহাদাতকে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। পরে তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। তবে রংপুরে যাওয়ার পথে বামনডাঙ্গা এলাকায় শাহাদাতকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স আটকে দেয় সাংসদের লোকজন। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটি ছাড়িয়ে নেয়।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুল হাই মিলটন বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখার সংবাদ পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে যাই। তখন সেখানে পুলিশও যায়। এরপর অ্যাম্বুলেন্স ছেড়ে দেওয়া হয়।’
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক শুভ কুমার দাস বলেন, শিশুটির ডান পায়ে দুটি ও বাঁ পায়ে একটি গুলির ক্ষতচিহ্ন আছে। তিনটি ক্ষতচিহ্নই হাঁটুর নিচে। তবে গুলি পাওয়া যায়নি। দুই পা থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাকে রক্ত দেওয়া হচ্ছে।
শিশু শাহাদাত হাসপাতালে কাঁদতে কাঁদতে সাংবাদিকদের বলে, ‘এমপি সাহেব গাড়ি থামায়া আমার চাচাকে ইশারায় ডাকে। চাচা যায় না, চাচাকে ভয় দেখায়। তারপরে চাচাকে কী যেন দেখাইছে, চাচা ভয় পাইছে, দৌড় দিছে। তারপর ওমরা (উনি) গ্লাস নামায়া গুলি করে। তখন আমি দুই পায়ে ব্যথা পাই, মাটিতে পড়ে যাই। দেখি, আমার দুই পা দিয়া রক্ত ঝরছে। খুব ব্যথা। দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। পারি না।’
চাচা শাহজাহান বলেন, ‘এমপির ডাকে না যাওয়ায় তিনি আমাকে গালাগালি করতে থাকেন। আমি ভয়ে দৌড় দেই। উনি তখন গুলি করতে থাকেন। কিছুদূর গিয়ে পেছনে ফিরে দেখি, আমার ভাতিজা রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে পড়ে কাঁদছে।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে শাহাদাতের মা সেলিনা বেগম বলেন, ‘হামার ছোলটের এতো অক্ত (রক্ত) ঝরালো। এমপি হোক আর যাই হোক, আমি ছোলটেরে গুলি করার বিচার চাই।’
রাতে সংসদের হুইপ মাহাবুব আরা বেগম গিনি বলেন, গুলির ঘটনাটি তিনি প্রশাসনের মাধ্যমে জেনেছেন। তিনি বলেন, সাংসদ শিশুকে গুলি করলে তা অবশ্যই দুঃখজনক এবং নিন্দনীয়। এর তদন্ত করে দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁর শাস্তি হওয়া উচিত।
সুন্দরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, সাংসদের এই কর্মকাণ্ড দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। একজন সুস্থ মানুষ এভাবে গুলি করতে পারেন না।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম বলেন, এটি ন্যক্কারজনক ঘটনা। এর আগেও এমন অনেক ঘটনা ঘটিয়েছেন সাংসদ।
দুপুরে রংপুর মেডিকেেল যান গাইবান্ধার পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, শিশুটি গুলিবিদ্ধ হয়েছে, এটা ঠিক। তবে কে গুলি করেছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তদন্ত চলছে। ঘটনায় কোন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত থানায় মামলা বা অভিযোগ করা হয়নি। শিশুটির পরিবার তার চিকিৎসা নিয়েই ব্যস্ত।
নিন্দা: আইন ও সালিশ কেন্দ্র, জামায়াতে ইসলামী এবং বিকল্পধারা বাংলাদেশ গতকাল বিজ্ঞপ্তিতে এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে। একই সঙ্গে শিশুটির চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া ও সাংসদ মন্জুরুলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়।