যশোরের মনিরামপুর উপজেলার রাজগঞ্জের পল্লীতে নারীদের নিপুন হাতে তৈরি হস্তশিল্পের নানা সামগ্রী যাচ্ছে ইউরোপের ৩২টি দেশে। এতে প্রতিমাসে রোজগার করা অর্থ অসচ্ছল সংসারে যোগান দেয়ার পাশা পাশি নিজেদের খরচ চালিয়ে নিতে পারছেন তারা। উপজেলার রাজগঞ্জ এলাকার এনায়েতপুর গ্রামের প্রায় অর্ধশত নারী সংসারের কাজের ফাঁকে এসব সামগ্রী তৈরি করেন।
এই নারীরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে নিজেরা স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে অনেকেই মনে করেন। সরেজমিন ওই গ্রামে গেলে হস্তশিল্প বানানো চিত্র চোখে পড়ে। নারীদের কেউ কেউ নিজের বাড়ির আঙ্গিনায়, আবার কেউ দল বেঁধে গাছ তলায় বসে আপন মনে নিপুন হাতে তৈরি করে চলেছেন নানাসামগ্রী। কথা হয় মুক্তা, তারা, নাইমা, নাহার, পারভীন, হাসিনা ,জেসমিন আক্তার , কনা, রাখিসহ একাধিক নারীদের সাথে। এরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন কথা বলেন। তারা জানান পাশের ঝিকরগাছা উপজেলার শিমুলিয়ার সাহেব বাড়ি মিশন থেকে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়ার পর দীর্ঘ ২১ বছর ধরে অবসর সময় তারা এসব সামগ্রী তৈরি করছেন যা এএসকের (হ্যান্ডিক্রাফট লিমিটেডের) মাধ্যমে পরিচালিত হয়। কোম্পানির ব্যবস্থাপক ( সাহেব বাড়ি) সৈদয় আরাফাত হোসেন রাজিবের নির্দেশনা মতো খেজুর গাছের শুকনো কচিপাতা ও খড়ের উপকরণ দিয়ে পয়সা সেট, বিভিন্ন আকৃতির ড্রাম( লন্ডি নামে পরিচিত) ওভাল, কাসারুল, বাটিসেট, বলবাটি, হাড়ি, কড়াই, বালতি ইত্যাদি সামগ্রী তৈরি করেন।
এতে করে প্রতি মাসে এসব নারীরা ৩ থেকে ৯ হাজার টাকা পর্যন্ত রোজগার করেন। যাতে অস”ছল সংসারে যোগান দেয়ার পাশাপাশি নিজেদের খরচ চলে। মুক্তা বলেন পয়সা সেট বিভিন্ন আকৃতির হয়। এটি আকৃতিভেদে দেড়শ টাকা থেকে ২৫০ টাকায় কিনে নেয়া হয়। খরচ হয় ৫০ টাকার মতো। কাজের ফাঁকে এটি তৈরিতে ৩ দিন সময় লাগে। তবে একটানা তৈরি করলে একদিনে বানানো সম্ভব।জেসমিন আক্তার বলেন তিনি স্নাতক পড়ছেন। তার পড়ার খরচ হস্তশিল্প তৈরির রোজগার দিয়েই চলে। বড় আকৃতির ড্রাম তৈরিতে ৫০ টাকার খেজুর গাছের কচিপাতা এবং ৪০ টাকার খড় লাগে। যা শিমুলিয়ার সাহেব বাড়ি থেকে যোগান দেওয়া হয়। এটি তৈরির পর ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়। তৈরিতে সপ্তাহ খানেক সময় লাগে। তবে একটানা কাজ করলে দুইদিনে সম্ভব বলে তিনি দাবি করেন। বালতি, বাটিসেট, হাড়ি,কড়াই ইত্যাদি তৈরিতে প্রায় সম পরিমাণ উপকরণ ও সময় ব্যয় হয় এবং আকৃতিভেদে ৩৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়।
নাইমা বলেন শিমুলিয়া থেকে চাহিদামতো হস্তশিল্প বানানোর মডেল সরবরাহ করা হয়। আগে থেকেই তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এরপর তাদের (সাহেব বাড়ি) নির্দেশনা মতো সামগ্রী তৈরি করা হয়। হস্তশিল্প কারিগর নারীরা জানান তাদের তৈরি সামগ্রী বিভিন্ন রং দিয়ে দৃষ্টিনন্দন ডিজাইন করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়। ইউরোপের বড় শপিং মল, বাজারে এসব সামগ্রী বিক্রি হয়। সেখানে সৌখিন লোকজনের বাসাবাড়ি,বড় হোটেল-মোটেলে এসব সামগ্রী দিয়ে সাজিয়ে শোভাবর্ধন করা হয়। রাজগঞ্জের এনায়েতপুর গ্রামের নারীদের এসব কাজে পুরুষরাও সহযোগিতা করেন। এ কাজ করতে গিয়ে বাড়ির কাজে কোন ধরনের অসুবিধা হয় না। রাখির স্বামী মনোয়ার হোসেন বলেন বাড়ির কাজ শেষ করেই অবসর সময় তারা এসব হস্তশিল্প তৈরি করেন। এতে গত মাসে তার স্ত্রী প্রায় ৯ হাজার টাকা রোজগার করেছেন। যা সংসারের অনেক উপকারে এসেছে। হেনার স্বামী মেহেদী হাসান বলেন তার স্ত্রী গত মাসে বেশি কাজ করতে পারেনি। তারপরও প্রায় ২ হাজার টাকা রোজগার করেছেন।
কোম্পানির ব্যবস্থাপক সৈয়দ আরাফাত হোসেন বলেন সাহেব বাড়ি থেকে এটি পরিচালিত হয়। প্রতি সপ্তাহে এসব সামগ্রী সংগ্রহ করে ঢাকা প্রধান কার্যলয়ে পাঠানো হয়। সেখান থেকে প্যাকেটজাত হয়ে চট্রগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজে করে ইউরোপের ইতালি, অস্ট্রিয়া, ক্যানাডা, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, পোল্যান্ডসহ ৩২ টি দেশে রপ্তানি হয়। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মাস্টার জহুরুল ইসলাম বলেন এই নারীদের সরকারি পৃষ্টপোষকতা দিয়ে সমবায়ের ভিত্তিতে কাজের সুযোগ করে দেয়া হলে এরা আরও স্বাভলম্বী হতে পারতেন।