সবুজ ধানে ছেয়ে গেছে ফসলের মাঠ। ধানের ফলন নিয়ে আশায় বুক বেঁধেছিলেন কৃষক। ভেবেছিলেন করোনার দুঃসময়েও কিছুটা হলেও সম্ভব হবে ঘুরে দাঁড়ানো। কিন্তু গত ৪ এপ্রিল কয়েক মিনিটের গরম হাওয়া কেড়ে নিয়েছে তাদের এই স্বপ্ন। মৌসুমের প্রথম ঝোড়ো বাতাসের সাথে গরম হাওয়ায় চিটা হয়ে গেছে দেশের বিভিন্ন এলাকার জমির ধান। গবেষকরা এর নাম দিয়েছেন ‘হিট শক’।
তারা বলছেন, সাধারণত আমাদের দেশে চলমান ধানের জাতগুলো ৩৩.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। ধানের বৃদ্ধির সময় বেশি তাপমাত্রা অনেকক্ষেত্রে ভালো ভূমিকা রাখলেও ফুল ফোটার সময় ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা এর বেশি তাপমাত্রায় ধান চিটা হয়ে যায়। বর্তমানে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ায় প্রায়ই ধানের বদলে চিটা পাচ্ছেন কৃষকরা। এতে মাথায় হাত পড়ছে তাদের।
জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিরূপ প্রভাবে মাথায় হাত পড়া কৃষকদের জন্য সম্ভাবনাময় খবর নিয়ে আসার দাবি করছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা। তারা বলছেন, উচ্চ তাপ সহনশীল ধানের একটি সারি উদ্ভাবন করেছেন তারা। যাকে ধানের নতুন জাত হিসেবে রূপ দিতে চলছে কর্মযজ্ঞ।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা যায়, বৈশ্বিক আবহাওয়া পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বুঝতে পেরে ২০১৩ সাল থেকে উচ্চ তাপমাত্রা সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনের গবেষণা শুরু করেন সংস্থাটির ৩ জন গবেষক। দীর্ঘ গবেষণার পর উচ্চ তাপমাত্রা সহিষ্ণু এন২২ (ঘ২২) জাতের সাথে বোরো মওসুমের জনপ্রিয় আধুনিক জাত ব্রি ধান-২৮ কে মিলিয়ে মার্কার এসিসটেড ব্যাকক্রসিং পদ্ধতির মাধ্যমে একটি অগ্রগামি সারি নির্বাচন করেন তারা। যা মধ্যম মাত্রার উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল বলে প্রমানিত হয়েছে। এই সারি ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায়ও ভালো ফলন দিতে সক্ষম।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষণা দলের অন্যতম সদস্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা সমন্বয়ক ড. মুন্নুজান খানম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাপমাত্রা বাড়লে ধানের ফলনে বিরূপ প্রভাব পড়বে এমন ধারণা থেকে আমরা ৭ বছর আগে গবেষণা শুরু করি। গবেষণায় উঠে আসা নতুন সারিটিকে আমরা বার বার ট্রায়াল করছি। আমরা তাপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা দিয়ে পরীক্ষা করেছি। এই তাপমাত্রায়ও ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে।
এ সারিটি বর্তমানে আঞ্চলিক ফলন পরীক্ষণ পর্যায়ে রয়েছে। ফলন ও অন্য বৈশিষ্ট্য গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হলে এটিকে জাত হিসেবে অনুমোদনের জন্য জাতীয় বীজ বোর্ডে আবেদন করা হবে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবির বলেন, আমরা আগেই যেটা ধারণা করে কাজ শুরু করেছিলাম এখন আপনারা তারই বাস্তবায়ন দেখতে পাচ্ছেন। এখন হিট শকে ধান নষ্ট হচ্ছে। আমাদের উদ্ভাবিত সারিটি ১২টি স্থানে পরীক্ষমূলকভাবে উৎপাদন করা হচ্ছে। সেখানে ভালো ফলন পেলেই এটিকে জাত হিসেবে রূপ দেওয়ার পাশাপাশি কৃষক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া হবে।
আগামী বছরের মধ্যে এই ধান কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করে এই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, আমরা শুধু ব্রি ধান-২৮ জাত নিয়ে বসে নেই। দেশীয় অন্য জাতগুলোরও উচ্চ তাপ সহনশীল জাত উদ্ভাবনে কাজ চলছে।
এদিকে, সম্প্রতি দেশজুড়ে হিট শকে ধানের ক্ষয়ক্ষতির প্রেক্ষিতে উচ্চ তাপ সহনশীল ধানের জাত উদ্ভাবনের খবর পেয়েই গবেষণার অগ্রগতি পরিদর্শনে রোববার (১৮ এপ্রিল) হঠাৎ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা মাঠে যান কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক। এই সময় তিনি খাদ্য নিরাপত্তায় ব্রি’র বিজ্ঞানীদের প্রস্তুতি ও গবেষণা অগ্রগতি দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন এবং বিজ্ঞানীদের অভিনন্দন জানান।
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ভবিষ্যতে যাতে দেশের মেহনতি কৃষক ভাইদের এমন বিপর্যয় এর মুখোমুখি হতে না হয় সেজন্যেই উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল এবং রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধক উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবনের বিষয়ে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে। মন্ত্রী বর্তমানে বৈরী পরিবেশ উপযোগী বিভিন্ন সহনশীল ও পুষ্টিগুণ সম্পন্ন জাত উদ্ভাবনের গবেষণা অগ্রগতি ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা দেখে ব্রির বিজ্ঞানীদের ভূয়শী প্রশংসা করেন।
একই সঙ্গে দেশজুড়ে হিট শকে ক্ষতির শিকার হওয়া কৃষকদের সহায়তার জন্য সরকার ইতোমধ্যে ৪২ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ও সহায়তা কর্মসূচিসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলেও জানান কৃষিমন্ত্রী।