মহামারির মধ্যে তৈরি পোশাকখাতের শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধের জন্য কারখানা মালিকরা সরকারের কাছ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা নিয়েছিলেন। এরপরেও গত বছর লাখ লাখ পোশাক শ্রমিক ছাঁটাই বা কর্মচ্যুতির শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির (বিসিডাব্লিউএস) হিসাবে, মহামারির শুরু থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এক বছরে ছাঁটাই কিংবা কর্মচ্যুতির শিকার হওয়া শ্রমিকের সংখ্যা অন্তত ৩ লাখ।
এদের মধ্যে অনেকে তাদের বকেয়া বেতন বা ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি। আর কাজে থাকা শ্রমিকদের মজুরি কাটা হয়েছে ব্যাপকহারে।
বিসিডব্লিউএসের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, মজুরি কর্তনের এই হার ৩৫ শতাংশ।
“দ্য উইকেস্ট লিঙ্ক ইন দ্য গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন: হাউ দ্য প্যানডেমিক ইজ অ্যাফেক্টিং বাংলাদেশ’জ গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স” শীর্ষক এই প্রতিবেদনটি গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হয়। যেখানে বলা হয়, পোশাক কারখানাগুলো গড়ে তাদের ১০ শতাংশ শ্রমিককে হয় ছাঁটাই করেছে, না হলে ছুটিতে পাঠিয়েছে। আর স্বল্প ক্রয়াদেশ ও নতুন ক্রয়াদেশের ক্ষেত্রে পণ্যের দাম কমে যাওয়ার পাশাপাশি দাম পরিশোধে বিলম্বের মতো পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এই হার ৩৫ শতাংশে পৌঁছাতে পারে।
গ্লোবাল ওয়ার্কার্স রাইটসের গত বছরে করা এক জরিপের তথ্য উল্লেখ করে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, এ সময়ে বাধ্যতামূলক ছুটিতে যাওয়া ৭২ দশমিক ৪ শতাংশ শ্রমিক তাদের বকেয়া মজুরি পাননি। একই ঘটনা ঘটেছে লে-অফের শিকার ৮০ দশমিক ৪ শতাংশ শ্রমিকের ক্ষেত্রে।
ইউএনডিপি বাংলাদেশ ও সুইডিশ সরকারের সরকারের সহযোগিতায় প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে দ্য ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড বিজনেস এবং বার্কলের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সুবীর অ্যান্ড মালিনী চৌধুরী সেন্টার ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ।
যেহেতু এই মুহূর্তে কারখানাগুলোতে শ্রমিক নিয়োগ এক প্রকার বন্ধ আছে, তাই কাজ হারানো শ্রমিকদের অনেকে এখন পর্যন্ত বেকার জীবনযাপন করছেন। আবার অনেকে বেছে নিয়েছেন দিনমজুরির পেশা।
ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন পোশাক কারখানার বর্তমান ও সাবেক অসংখ্য শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছর করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর হয় তারা কাজ হারিয়েছেন নয়তো তাদের মজুরি কাটা পড়েছে।
এই শ্রমিকের প্রত্যেকে জানিয়েছেন, মহামারির কারণে সৃষ্ট অচলাবস্থার কারণে কারখানা বন্ধ হওয়ার পর তাদের কেউই পুরো মজুরি পাননি।
কথা হয় নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক শাহানার (আসল নাম নয়) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘গত বছর দেশব্যাপী লকডাউনে কারখানা বন্ধ থাকার সময় তিন মাস আমি অর্ধেক বেতন পেয়েছি। সিনিয়র কিছু শ্রমিক এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছিলেন। তৎক্ষণাৎ তাদের ছাঁটাই করা হয়।’
কারখানায় এখন ওভারটাইমও কমে এসেছে জানিয়ে শাহানা আরও বলেন, ‘২০১৯ সালে প্রতি মাসে আমি ২০০ ঘণ্টার বেশি ওভারটাইম করেছি। এখন অর্ডার বাতিলের কারণে কোনো ওভারটাইম করতে পারি না।’
শাহানার হিসাবে ২০১৯ সালে বোনাস ও ওভারটাইম মিলিয়ে তিনি প্রতি মাসে ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত পেতেন। এখন তার আয় নেমে এসেছে ১০ হাজার টাকায়।
অন্য শ্রমিকদের অবস্থাও শাহানার মতোই। তারাও বলছেন, গত বছর অচলাবস্থা চলাকালে তারা প্রত্যেকে ৫০ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত মজুরি পেয়েছেন। আর ২০১৯ সালে ওভারটাইমসহ বিভিন্ন সুবিধা মিলিয়ে যে আয় তারা করতেন, তা নেমে এসেছে ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। যার প্রভাব পড়েছে তাদের দৈনন্দিন জীবনে। ফলে জীবনযাত্রার মান কমে গেছে ভয়াবহভাবে।
ব্র্যান্ড কিংবা শিল্পমালিক, সবাই একরকম
শ্রমিক নেতা ও বিসিডাব্লিউএসের নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার বলেন, ‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অতি ধনী শিল্প মালিকরাই গত বছরের প্রণোদনার অর্থ পেয়েছেন। মাসের পর মাস কারখানা বন্ধ রেখেও যাদের পক্ষে শ্রমিকদের বেতন দেওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু ছোট ও মাঝারি আকারের যে কারখানাগুলো বড় কারখানাগুলোর জন্য সাব-কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করে, তারা কোনো সহযোগিতা পায়নি। ফলে হয় তারা তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে, নয়তো উৎপাদন খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছে।’
একইসঙ্গে কল্পনা ক্রেতাদের দায়িত্বশীলতা নিয়েও অভিযোগ করেন। বলেন, ‘আমাদের হিসাবে গত বছর ৫০ শতাংশের বেশি সরবরাহকারী গড় দামের নিচে ক্রয়াদেশ নিতে বাধ্য হয়েছেন। অনেক ব্র্যান্ড ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে। শ্রমিক অধিকারের প্রতি শিল্পমালিক ও ব্র্যান্ডগুলোর উদাসীনতা আসলে একইরকম। যার ফলে এই খাতে বিপুল সংখ্যক শ্রমিককে লে-অফে পাঠানোর পাশাপাশি ব্যাপকহারে মজুরি কর্তনের ঘটনা ঘটেছে।’
এ ছাড়া, শ্রমিকদের মজুরি ও ঈদ বোনাসের বিষয়টিও সংকটে পড়ে গেছে।
মহিলা শ্রমিক লীগের নির্বাহী সভাপতি এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম শামসুন্নাহার ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা এর মধ্যে শিল্পমালিকদের ১০ মের আগে বেতন ও ঈদ বোনাস পরিশোধের কথা বলেছি। এখন তারা আবার শ্রমিকদের বেতন ও ঈদ বোনাস দেওয়ার জন্য সরকারের কাছ থেকে অতিরিক্ত ১০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ চাচ্ছেন।’
শামসুন্নাহার ভূঁইয়া আরও বলেন, ‘আমি সরকারকে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য একটা তথ্যভাণ্ডার তৈরির প্রস্তাব দিয়েছি। যাতে করে যে শ্রমিকরা কাজ হারিয়েছেন কিংবা প্রকৃত অর্থেই যাদের সাহায্যের দরকার, তাদের কাছে সরাসরি টাকাটা পৌঁছে দেওয়া যায়।’
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র পরিচালক আরশাদ জামাল বলেন, ‘এটা সত্য যে, গতবছর প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে বেশিরভাগ বড় কারখানাগুলো লাভবান হয়েছে। যেহেতু এই বিতরণের বিষয়টি নির্ভর করে রপ্তানির পরিমাণ ও ব্যাংক-ক্লায়েন্ট সম্পর্কের ওপর।’
আরশাদ দাবি করেন, দেশের ৪০ লাখ পোশাক শ্রমিকের বেশিরভাগ বড় পরিসরের কারখানাগুলোতে কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘তাই ছোট ও মাঝারি পরিসরের কারখানাগুলোর লে-অফ ঘোষণা এই খাতে বড় কোনো প্রভাব ফেলেনি।’
আরেকটি প্রণোদনা প্যাকেজের জন্য বিজিএমইএ’র বার বার দাবি প্রসঙ্গে আরশাদের বক্তব্য, প্রতিবেশী দেশগুলোর অর্থনীতি ভেঙে পড়ার কারণে ক্রেতারা আমাদের এখনো পোশাক আমদানির ক্ষেত্রে উৎস দেশ হিসেবে বিবেচনা করে। সুতরাং, উন্নত ভবিষ্যতের জন্য এই খাতকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখা উচিত।
আরশাদ আরও বলেন, ‘গত বছর আমরা প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা দুই ধাপে ঋণ হিসেবে পেয়েছিলাম। প্রথম ধাপে সুদের হার ছিল ২ শতাংশ। দ্বিতীয় ধাপে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। যা অতিরিক্ত খরচ হিসেবে আমাদের ওপর চেপে বসেছিল। যদিও আমরা মহামারিজনিত ক্ষতি এখন পর্যন্ত পুষিয়ে উঠতে পারিনি। আর কোভিড-১৯ পরিস্থিতি এ বছর আরও খারাপ হতে পারে।’
একইসঙ্গে বিজিএমইএ’র এই পরিচালক বলেন, ‘তৈরি পোশাকখাতের শ্রমিকদের জন্য আমরাও একটা পূর্ণাঙ্গ তথ্যভাণ্ডার-ডাটাবেইজ তৈরির কাজ করছি। যাতে প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ ঠিক লোকটির হাতে পৌঁছানোর বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়।’
সূত্র: ডেইলি স্টার