বয়স ৯ কিংবা ১০। এত দিন পৃথিবীর কোনো নিষ্ঠুরতা টের পেতে দেননি মা-বাবা। দাদার মৃত্যুর খবরে মা-বাবা ও দুই বোনের সঙ্গে মীম যাচ্ছিলেন খুলনার তেরখাদার বারুখালি গ্রামে। দাদার লাশ দেখার আগেই পথে মর্মান্তিক স্পিডবোট দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান মীমের বাবা মনির মিয়া (৩৮), মা হেনা বেগম (৩৬), ছোট দুই বোন সুমী আক্তার (৫) ও রুমি আক্তার (৩)। দুর্ঘটনার পর মীম ব্যাগ ধরে ভেসে থেকে কোনো রকমে প্রাণ বাঁচায়। মাথায় আঘাতের ক্ষত নিয়ে ঘটনার আকস্মিকতায় এখন নির্বাক মীম।
মা-বাবা ও দুই বোনের লাশ রাখা শিবচরের কাঁঠালবাড়ী দোতারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে মীমকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে লাশ শনাক্তের জন্য নেওয়া হলে তার কান্নায় চোখের কোণে জল জমেছে উপস্থিত সবার। প্রশাসনের কর্মকর্তারা নানাভাবে মীমকে সান্ত্বনা দিয়েও কান্না থামাতে পারেননি। পরিবারে তেমন কেউ না থাকায় এরপর লাশের গাড়ির সামনে বসে মিম তার মা-বাবা ও দুই বোনের লাশ নিয়ে রওনা দেয় তেরখাদার বারুখঅলি গ্রামে।
ছোট শিশুটির মা-বাবা ও দুই বোনের লাশ নিয়ে ছুটে চলার দৃশ্যপট যেন দুর্ঘটনার ভয়াবহতারই জানান দিচ্ছিল। এ সময় প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুজনকে দেওয়া হয় মীমের সঙ্গে। লাশগুলো নিয়ে সোমবার (০৩ মে) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ নিজ বাড়িতে পৌঁছে মীম।
শুধু মীমই নয়, মাতম ছড়ায় ২৬ লাশের স্বজনদের গগনবিদারী আর্তনাদেই। ঢাকা থেকে মা মনোয়ারা বেগমের মৃত্যুজনিত কারণে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় পরিবার নিয়ে যাচ্ছিলেন গৃহবধূ আদুরী বেগম। কিন্তু ভয়াবহ দুর্ঘটনায় স্বামী আরজু শেখ (৪৫) এবং একমাত্র সন্তান ইয়ামিনকে (২) হারিয়ে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত আদুরী যেন পাগলপ্রায়। ক্ষণে ক্ষণে বিলাপ বকছেন। স্বামী ও সন্তানের লাশ নিয়ে মায়ের আহাজারিতে চারদিকে যেন নেমে আসে নিস্তব্ধতা।
এতোবড় দুর্ঘটনায় বেঁচে গেলেও মৃত্যুভয়, সেই সঙ্গে আগামীর অজানা শঙ্কা আর সব হারানোর ব্যথায় কাঁদছে সাত-আট বছরের ছোট্ট মীম। কান্নারত অবস্থায় মীম বলে, 'আমরা দাদু বাড়ি যাচ্ছিলাম। দাদা মারা গেছেন, তাকে দেখতে। আমার আর কেউ নাই'।
মীমের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চাচাদের সঙ্গে ঝগড়ার কারণে তার বাবা মনির মিয়া ঢাকায় টিউশনি করে কোনো রকমে সংসার চালান। দাদার মৃত্যু সংবাদে তারা বাড়ি ফিরছিল। পরিবারের কেউই এখন বাকি রইল না। মীম এখন কোথায় যাবে, কোথায় খাবে? এই প্রশ্ন শোনা বা করারও কেউ আর রইল না। এই প্রশ্ন মনে আসতেই চারদিকে তাকিয়ে কাউকেই আর মিলল না। কারণ লাশ চারটির অভিভাবক যে ওই।
পাগলপ্রায় আদুরীর কাছে প্রশ্ন করার আগে তাঁরই যেন হাজারো প্রশ্ন? কালও তো ছেলে ইয়ামিন তাঁর মুখ থেকে ইফতারি খেয়েছে। বাবাটা এখন কি খাবে? বলে ডান প্রান্তে (লাশের দিক) তাকাতেই গগনবিদারী আর্তনাদ। কোনো সান্ত্বনায়ই তাঁকে থামানো যাচ্ছিল না।
আদুরীর এক স্বজন ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, স্পিডবোটচালক সম্ভবত নেশাগ্রস্ত ছিল। মাঝনদীতে একবার দুর্ঘটনার মতো হচ্ছিল। এরপর এপাড় থেকে এসে ঠিকই সব শেষ। লকডাউনের মধ্যে কিভাবে নিষেধাজ্ঞার মাঝে স্পিডবোট চলে। তাহলে বিআইডাব্লিউটিএ, নৌ পুলিশ, কোস্ট গার্ড, ফাঁড়ি পুলিশ কী করে?
সানবিডি/এএ