আমাদের বেশির ভাগ ছড়াই সিরিয়াস। শক্ত কথার বন্ধন। অথবা অনেক পরোক্ষ বক্তব্যর ইংগিতবাহী। ছড়ার মধ্যে একটা ঝংকার থাকা চাই। একটা ঝরঝরে এবং রিণিঝিনি ভাব থাকা চাই। একটা হালকা মেজাজের ফরফুরে আয়োজন থাকা চাই। যদিও এর খুবই অভাব।
একমাত্র রফিকুল হক (যিনি আমাদের রফিকুল হক দাদুভাই) এর ছড়াতেই সেটি উপস্থিত। তাই তাঁর ছড়া পড়তে খুব বেশি বুদ্ধি প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। আবার তাঁর চানাচুরের মত মুখরোচক ছড়ায় থাকে কাব্যিক বৈশিষ্ট। সব মিলিয়ে রফিকুল হক বাংলা ছড়া সাহিত্যে একটি আলাদা জগতের জমিদার-যার ছড়া পড়তে খাজনা লাগে না।
মানে সহজবোধ্য, সুখপাঠ্য আর পড়তে পড়তে দোল খেতে হয় ছন্দে আনন্দে। রফিকুল হকের ছড়ায় থাকে নাটকীয়তা, দর্শন, নীতি নির্দেশনা, নীতিকথা, প্রশ্নবোধক সমাপ্তি, শেষ হয়েও হয়না শেষ ধারার রেষ, ছোটদের মতো চঞ্চল, অনুকরণ নেই মোটেও, একেবারে স্বকীয় ও স্বতন্ত্র ধর্মের শব্দ বুনন।
রফিকুল হক দাদু ভাই ছড়া বানান। ছড়া বানান হৃদয় দিয়ে। ছড়া লেখেন ছড়া কেটে। ছড়া পড়েন একেবারেই ঠোট দিয়ে। তার উপমা তিনি নিজেই। সমকালীন সমাজচিত্র তাঁর ছড়ায় যে আঙ্গিকে প্রতিফলিত হয় সেটি সম্পূর্ণ এক স্বতন্ত্র কাঠামোর অবয়বে। তিনি ছড়াকার।
তিনি ছোটদের কাগজের সফল সম্পাদক। বাংলা ভাষার, দুই বাংলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় পাক্ষিক কিশোর বাংলার সম্পাদক ও ব্যবস্থাপক ছিলেন তিনি। যেই কাগজটির জন্য শহরের ঘরে ঘরে শিশুরা অপেক্ষা করতো সপ্তাহ ধরে। যেই কাগজে লিখে আজ অনেকেই খ্যাতিমান। যেই কাগজটির অভাব বোধ করছে এখনও এদেশের শিশু কিশোর পাঠকরা।
যারা কিশোর বাংলার সময় শিশু কিশোর ছিলো, আজ প্রবীন তারাও মিস করছে এই প্রকাশনাটি। তিনি সফল সংগঠক। যার হাতে সারা দেশে জেগে উঠেছিলো ছোটদের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন-চাঁদের হাট। যিনি স্বতন্ত্রধর্মী ছড়ার কারিগর। যার ব্যাখ্যা আগেই দিয়েছি।যার ছড়ায় শিল্প কখনও ক্ষুন্ন হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
অনেক শক্ত কথা তিনি বলেন ফান করে। যদিও বলার ক্ষেত্রে তার মধ্যে নেই কোন ভান। স্পষ্টতাই তার ছড়ার ধর্ম। এই স্পষ্টতা কাব্য গুণ নিয়ে। শিল্প গুণ নিয়ে। তাঁর ছড়া যখন তিনি পড়ে শোনান, সে এক অপূর্ব ধ্বনিময়তা। একটার পর একটা ছড়া তিনি পাঠ করতে থাকেন স্মৃতি থেকে। অনুষ্ঠানে এরকম বহু উদাহরণ আছে তাঁকে থামানো যায় না।
ছড়া আবৃত্তিতে তিনি যেনো এক চলন্ত উল্কা ট্রেন। তিনি যে ভিন্ন ধর্মী লেখেন শুধু তাই নয়, তিনি ব্যতিক্রমি ছড়া আবৃত্তিকারও। রফিকুল হক তাই অনেক দিক থেকেই ছড়াকারদের গুরু। ছড়ায় তাঁর কালের সাধুসন্ত। পাঠক সৃষ্টিতে তার ছড়া খুবই কার্যকর। কারণ তার ছড়ায় ছন্দ, মাত্রা ও অন্তমিলে থাকে দারুণ আকর্ষণ। অনবরত ঢেউ। ঢেউয়ের বৃত্ত ছড়িয়ে যায় একের পর এক। যে বৃত্তের আবাহনে আকর্ষণে পাঠক হয় আকৃষ্ট। উৎসাহিত। সৃষ্টি করে সাহিত্যের পাঠক।
রফিকুল হকের কটি ছড়া আমরা এখানেই পড়ে দেখি ? ‘ঞ্চ’ আবিষ্কার করে একটি ছড়ার নানাভাবে সংশ্লিষ্ট শব্দ প্রয়োগ রফিকুল হকের এক অতুলনীয় সৃষ্টি। এরকম উদ্ভাবনী আর কোন ছড়াকারকে করতে দেখিনি। এখানেই রফিকুল হক ব্যতিক্রমি এক ছড়াকার।
ডোঞ্চু
ধঞ্চে কি তা জিগায় জানো
মাঞ্চুরিয়ার পঞ্চু
ইঞ্চি এনে হাড়গিলে ছা
মাপতে বলে চঞ্চু
চীনে ভাষায় চনমনিয়ে
বললে, বাপু ডোঞ্চু ?
খাইকে নাকি খ্ধসঢ়ঞ্চু বলে
যাইকে নাকি যাঞ্চু
খাঞ্চাভরা খাস্তা খাজা
এনেই বলে আঞ্চু
চানখাঁ পুলে চেঁচিয়ে বেচে
“চাই চানাচুর চাঞ্চু !”
এই ছড়ায় দ্যেতনা আছে। ঞ্চ এর সমাবেশ আছে। ব্যঙ্গ আছে। কিছু বার্তাও আছে। আহ কী অসাধারণ এর বুনন ও কাঠামো। আবার তাঁর চেঙ্গিস খান ছড়ায় দেখুন ভিন্নধর্মী অবকাঠামো।
চ্যাংদোলা করে
চেঙ্গিস খান
দেন ছুড়ে
চাওপাও-কে,
রংপুরে গিয়ে
হয়রান বাপ
পান খুঁজে
তার ছাও কে।
তানপুরা কোলে
ওস্তাদ গান
মাঝরাতে
রাগ ভায়রো।
কান ঝালাপালা
চেঙ্গিস খান
রাগ করে
যান কায়রো।
একথা অনেকবার অনেকের মুখে শুনেছি, রফিকুল হক ছড়া লেখেন না , ছড়া বানান। কথা বলতে বলতে বোনেন শব্দের জাল। হাঁটতে হাঁটতে তৈরি করেন ছন্দ-মাত্রা-তাল। তাঁর মতে যদি পড়তে পড়তে ছড়া মনে শরীরে দোলা সৃষ্টি না করে, তবে কিসের ছড়া। আমরা তাঁর ‘হাঁটতে হাঁটতে’ ‘ফুর্তি’ এবং ‘ধুত্তর’ ছড়া পড়লেই তার এইসব বৈশিষ্টের ছাপ দেখতে পাবো।
হাঁটতে হাঁটতে
হাটে গেলাম
হাঁটতে
হাঁটতে
হাঁটতে----
শুধু খাটতে?
-না
মধু চাটতে?
-না
কাদা ঘাঁটতে?
-না
চাঁদা বাটতে?
-না, না !
ছবি সাঁটতে?
-না
খুরি ডাঁটতে
-না
শলা আঁটতে
-না
গলা কাটতে?
-না, না, না!
ঘাটে গেলাম
হাঁটতে
হাঁটতে
হাঁটতে
মাথা ছাটতে।
ফুর্তি
ঘুর ঘুরঘুর
ঘুরতি
হাওয়ায় হাওয়ায়
উড়তি
নীল ফতুয়াও
কুর্তি
আমার যে কি
ফুর্তি!
চড়কার মতো
চক্কর
আজ নয় আর
তক্কর
এই বুঝি লাগে
টক্কর
ঘোরে কাঠ লোহা
লক্কর।
একি তোর হাবা
মূর্তি
শূন্যে দু‘হাত
ছুড়তি
নাগরদোলায়
উড়তি
আমার যে কী
ফুর্তি!
ধুত্তুর
বিড়িম
বিড়িম
বিড়ম্বনা
একি ধুত্তুর ছাই,
রাস্তার যত খেঁকি কুক্কুর
রাত দুক্কুর নাই-
কী যে হই-চই
হই হই
রই রই
আহা ধুত্তুর ভাই!
হিক্কি
হিক্কি
হিক
ওঠে হিক্কা
হলো শিক্কা
ওই পথে যদি যাই,
জ্বালা ধুত্তুর ছাই!
তাৎক্ষণিক দক্ষতার প্রতিফলন এই ছড়াগুলোতে স্বাভাবিক প্রকৃতি ফুটে উঠলেও এর মধ্যেও রয়েছে বক্তব্য, ইংগিত, খোঁচা। রফিকুল হক বরাবরই এই জিনিসটি করেছেন। কেউ শুধু তাঁর ছড়ার ফানটাই দেখেছেন, যারা গভীর চোখ দিয়ে দেখেছেন তারা দেখতে পেয়েছেন তা কতটা তীর্যক। তার ‘কুট্টুস’ শিরোনামের ছড়াগুলোতে তিনি অবশ্য কিছুটা খোলামেলা খোঁচা দিয়েছেন। তাও হাসি তামাসার কাঠামোয়, ভিন্ন মাত্রার বৈশিষ্ট নিয়ে।
সময়কে ধারণ করা রফিকুল হকের অনেক ছড়াই আছে একেবারে কালজয়ী/হৃদয় ছোঁয়া। ১৯৭০ সালে সামুদ্রিক জলোছাসে দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে সমুদ্রের উপকুলের লক্ষ লক্ষ মানুষ যখন বিপর্যস্ত, তখন তিনি
লিখেছিলেন
ছেলে ঘুমলো বুড়ো ঘুমলো ভোলা দ্বীপের চরে
জেগে থাকা মানুষগুলো মাতম শুধু করে
ঘুমো বাছা ঘুমো রে
সাগর দিলো চুমো রে
খিদে ফুরোলো জ্বালা জুড়লো কান্না কেন ছি
বাংলাদেশের মানুষ বুকে পাষাণ বেঁধেছি ।
এই লেখায় রফিকুল হক উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন ভবিষ্যতের সকল প্রজন্মের কাছে। সময়ের চিত্র এইভাবে বয়ে নেয়া যায় ইতিহাসের পাতায় ছড়ার মাধ্যমে, রফিকুল হক তার একজন সফল কারিগর। তাঁর ছড়ায় আমরা পেয়েছি, স্বাধীনতা সংগ্রাম, অধিকারের কথা, প্রতিবাদের শব্দমালা, ইতিহাসে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা-কোন কিছুই বাদ যায়নি তাঁর স্পর্ষ থেকে।
পঞ্চাসের দশক থেকে তিনি উপহার দিয়ে গেছেন শত শত ছড়া। ১৯৮৩ সালে তাঁর প্রথম ছড়ার বই প্রকাশিত হয় যার নাম বর্গি এলো দেশে। এই বইটির নামেই রফিকুল হক প্রমান করেছেন তাঁর ছড়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে। আঙুলে যেমন করে আমরা তুড়ি বাজাই, যেমন করে শিস দেই ঠোটে,
যেমন করে হাসি প্রাণ খুলে তেমন করে রফিকুল হকের ছন্দ মাত্রা গড়াগড়ি করে মিলিত হয় ছড়ার বন্ধনে। তাঁর ছাড়াছাড়ি ছড়াটি তার প্রমান। এই ছড়ায় তিনি লিখেছেন:
জড়াজড়ি
গড়াগড়ি
কাদামাটি
ছড়াছড়ি।
হাতাহাতি
মারামারি
পরিণতি
ছাড়াছাড়ি
বাংলা সাহিত্যের ছড়ার পতাকায় রফিকুল হক দাদুভাই মূর্ত হবেন আজীবন সগৌরবে সমহিমায় সদর্পে। এই নামটি স্থান করে নিয়েছে বাংলা ভাষার অসংখ্য ছড়ালেখক, ছড়া অনুরাগী ও ছড়া কর্মীর অন্তরে।
ফারুক হোসেন, ছড়াকার ও শিশুসাহিত্যিক