দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে এক কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা ব্যক্তির সংখ্যা এখন ৪৫ হাজার ২৫ জন। ২০০৯ সালে কোটিপতি ছিল ২৩ হাজার ১৩০ জন। এ হিসাবে গত ৭ বছরে কোটিপতি আমানতকারী বেড়েছে ২১ হাজার ৮৯৫ জন। বিভিন্ন ব্যাংকে আমানতকারীর অ্যাকাউন্ট পর্যালোচনা করে এসব তথ্য জানা গেছে।
তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে আমানতকারীর অ্যাকাউন্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৫০ কোটি টাকার ওপরে রয়েছে এমন আমানতকারীর সংখ্যা ৫৫৮ জন। ৪০ কোটি টাকার ওপরে রয়েছে ১৮৫ জন। ৩৫ কোটি টাকার ওপরে আমানত রেখেছেন ১৭৩ জন। ৩০ কোটি টাকার ওপরে রেখেছেন ১৮৬ জন। ২৫ কোটি টাকার ওপরে রয়েছে এমন আমানতকারীর সংখ্যা ৩২২ জন। ২০ কোটি টাকার ওপরে রয়েছে ৫৯৯ জন গ্রাহকের। ১৫ কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে ৯৯৮ জনের। ১০ কোটি টাকার ওপরে আমানত রেখেছেন ২ হাজার ৬৬ জন। ৫ কোটি টাকার বেশি আমানতকারী রয়েছেন ৬ হাজার ৬৭০ জন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে ৪৫ হাজার কোটিপতি আমানতকারী দেখানো হলেও এর বাইরে কোটি টাকার সম্পদের মালিক রয়েছেন আরো কয়েক লাখ। এদের কোটি টাকা মূল্যের বাড়ি আছে, গাড়ি আছে এমনকি নগদ টাকাও আছে কোটি টাকার ওপরে। যারা ব্যাংকের বাইরেও আমানত রেখেছেন, নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যেও বিনিয়োগ করেছেন। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ডেভেলপার কোম্পানিসহ নানা কোম্পানিতেও রয়েছে কোটি কোটি টাকার আমানত।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকিং খাতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা কমলেও সমাজে বৈষম্য বাড়ছে। গত তিন মাস বা ৬ মাসের তুলনায় কোটিপতির সংখ্যা সামান্য কমলেও নতুন করে কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন অনেকে। তিনি বলেন, সম্পদের অসম বণ্টন ও অবৈধ আয়ের উৎসের কারণে আয়বৈষম্য প্রকট হচ্ছে। এর মাধ্যমে সম্পদ ক্রমেই কিছুসংখ্যক লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে। এতে ধনী-গরিবের বৈষম্য বাড়ছে। তিনি বলেন, চোখের সামনে কোটিপতিদের একটি বড় অংশ রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে, যা দেশের রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র গবেষক অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, কালো টাকা সঞ্চিত রাখার একটা বড় নিরাপদ স্থান হচ্ছে এফডিআর বা আমানত হিসেবে ব্যাংকে রাখা। তিনি বলেন, যদি ধরেই নেয়া হয় দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তবে ব্যক্তি আয়ও বাড়ছে, যদিও এটি বৈষম্যমূলক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক কোটি টাকার ওপরে আমানত রেখেছেন এমন গ্রাহক গত বছরের মার্চ পর্যন্ত ছিল ৪৩ হাজার ৬৩ জন। আর ৯ মাস আগে অর্থাৎ ২০১৪ সালের ডিসেম্বর শেষে এ সংখ্যা ছিল ৪৩ হাজার ৮০৮ জন। আর ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক কোটি টাকার বেশি আমানতকারী ছিল ৪৯ হাজার ৫৫৪ জন। সে হিসাবে গত ২১ মাসের ব্যবধানে কোটিপতি আমানতকারী কমেছে ৪ হাজার ৫২৯ জন।
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা কমার পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা দেশের বাইরে নিয়ে পাচার করতে পারে। অন্যটি হচ্ছে বর্তমানে স্বর্ণের দাম কমে গেছে। এ কারণে অনেকে স্বর্ণ কিনে রাখতে পারেন।
কোটিপতির সংখ্যা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, পঁচাত্তরের পর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে জনগণের সঞ্চয় এবং বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য কিছু গোষ্ঠীর মধ্যে বিতরণের জন্য ব্যাংকের দরজা খুলে দেয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় আশি ও নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা উঠে আসেন কোটিপতির তালিকায়। নব্বইয়ের দশকে জমি কেনা-বেচা, হাউজিং ও গার্মেন্ট ব্যবসায়ী, চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী, নির্মাণ কাজের ঠিকাদারদের নিয়ে কোটিপতির তালিকায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে পেশাজীবীদের মধ্যে উকিল ও ডাক্তারদের অনেকে কোটিপতির তালিকায় রয়েছেন। এর বাইরে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি করে টোকাই থেকে কোটিপতি হয়েছেনÑ এমন অসংখ্য উদাহরণও রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের পরিমাণ ৭ লাখ ৬১ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে কোটিপতিদের দখলে রয়েছে ৬৮ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। অপর এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতির সংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচজন। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ জনে। জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে (ডিসেম্বর ১৯৮০) এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৮ জনে। তখন তাদের আমানতের পরিমাণ ছিল ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের ১০ শতাংশ।
এরশাদ সরকারের পতনের সময় ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪৩ জন ও ব্যাংকে তাদের আমানতের পরিমাণ ছিল ১২ শতাংশ। এ ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালের জুনে কোটিপতির মোট সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫৯৪ জন ও কোটিপতিদের আমানতের পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ২০ শতাংশ। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে কোটিপতির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজার ১৬২ জন। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার আগে ২ বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে (২০০৭-০৮) ৫ হাজার ১১৪ জন। এরও আগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে (অক্টোবর ২০০১-ডিসেম্বর ২০০৬) কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৮৮৭ জনে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৮ সালে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে এক কোটি টাকার ওপরে হিসাব সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ১৬৩টি। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর শেষে এ সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ১৩০টি। ২০১০ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষে এর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯ হাজার ৫৩৭টি। ২০১১ সালের ডিসেম্বর শেষে এক কোটি টাকা লেনদেনের হিসাবের সংখ্যা ছিল ৩৫ হাজার ৬৯৮টি। পরের বছর ব্যাংকগুলোতে এক কোটির ওপরে থাকা হিসাব সংখ্যা ছিল ৪৩ হাজার ৭১২টি।