বিদেশেপাচার হয়ে যাচ্ছে দেশের টাকা-বিরোধীদলের সংসদ সদস্যদের এমন অভিযোগের পর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ‘নামগুলো আমাদের দেন। কাজটি করলে আমাদের জন্য সহজ হবে। এখনো অনেকেই জেলে আছে। বিচার হচ্ছে। আগে যেমন ঢালাওভাবে চলে যেত, এখন তেমন নেই। কারা টাকা নিয়ে যায়, লিস্ট আমার কাছে নেই।’
সোমবার (৭ জুন) সংসদে মঞ্জুরি দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ছাঁটাই প্রস্তাব তোলার সময় বিভিন্ন সংসদ সদস্যের সমালোচনার পর মন্ত্রী এসব কথা বলেন।
এর আগে মঞ্জুরি দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ছাঁটাই প্রস্তাব তোলার সময় বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদ বলেন, ‘স্কুলে অংকে ভালো ছিলাম। শিক্ষকরা আদর করতেন। কিন্তু বাজেটের অংকের হিসাব মেলাতে পারছি না। ঘাটতি কোথায়? কোথা থেকে টাকা আনব? প্রবৃদ্ধির কথা বলছি। করোনাকালীন সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে করোনা নিয়ন্ত্রণে। না হলে প্রবাস আয়, গার্মেন্টর খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রবৃদ্ধির জন্য লাফাচ্ছি। সূচের ফোটা দিলে বেলুনের মতো চুপসে যাবে। করোনা নিয়ন্ত্রণ না হলে গার্মেন্টস আর প্রবাসী আয় কমে যাবে।
করোনা নিয়ন্ত্রণ না করলে ভয়ানক ধস নামবে। শেয়ারবাজার শুয়ে গেছে একেবারে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানসত্য কথা বললে সরকারি দলের সদস্যরা বেজার হয়ে চিল্লাচিল্লি করবেন। দুর্নীতির কারণে আর্থিক খাত ক্ষতিগ্রস্ত। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা জিরো টলারেনন্স। অর্থমন্ত্রী বললেন, অপ্রদর্শিত আয় নিয়ে। এটা সাংঘর্ষিক। দুর্নীতি, মাদক, অর্থআত্মসাতের মাধ্যমে বিত্ত গড়ে তুললে তাকে সুযোগ দিয়ে ন্যায় করা হবে না। বেহাল দশা থেকে জাতি থেকে মুক্ত করতে হলে…করোনাকালীন সময়ে দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মেগা প্রকল্প বাদ দেন।’
বিএনপির আরেক সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা বলেন, ‘যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, শেয়ারবাজার শুয়ে পড়ে। ৯৬ সালে, ২০০৯ সালে শুয়ে পড়লো। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী বললেন, তিনি শেয়ারবাজার বোঝেন না। শেয়ার বাজার ফটকা বাজার। সেই অর্থমন্ত্রী স্পষ্ট কথা বলতেন, দলের বিপক্ষে গেলেও বলতেন। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে পরিবারের হাতে ব্যাংক তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। জনগণের টাকার হরিলুট হচ্ছে। সংসদে ঋণ খেলাপির তালিকা দেয়া হলো। ৩০০ জন। তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হলো? বিদেশে ১ লাখ কোটি টাকার ওপরে চলে যাচ্ছে। ওভার আর আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে যাচ্ছে। এর বাইরে হুন্ডির পরিমাণ ধরলে আল্লাহ মাবুদ জানেন কত টাকা বিদেশে গেছে!’
জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘আর্থিক খাতে অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্ব সঠিক। কর্তৃত্ব দুর্বল। ব্যাংকে কর্তৃত্ব নেই। কর্তৃত্ব না থাকলে অবাধে এসব হবে। এক ব্যাংকের পরিচালক আরেক ব্যাংকের টাকা নিচ্ছেন। টাকা নিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশ পাঠাচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘দুদকের একটি অফিস কানাডায়, মালয়েশিয়ায়, অস্ট্রেলিয়ায় করুন। তাহলে দেখা যাবে কে কত টাকা নিয়েছেন। পিকে হালদার এত টাকা নিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংক অডিট করলে চুরির করার সুযোগ থাকে না। অর্থমন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের বসে কী করবেন। দোষ হয় মন্ত্রীর। অডিট করলে টাকা পাচার হয় না। নয় মিনিটের জন্য পিকে হালদারকে ধরতে পারেনি। তাহলে নয় ঘণ্টা আগে ধরতে পারলেন না কেন?’
জাতীয় পার্টির রওশন আরা মান্নান বলেন, ‘ব্যাংকিং খাত, আর্থিক প্রতিষ্ঠান নির্যাতিত এতিমদের মতো। দেখার কেউ নেই। লুটপাট হচ্ছে। দুর্নীতি হচ্ছে। কিছুই হয় না। শাস্তি হয় না।’
এসবের জবাবে অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ‘১২ বছরে ঋণের সুদহার ১২.১ ভাগ থেকে কমে ৭.৩ ভাগ হয়েছে। এখন ব্যাংকের শাখা দ্বিগুণ হয়েছে। চাহিদা বেড়ে গেছে। গ্রামে গ্রামে ব্রাঞ্চ হয়েছে। দেশের মানুষ সেবা পাচ্ছেন। ২০০৬ সালে খেলাপি ঋণের হার ছিল ১৩.৬ শতাংশ। এখন আট শতাংশে নেমে এসেছে। ২০০৬ সালে টোটাল লোন আউটস্ট্যাডিং ছিল ১ লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকা। যা এখন আটগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১১ লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা হয়েছে।’
পুঁজিবাজারের সমালোচনার জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘পুঁজিবাজার কেমন করে বসে গেল? পুঁজিবাজারে হয়তো লেনদেন নেই। পুঁজিবাজার সম্পর্কে তথ্য রাখেন না, হয়তো সেজন্য বলছেন। যদি ডাটা দেখি, যখন ক্ষমতায় আসি তখন পুঁজিবাজারে লেনদেন এক লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা ছিল। তা এখন পাঁচ গুণ বেড়েছে। গড় লেনদেন ছিল দৈনিক ২৮ কোটি টাকা যা এখন ৩০ গুণ বেড়েছে। তাহলে ধসে গেল কেমন করে?’
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মঞ্জুরি দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা বিভিন্ন ছাঁটাই প্রস্তাব আনেন। ওই সব ছাঁটাই প্রস্তাব তোলার সময় বিরোধী সংসদ সদস্যরা বিদেশে টাকা পাচার, পুঁজিবাজারের অব্যবস্থাপনাসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সমালোচনা করেন।
এসব সমালোচনার জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের মানুষের কষ্টে অর্জিত টাকা বিদেশে চলে যাবে, আপনাদের যেমন লাগে, আমারও লাগে। আমি অনিয়ম, বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে। আমরা সবাই চাই, এগুলো বন্ধ করতে হবে। বন্ধ হচ্ছে। আগের মতো অবস্থা নেই। আগে সিমেন্টের নাম করে বালি আসতো। একটার নাম করে আরেকটা আসতো। আন্ডারইনভয়েসিং, ওভারইনভয়েসিং আগের মতো হয় না। একদম বন্ধ হয়ে গেছে বলবো না। পত্রপত্রিকায় দেখতে পাই না।’
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘আগামী ছয় থেকে ১২ মাসের মধ্যে ১৫টি আইন দেখতে পারবেন। এগুলো বন্ধ করার জন্য। আমি নিজে জানি কীভাবে এগুলো হয়। কারা করে জানি না। অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, ইনএফেকটিভ ম্যানেজমেন্টের জন্য এগুলো হয়। আমরা সংস্কারমুখী কাজ করবো। নতুন নতুন আইন করবো। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে দায় নিয়ে কাজ করতে পারে, সে ব্যবস্থা করে দেব। কোনো টলারেন্স নেই এখানে। টাকা এখন দেশে আসে।’