প্রাকৃতিক নৈস্বর্গের লীলাভূমি খ্যাত বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। অপরিমেয় সৌন্দর্যবিস্তৃত এই দেশ যুগ যুগ ধরে বিদেশি পর্যটকদের পাড়ি দিয়ে এনেছে নিজের কাছে। বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি। পর্যটনকে শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করায় বাংলাদেশে এ শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ১৪৫ কোটি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৩ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ২০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। আর বিপুলসংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৮০ শতাংশ ভ্রমণ করবেন এশিয়ার দেশগুলোতে। ২০২৩ সালের মধ্যে এ শিল্প থেকে ২৯ কোটি ৭০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রাখবে ১০ দশমিক ৫ শতাংশ (সূত্র: WTTC)। বাংলাদেশ যদি এ বিশাল বাজারে টিকে থাকতে পারে, তাহলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে দেশের অর্থনীতির রূপরেখা। আর সেই সাথে আধুনিক সব স্থাপত্য। তবে এসবকিছুই নির্ভর করছে করোনা পরিস্থিতির উপর। করোনা প্রভাবে হাতে গোনা কয়েকটি দেশ ছাড়া প্রতিটি দেশেই বন্ধ ছিল পর্যটন শিল্প। যদিও ২০২১ সালে করোনার টিকা আসার পর আবারো সতেজ হয়ে উঠছে বন্ধ হয়ে যাওয়া দেশগুলোর পর্যটন খাত।
২০১৪ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পর্যটন খাতে প্রতি বছর যে হারে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে সে হিসেবে ২০২৪ সালে মোট কর্মসংস্থানের মধ্যে পর্যটন খাতের অবদান দাঁড়াবে ১ দশমিক ৯ শতাংশ। পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সেক্টরে যেমন-পরিবহন, হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, রিসোর্ট, এয়ারলাইনসসহ অন্যান্য যোগাযোগের মাধ্যম থেকে পৃথিবীর অনেক দেশ প্রতিবছর প্রচুর রাজস্ব আয় করে, যা অন্য যেকোনো বড় শিল্প থেকে পাওয়া আয়ের চেয়ে বেশি। ইতিমধ্যে পর্যটনকে বিশ্বের বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর এক-তৃতীয়াংশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস পর্যটনশিল্প। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ১০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ তাদের জীবন-জীবিকার জন্য এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। সমগ্র বিশ্বে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ পর্যটন থেকে প্রতিবছর ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়েছিল।
২০২০ সালে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীর পরিসংখ্যান থেকে পরিলক্ষিত হয়, বিশ্বে ২০০টি শহরের মধ্যে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যংককে ভ্রমণ করেছেন প্রায় ২৪ দশমিক ৭ মিলিয়ন পর্যটক। পর্যটকদের কাছে বিশ্বের অন্যান্য জনপ্রিয় শহর হলো প্যারিস (ফ্রান্স), দুবাই (সংযুক্ত আরব আমিরাত), সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর (মালয়েশিয়া), নিউইয়র্ক (আমেরিকা), ইস্তাম্বুল (তুরস্ক), টোকিও (জাপান) ও অন্যান্য শহর। অপর দিকে পর্যটকেরা সবচেয়ে বেশি খরচ করেছেন দুবাইয়ে (৩০ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার), সৌদি আরবে (২০ দশমিক শূন্য ৯ বিলিয়ন ডলার), ব্যাংককে (২০ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলার)। থাইল্যান্ডে ভ্রমণে আসা পর্যটকদের মধ্যে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, যুক্তরাজ্য উল্লেখযোগ্য। ২০০৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে এশিয়া-প্যাসিফিক শহরগুলোতে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৯ শতাংশ, যার অন্যতম কারণ চীনের পর্যটক বৃদ্ধি। তালিকায় শীর্ষে থাকা বিভিন্ন দেশের পর্যটকের সংখ্যা বেড়েছে, তবে লন্ডনে পর্যটক হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৪ শতাংশ।
উন্নত বিশ্বে ভ্রমণপিপাসু মানুষ সারা বছরই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে থাকে। বিগত এক দশকে (২০১০-২০২০) সারা বিশ্বে পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ (সূত্র:WTTC)। ক্রমান্বয়ে পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি আজ পর্যটননির্ভর হয়ে উঠছে।
ভ্রমণপিপাসুদের আকৃষ্ট করতে আন্তর্জাতিক মানের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বিভিন্ন দেশ। ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি পর্যটক ভ্রমণ করেছেন ফ্রান্স, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইতালি। এর মধ্যে ফ্রান্সে ৯০ দশমিক ৪ মিলিয়ন, স্পেনে ৮৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রে ৮০ দশমিক ৬ মিলিয়ন, চীনে ৬২ দশমিক ৯ মিলিয়ন, ইতালিতে ৬১ দশমিক ২ মিলিয়ন পর্যটক (সূত্র: UNWTO)।
উন্নত বিশ্বে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার পর্যটন। আর সেই পর্যটনের অপার সম্ভাবনায় বাংলাদেশ। এখন প্রতিবছর প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ লাখ পর্যটক দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে ভ্রমণ করে থাকেন। ২০১২-১৩ সালের এ সংখ্যা ছিল প্রায় ২৫-৩০ লাখ, যা ২০০০ সালের দিকে ছিল ৩-৫ লাখ। জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের ফলে সাধারণ মানুষের কাছে ভ্রমণপিপাসা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে বিধায় আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে অনন্য অবদান রাখছে। বাংলাদেশে পর্যটন খাতে সরাসরি কর্মরত আছেন প্রায় ১৮ লাখ মানুষ। এ ছাড়া পরোক্ষভাবে ২৭ লাখ। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো এই শিল্পকে প্রাধান্য দিয়ে দেশীয় অর্থনীতিকে গতিশীল করেছে অথচ এখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অনুযায়ী পর্যটনশিল্পের উন্নয়ন করতে পারেনি বাংলাদেশ। উল্লেখ্য, সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৭৫, তাইওয়ানের ৬৫, হংকংয়ের ৫৫, ফিলিপাইনের ৫০ এবং থাইল্যান্ডের ৩০ শতাংশ পর্যটনের অবদান। মালদ্বীপের জাতীয় অর্থনীতির অধিকাংশ ও মালয়েশিয়ার জিডিপির ৭ শতাংশ পর্যটনশিল্পের অবদান।
বর্তমানে বাংলাদেশের পর্যটন খাতে আয় প্রায় ৭৮ দশমিক ১৯ মিলিয়ন ডলার। ভারত আয় করেছে ১০ হাজার ৭২৯ মিলিয়ন ডলার, মালদ্বীপ ৬০২ মিলিয়ন ডলার, শ্রীলঙ্কায় ৩৮৫ মিলিয়ন ডলার এবং নেপালে ১৯৮ মিলিয়ন ডলার, যা সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশের তুলনায় অপ্রতুল। করোনার প্রবনতা কমে স্বাভাবিক পর্যায়ে পৌছালে বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০২৩ সাল নাগাদ পর্যটনশিল্প থেকে প্রতিবছর ২ ট্রিলিয়ন ডলার আয় হবে। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৫১টি দেশের পর্যটকেরা বাংলাদেশে ভ্রমণ করবেন, যা মোট জিডিপির ১০ শতাংশ অবদান রাখবে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৪ সালে মোট কর্মসংস্থানের ১ দশমিক ৯ শতাংশ হবে পর্যটনশিল্পের অবদান (WTTC)। পর্যটনশিল্পের অপার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার রোল মডেল।