উভয় সংকটে ট্যানারি মালিকেরা

প্রকাশ: ২০১৬-০১-১৮ ১৫:০৭:১৮


ট্যনারীহাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরের জন্য একদিকে সরকারের আল্টিমেটাম, উকিল নোটিশ; অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের ধরে রাখার চেষ্টা। সব মিলিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে উভয় সংকটে পড়েছে ট্যানারি মালিকেরা।

হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প ৫০ থেকে ৬০ বছরের পুরনো। হাইকোর্টের নির্দেশ, আন্তর্জাতিক চাপ ও সরকারের সহযোগিতায় এ শিল্প সাভারে স্থানান্তর করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। তবে সাভারের চামড়া শিল্পনগরীর সেন্ট্রাল ইটিপির কাজ এখনো শেষ হয়নি। ডিসেম্বরে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কাজ এখনো চলছে। কাজ অসমাপ্ত রেখে মালিকদের প্লটের কাজ শেষ করার তাগিদ দিচ্ছে সরকার। অন্যদিকে হাজারীবাগে অবস্থান করে ট্যানারি শিল্প কমপ্লায়েন্স পরিপালন করতে না পারায় বিদেশি ক্রেতারা আগ্রহ হারাচ্ছে।

ট্যানারি মালিকেরা বলছেন, সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে তাদের প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বালুর মধ্যে কাজ করতে গিয়ে সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের যে সহায়তা দিচ্ছে কাজ করতে তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ লাগছে। এ ছাড়া হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্পের প্রজেক্টে যে অর্থ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে সাভারের নতুন করে স্থানান্তরে ব্যাংকগুলো নতুন কোনো লোন দিচ্ছে না। এই অবস্থায় সরকারের উকিল নোটিশও একটি নেতিবাচক দিক বলে মনে করছেন তারা।

নাম প্রকাশ না করে একজন ট্যানারি মালিক বলেন, সাভারে চামড়া শিল্পনগরীতে বরাদ্দ পাওয়া প্লটে স্থাপনা করতে ৭০ থেকে ৮০ ফিট নিচে থেকে পাইলিং করতে হয়। সরকার যে অর্থ দিচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয়। যেহেতু ট্যানারি কারখানায় ব্যবহৃত মেশিন অনেক ভারী, তাই স্থাপনা শক্তিশালী না হলে যেকোনো মুহূর্তে রানা প্লাজার মতো ধসের ঘটনা ঘটতে পারে। তাই এত নিচ থেকে পাইলিং করতে বেশি অর্থ খরচ হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ট্যানারি স্থানান্তরের সময় ক্ষতিগ্রস্তদের ব্যাংক ঋণের সহায়তা করেছে সরকার। কিন্তু এখানে ব্যাংক ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণসুবিধা দিলে দ্রুত কারখানা স্থাপনের কাজ শেষ করা যাবে।

বাংলাদেশে ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান (মিজান) বলেন, ‘যারা শিল্পনগরীতে প্লট বরাদ্দ পেয়েছে তারা ট্যানারি স্থানান্তরে প্রস্তুত, অনেকে সেখানে কাজ করছে। স্থানান্তর এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তবে শিল্পনগরীর ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যাটের কাজ এখনো শেষ হয়নি। সেইসঙ্গে সিইটিপি এবং সলিড বর্জ্য ডাম্পিং করার জন্য স্টেশনের কাজও হয়নি। বিশেষ করে ওয়াটার ট্রিটমেন্টের কাজ শেষ হলেও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান সাভারে স্থানান্তর ত্বরান্বিত করে কার্যক্রম চালাতে পারত।’

সরেজমিনে হাজারীবাগ ইব্রাহিম ট্যানারির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, কারখানা সাভারে স্থানান্তরে সময় লাগবে। কারণ সেখানে এখনও কাজ চলছে। নোটিশ দিয়েছে সরকার, তার জবাব দিয়েছেন তারা। এ নোটিশের কারণে ব্যবসায়িক ভিত্তি নষ্ট হয়েছে।

তারা জানান, রপ্তানিমুখি প্রতিষ্ঠানের চুলচেরা তথ্য দিয়ে বিদেশে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করতে হয়। বিদেশি বায়াররা যখন একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সরকারের উকিল নোটিশের কথা জানবে, তখন ওই কোম্পানি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা জন্ম নেবে, যা এ খাতকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট।

হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভারে স্থানান্তরে সরকারের দেয়া উকিল নোটিশের সময় শেষ হচ্ছে আজ (সোমবার)। গতকাল রোববার বিকেল পর্যন্ত ৫-৬টি প্রতিষ্ঠান নোটিশের জবাব দিয়েছে। নোটিশের জবাব দিলেও স্থানান্তরে আরও সময় চেয়েছেন ট্যানারি মালিকেরা।

ইউসূফ ট্যানারির মালিক বলেন, ‘সরকার ইচ্ছে করলে হাজারীবাগের কারখানা বন্ধ করে দিতে পারে, কিন্তু তার আগে সাভারের কাজ শেষ করা উচিত। যাতে সেখানে গিয়ে ব্যবসায়ীরা প্রতিষ্ঠান চালাতে পারে।’

এর আগে সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে ট্যানারি স্থানান্তরে প্লট বরাদ্দ ও সরকারি অর্থ সহায়তা নেয়ার পরও যেসব প্রতিষ্ঠান এখনো কাজ শুরু করেনি তাদের উকিল নোটিশ দেয় সরকার। গত বুধবার বেলা ১২টায় নোটিশ দেয়া হয়। নোটিশ প্রাপ্তির তিন কার্যদিবসের (৭২ ঘণ্টা) মধ্যে জবাব দেয়ার জন্য উল্লেখ করা হয়।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জবাব দিতে ব্যর্থ হলে বা সাভারে ট্যানারির কাজ শুরু না করলে তাদের গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হবে বলে জানানো হয়। উকিল নোটিশ পাঠান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শহীদুল ইসলাম। এর আগে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ট্যানারি স্থানান্তরে ৭২ ঘণ্টা আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। সেই আল্টিমেটামের সময় পার হওয়ার পর আরও ৭২ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়ে উকিল নোটিশ পাঠানো হয়।

চামড়া শিল্পনগরীর প্রকল্প পরিচালক মো. আবদুল কাইউম বলেন, ‘আমরা এ পর্যন্ত ২৭ বার তাগিদ দিয়েছি সাভারে ট্যানারি কারখানা স্থাপনকাজ ত্বরান্বিত করতে। এর পরও অনেকে কাজ শুরু করেননি।’ তিনি বলেন, ‘২৮টি প্রতিষ্ঠান ক্ষতিপূরণের ২০ শতাংশ অর্থ নিয়েও সাভারের দৃশ্যমান কোনো কাজ করেনি। তাই তাদের নোটিশ দেয়া হয়েছে। এর পরও যারা কাজ করেনি তাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

প্রসঙ্গত, উচ্চ আদালতের নির্দেশে পরিবেশ দূষণের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকার ২০০৯ সালে হাজারীবাগের চামড়া শিল্প স্থানান্তরের উদ্যোগ নেয়। এক হাজার ৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে সাভারে চামড়া শিল্পনগরী স্থাপন করেছে সরকার। ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২৫০ কোটি টাকা অর্থিক সহায়তা দেবে সরকার।

এদিকে চামড়া শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করতে প্রয়োজনীয় কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতে ইউরোপীয় ক্রেতাদের দিক থেকেও ওই এলাকায় ট্যানারি কারখানাগুলো স্থানান্তরের চাপ রয়েছে। এমনকি পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত শিল্পের শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞারও আশঙ্কা রয়েছে। তাই ট্যানারি স্থানান্তর জরুরি বলে মনে করছে সরকার।

সানবিডি/ঢাকা/বাংলামেইল/আহো