"শিক্ষকদের জন্য শুধু প্রশংসা নয়, তাঁদের মজুরি বৃদ্ধিও জরুরি"
কথা গুলো আমার নয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের। তাইতো কথাগুলো পত্রিকায় শিরোনাম হয়ে সামাজিক মাধ্যমে ঘুরছে-ফিরছে দুদিন ধরে।
শুধু কি তাই?
না। শুধু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বলেছেন বলেই নয়, কথা গুলোর মাহাত্ম্য আমাদের অন্তরকে দোলা দেয় বলেই কথা গুলো ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে!
শিক্ষকের মর্যাদা ছাত্রের অন্তরে সবসময়ই আছে। তবে এই মর্যাদা সালাম আদাব বা কদমবুচির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে যুগে যুগে। এই ছাত্রটি যখন বড় আমলা হন বা মন্ত্রী হন, তখন বেমালুম ভুলেই যান শিক্ষককে!
নয়তো শিক্ষকের মর্যাদার প্রশ্ন মার্কিন মুল্লুকেই নতুন করে এভাবে সামনে আসবে কেন! এটাতো মীমাংসিত বিষয় হওয়ার কথা ছিল!
আমাদের দেশে শিক্ষকদের মর্যাদা এতটুকুই দৃশ্যমান যে, ছাত্র বা ছাত্রের বাবা তাদের স্যার বলে সম্বোধন করে, আদাব সালাম! কিন্তু এসবে মন ভরলেও কি পেট ভরে? এই পরিতৃপ্তিতে পেটের ভাত, গায়ের জমা যে জুটেনা, তা শিক্ষক সমাজ বিভিন্ন ভাবে রাষ্ট্রকে বুঝাতে সচেষ্ট থেকেছে, রাস্তায় আন্দোলন করেছে; ক্ষেত্র বিশেষ রাষ্ট্র তাদের দাবীদাওয়া মেনেও নিয়েছে! যেমন ধরুন, দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব শিক্ষককে ১৩তম বেতন গ্রেড এবং প্রধান শিক্ষকে ১০ গ্রেড প্রদান করা; হাজার হাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারি করণ করা; হাজারে হাজার বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের এমপিও ভুক্তি করা; স্কুল কলেজের অবকাঠামো উন্নয়ন বা ডিজিটালাইজেশ করা ইত্যাদি।
হ্যা, আমি অস্বীকার করছি না যে শিক্ষা তথা শিক্ষকদের মর্যাদাবৃদ্ধিতে সরকার সচেষ্ট নয়, কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক গতিকে টেকসই করতে একদিকে দক্ষ অপরদিকে উন্নত মননের জনশক্তি দরকার। তাই বঙ্গবন্ধু কন্যার কাছে শিক্ষকদের পক্ষে সাফাই গায়ছি। প্রত্যাশাটুকু একজন নাগরিক হিসাবে, জাস্ট এইটুকুই!
শিক্ষকদের মর্যাদা প্রশ্নে রসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন, 'ঐ ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারও পদ-গৌরব লোভনীয় নয়; তিনি ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ বিদ্যা দান করেছেন এবং সে অনুসারে সে কাজ করে ও অপরকে শিক্ষা দেয় (বুখারি :৭১)।
আল্লাহর রাসুল (সা.) আরও বলেছেন- 'আল্লাহর পরে, রাসুলের পরে ওই ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা মহানুভব, যে বিদ্যার্জন করে ও পরে তা প্রচার করে (বুখারি :৪৬৩৯)।
শিক্ষকেরা হচ্ছেন মোমবাতির মতো। নিজে জ্বলে, অন্যকে আলোকিত করেন। শত প্রতিকূলতায়ও নিজের দুঃখ–কষ্টের কথা কাউকে বলেন না। এই করোনা কালীন বেসরকারি শিক্ষকরা যে কতটা কষ্টে আছেন তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। যেমনঃ অনেক বেসরকারি শিক্ষকের, কিন্ডারগার্টেনের বা খন্ডকালীন শিক্ষকদের বেতন বন্ধ রয়েছে, আয় নেই বললেই চলে; প্রথমে সঞ্চয় ভেঙ্গে, পরে ধার দেনা করে খাওয়া শেষ! করোনার মহামারিতে তাঁরা যে প্রাইভেট পড়াবেন সে সুযোগটুকু নেই! পেটতো মানে না! তবুও পেটে খিদে চেপে ঐ আদাব সালামের মর্যাদাবোধ নিয়ে তাঁরা সমাজে হাসি মুখে টিকে আছেন! কিন্তু এভাবে আর কতদিন? সরকারি শিক্ষকদের কথা না হয় আলাদা।
তবু মনে করি, সরকারি শিক্ষকদের মর্যাদাও অপ্রতুল!
সম্প্রতি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র শিক্ষক হয়েছেন। এটি খুশির সংবাদ। কিন্তু আমি খুশি হতে পারিনি এজন্য যে, তাঁরা লিখেছেন, তাঁরা প্রথম শ্রেণীর (নবম গ্রেড) পদমর্যাদাভূক্ত হয়েছেন।
আমি এজন্য খুশি হয়নি যে, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে শিক্ষক মানেই জন্মগত প্রথম শ্রেণীর। কি প্রাথমিক, কি উচ্চ শিক্ষা স্তরের। এদেশে যেদিন সব শিক্ষক যোগদানের দিন প্রথম শ্রেণীর পদমর্যাদা পাবে, সেদিনই কেবল আমার মন খুশিতে ভরে উঠবে, নচেত না!
শিক্ষকতা একটি পেশাই নয়, এটি একটি মহান ব্রত। শিক্ষক শব্দটির সঙ্গেই যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে জ্ঞান, দক্ষতা, সততা, আদর্শ ও মূল্যবোধ! জাতি গঠনে এগুলো ভীষণ দরকার। জাতীয় জীবনের উৎকর্ষ সাধনের জন্য একজন শিক্ষক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই মূলমন্ত্রগুলো আলোক শিখার মতো বিলিয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠন করে চলেন। আর এভাবেই গঠিত হয় একটি সুসভ্য জাতি। তাই তাদেরকেই জাতি গঠনের কারিগর বলা হয়।
বৈশ্বিক পরিবর্তনের সাথে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ ঘোষিত এমডিজি (মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল) গুলো অর্জন করে এখন এসডিজির সবগুলো সূচকেই ভাল করছে। জনগণের কর্মদক্ষতা ও যোগ্য নেতৃত্বের গুনে সম্প্রতি এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটেছে বাংলাদেশের। ২০২৬ সালে অফিসিয়াল ভাবে উন্নয়নশীল দেশ হবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখন তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, উন্নয়নের রোল মডেল, অর্থনৈতিক টাইগার। একে একে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নের দিকে। অর্থাৎ ২০৪১ সালে আমরা উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ ও জাতি হবো। বিশ্বে আমরা মাথা উচু করে দাঁড়াবো। এই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি ধরে রাখার জন্য অর্থাৎ টেকসই করার জন্য গৃহীত হয়েছে ডেল্টা প্ল্যান-২১০০!
কিন্তু! হ্যা, এখানে একটি কিন্তু থেকে যায়! সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ পরিচালনা করতে সোনার মানুষ (জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ, সৎ, আদর্শ ও মানবিক) প্রয়োজন হবে।
আর সব শ্রেণীর শিক্ষকদের সম্মান, মর্যাদা ও যথার্থ পারিশ্রমিক না দিয়ে ঐ সোনার মানুষ গঠন করা কি সম্ভব হবে?
আর শিক্ষক তথা শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য পৃথক কর্ম পরিকল্পনা থাকা কি জরুরি নয়?
(লেখাটি আমার সকল শিক্ষককে উৎসর্গকৃত)।
লেখক,
ক্লিন এন্ড গ্রিন ফাউন্ডেশন ও গরিব ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা।
সানবিডি/এন/আই