পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে গ্রাহকদের টাকা সংরক্ষণের ক্লিয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কৌশলগত বিনিয়োগকারী। ডিএসইর ১০০৫ তম পর্ষদ সভায় তারা এ প্রস্তাব দেন। ইতোমধ্যে এই প্রস্তাব নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কাছে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে একটি সূত্র।
সূত্র মতে,কৌশলগত বিনিয়োগকারী চীনের শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ মনে করে এর মাধ্যমে গ্রাহকদের স্বার্থ খুব সহজেই রক্ষা করা সম্ভব। এটি করা হলো কোন ব্রোকার কনসোলিডেটেড কাস্টমারস অ্যাকাউন্টের (সিসিএ) টাকা নিয়ে নয়-ছয় করতে পারবে না। ফলে বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি মুক্ত থাকবে। তবে এটি কার্যকর করার জন্য বাংলাদেশে কোনো নীতিমালা নেই। এটি বাস্তবায়ন করতে হলো বিএসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংক মিলে একটি আইন করতে হবে। যাতে করে গ্রাহকদের টাকার সুরক্ষা দেওয়া যায়।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর চীনা কনসোর্টিয়ামের কাছে সাড়ে ৯শ’ কোটি টাকায় ২৫ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা হস্তান্তর করে ডিএসই। এর আগে ১৪ মে শেনঝেন-সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের চীনা কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে চুক্তি সই করে ডিএসই। কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে চীনা জোট ডিএসইর ২৫ শতাংশ বা ৪৫ কোটি ৯ লাখ ৪৪ হাজার ১২৫টি শেয়ারের মালিক।
পুঁজিবাজারের সব খবর পেতে জয়েন করুন
Sunbd News–ক্যাপিটাল নিউজ–ক্যাপিটাল ভিউজ–স্টক নিউজ–শেয়ারবাজারের খবরা-খবর
ডিএসই সূত্র মতে, সাম্প্রতিক সময়ে ডিএসইর কয়েকটি সদস্য কনসোলিডেটেড কাস্টমারস অ্যাকাউন্টের (সিসিএ) টাকা নিজেদের মতো করে ব্যবহার করেছে। এতে করে বিনিয়োগকারীদের মনোবলে চির ধরেছে। নষ্ট হয়েছে পুঁজিবাজারের সুনাম। এটি বন্ধ করা না গেলে আগামীতে আরও বেশি মাশুল দিতে হবে বলে মনে করে ডিএসইর কৌশলগত বিনিয়োগকারী।
তার প্রস্তাবে বলা হয়, এক সময় চায়নাতেও অনেক ব্রোকার এই কাজ করতো। নিজেদের মনমতো গ্রাহকদের টাকা ব্যবহার করতো। পরবর্তীতে তৃতীয় পক্ষকে মানে ক্লিয়ারিং ব্যাংকে এই দায়িত্ব দেওয়ার পর থেকে গ্রাহকদের টাকার তছরুপ বন্ধ হয়েছে। বর্তমানে ডিএসইতে আটটি ব্যাংক ক্লিয়ারিংয়ের জন্য তালিকাভুক্ত। ব্যাংকগুলো হলো রুপালী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, সিটি ব্যাংক,পূ বালী ব্যাংক, আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, এসআইবিএল এবং মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড।
এ বিষয়ে ডিএসইর চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান বলেন, কৌশলগত অংশীদারের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ নিতে পারে ডিএসই। বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। তবে ডিএসই শিগগিরই সিসিএ মনিটরিং সম্পর্কিত একটি প্রস্তাব বিএসইসির কাছে দিবে ডিএসই।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার অধ্যাপক ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, ডিএসইর কৌশলগত বিনিয়োগকারী চীনের শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ গ্রাহকদের স্বার্থে যদি এমন প্রস্তাব দেয়, তাহলে তাদেরকে সাধুবাধ। পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় কমিশন।
তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এডিবির অর্থায়নে রেগুলেটরি ইনফরমেশন সিস্টেসম ন(আরআইএস) নিয়ে কাজ চলছে। আমরা গ্রাহকদকেদর সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে (সিসিএ) আরও স্বচ্ছতা আনতে চাই। যাতে করে তারা কোনভাবেই প্রতারিত না হয়।
গত ২৮ জুন পুঁজিবাজার থেকে ৬৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বানকো সিকিউরিটিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান আব্দুল মুহিত ও পাঁচ পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। সংস্থাটির সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ সংস্থাটির উপ-সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নুর আলম সিদ্দিকী বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। ওই দিন পালিয়ে লন্ডনে যাওয়ার সময় আসামি আব্দুল মুহিত গ্রেফতার হন।
বর্তমানে দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আতিকুর রহমান ও হুমায়ুন কবীরের সমন্বয়ে একটি টিম তদন্তের দায়িত্ব পালন করছেন। জানতে চাইলে তারা তদন্ত পর্যায়ে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
দুদকের মামলার আসামিরা হলেন- বানকো সিকিউরিটিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান আব্দুল মুহিত, পরিচালক শফিউল আজম, ওয়ালিউল হাসান চৌধুরী, নুরুল ঈশান সাদাত, এ মুনিম চৌধুরী ও পরিচালক জামিল আহমেদ।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, বানকো আইন লঙ্ঘনের মাধ্যমে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের লেনদেন নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে চলতি বছরের ৭ জুন বিশেষ পরিদর্শনে ডিএসই সম্মিলিত গ্রাহক অ্যাকাউন্টে ৬৬ কোটি ৫৯ লাখ ১৯ হাজার ১৩৩ টাকার ঘাটতির প্রমাণ পায়। বানকো সিকিউরিটিজ লিমিটেডের মালিক পক্ষ বিনিয়োগকারীদের অর্থ ও শেয়ার আত্মসাৎ করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। বিনিয়োগকারীদের সমন্বিত হিসাবের ৬৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত ১৫ জুন থেকে ডিএসইতে বানকো সিকিউরিটিজ লিমিটেডের লেনদেন কার্যক্রম বন্ধ। একই সঙ্গে ব্রোকার হাউজটির পরিচালক ও পরিবারের সদস্যরা যাতে বিদেশে যেতে না পারেন, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে ক্রেস্ট সিকিউরিটিজে প্রায় ২১ হাজার বিনিয়োগকারীর টাকা নিয়ে পালিয়েছিলো প্রতিষ্ঠানটির মালিক শহীদ উল্লাহ। পরবর্তীতে বিএসইসি ও ডিএসইর তৎপরতায় কিছুটা হলেও রক্ষা পায় গ্রাহকরা। প্রতিষ্ঠানটির মালিকেদর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। দুদকে আসা অভিযোগের বিষয়ে সংস্থাটির একজন কর্মকর্তা বলেন, ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহীদ উল্লাহ ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৬৫ কোটি ৩২ লাখ ৩৭ হাজার ৪৭৪ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া শাহ মোহাম্মদ সগীর অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের বিরুদ্ধেও গ্রাহকদের টাকা সারানোর অবিযোগ উঠে। ফলে ৩১ অক্টোবর, ২০১৯ সালে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ডিএসইকে শাহ মোহাম্মদ সগীরের ব্রোকারেজ লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করতে নির্দেশ দিয়েছিলো। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটি কিনে নিয়েছে সাদ মুসা গ্রুপ।
বিএসইসি সূত্রমতে, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নতুন কাস্টমার কমপ্লেইন্ট অ্যাড্রেস মডিউলে (সিসিএএম) চালু করার পর শাহ মোহাম্মদ সগীর অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের বিরুদ্ধে ৪৮টি অভিযোগ জমা পড়ে। এ বিষয়ে কমিশনের নির্দেশক্রমে পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে ডিএসই। পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শাহ মোহাম্মদ সগীর অ্যান্ড কোম্পানি গ্রাহকদের বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেছে।
এ অবস্থায় বিএসইসি’র ৭০৩তম কমিশন সভায় দুটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। প্রথমত, অবিলম্বে গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধের জন্য শাহ মোহাম্মদ সগীর অ্যান্ড কোম্পানির বিরুদ্ধে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ রুলস, ১৯৮৭-এর রুল ৩(১এ) অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে ডিএসইকে নির্দেশ দেবে বিএসইসি। এই ধারায় অভিযুক্ত ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন সনদ বাজেয়াপ্ত করে তা বিক্রির মাধ্যমে গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত হলো, এই আত্মসাতের ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী মামলা করার জন্য ডিএসইকে নির্দেশ দেয়া হবে। শাহ মোহাম্মদ সগীর অ্যান্ড কোম্পানির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ ওঠায় বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ট্রেডিং কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বিএসইসির ৭০০তম জরুরি কমিশন সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির ডিপোজিটরি পার্টিসিপেন্ট (ডিপি) কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে।