জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে বিশ্বব্যাপী ‘টিকা বৈষম্য’ দূরীকরণসহ ৬টি বিষয় গুরুত্ব পাবে। ১৪ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া অধিবেশনে ২১ সেপ্টেম্বর হতে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে সাধারণ বিতর্ক।
এ অধিবেশনে যোগদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল রোববার (১৯ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্কে পৌঁছবে। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে আছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
কোভিডের প্রেক্ষাপটে এ বছর সাধারণ বিতর্কের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে- কোভিড-১৯ থেকে পুনরুদ্ধারের প্রত্যাশার মাধ্যমে স্থিতিস্থাপকতা গড়ে তোলা, টেকসইভাবে পুনর্গঠন করা, গ্রহের চাহিদার প্রতি সাড়া দেওয়া, মানুষের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা এবং জাতিসংঘকে পুনরুজ্জীবিত করা। এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সাধারণ পরিষদের এবারের অধিবেশনে বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ের সভাগুলো আয়োজন করা হয়েছে।
প্রথমত, এবারের অধিবেশনের একটি বড় অংশজুড়ে থাকবে কোভিড-১৯ মোকাবিলা এবং পরবর্তী টেকসই পুনরুদ্ধার ও পুনঃনির্মাণ। কোভিড-১৯ হতে মুক্তিলাভের জন্য
দ্বিতীয়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রতিক্রিয়া এবং পুনরুদ্ধার কোভিডপরবর্তী টেকসই পুনরুদ্ধারের অন্যতম শর্ত তাই আসন্ন সাধারণ অধিবেশনে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টিও প্রাধান্য পাবে। বিশ্ব যাতে একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা পেতে পারে সে বিষয়েও এবারের সাধারণের পরিষদের অধিবেশনে বিশ্ব নেতারা আলোচনা করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে জাতিসংঘ মহাসচিব ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর যৌথ উদ্যোগে জলবায়ু বিষয়ে ভূমিকা পালনকারী দেশগুলোকে নিয়ে একটি সভা আয়োজন করছে।
তৃতীয়ত, কোভিড-১৯ এর কারণে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠ অর্জনে যে অগ্রযাত্রা-তা অনেকাংশেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠে সম্মিলিতভাবে টেকসই বিনির্মাণের বিষয়ে বিশ্ব নেতারা আলোচনা করবেন। এসডিজির প্রতিটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে ভিত্তি করে কোভিডপরবর্তী পুনরুদ্ধারের বিষয়টি তাই এ অধিবেশনে প্রাধান্য পাবে।
চতুর্থত, এবারের সাধারণ অধিবেশনে ইউএন ফুড সিস্টেমস সামিট শীর্ষক একটি সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ সভার মূল লক্ষ্য হল টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠের অন্তর্ভুক্ত-ক্ষুধা, জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য এবং বৈষম্যের মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলোর সাথে বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থার আন্তঃসম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে, উক্ত উন্নয়ন অভীষ্টসমূহ অর্জন ত্বরান্বিত করা।
পঞ্চমত, কোভিডের সময়ে আমরা লক্ষ্য করছি যে, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অসহিষ্ণুতা, বৈষম্য-বিভেদ ইত্যাদি আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধরনের বিভেদ নিয়ে কখনোই টেকসই পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। তাই এ বিষয়টিও এবারের অধিবেশনে আলোচনায় আসবে। বর্ণ বৈষম্য ও জাতিগত বিভেদ ভুলে সমতার ভিত্তিতে টেকসই পুনরুদ্ধারের বিষয়টি এ উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে প্রাধান্য পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
ষষ্ঠত, প্রতিবারের মতো এবারো নিরস্ত্রীকরণ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে আলোচিত হবে এবং সাধারণ পরিষদের সভাপতি ২৮ সেপ্টেম্বর পারমাণবিক নিরস্রীধাকরণে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গ্রহণ ও এ বিষয়ে বৈশ্বিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পারমাণবিক অস্ত্র সম্পূর্ণ নির্মূলের জন্য আন্তর্জাতিক দিবস শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের সভা আয়োজন করছে।
বাংলাদেশের জন্য গুরুত্ব:
এবারের জাতিসংঘের অগ্রাধিকার ইস্যুগুলো প্রত্যকটি বাংলাদেশের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ ইস্যুগুলোর ওপর যেসব ইভেন্ট আছে বাংলাদেশ তার সবটিতেই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
১) ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ও জাতিসংঘ মহাসচিবের আমন্ত্রণে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে অংশগ্রহণ করবেন। সিভিএফ চেয়ার এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির সম্মুখীন দেশ হিসেবে এটি বাংলাদেশের জুন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ সভায় প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরবেন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি নিরসনে সম্মিলিত বৈশ্বিক উদ্যোগের আহ্বান জানাবেন।
২) একই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সদর দপ্তর চত্বরে বৃক্ষরোপণ করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।
৩) ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আয়োজিত 'হোয়াইট হাউস গ্লোবাল কোভিড-১৯ শীর্ষ সম্মেলন : মহামারীর অবসান এবং আরও ভালোভাবে গড়ে তোলা’ শীর্ষক এক উচ্চপর্যায়ের সভায় বক্তব্য প্রদান করবেন।
৪) একই দিনে প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ কর্তৃক আয়োজিত ‘রোহিঙ্গা সংকট : একটি টেকসই সমাধানের বাধ্যবাধকতা’ শীর্ষক একটি উচ্চপর্যায়ের সাইড ইভেন্টে অংশগ্রহণ করার কথা আছে। ইতোমধ্যে এ অনুষ্ঠান আয়োজনে ওআইসি, এশিয়ান এবং ইউরোপিয়ান দেশগুলোর পক্ষ থেকে সাড়া পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ছাড়াও গাম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ওআইসি অনুষ্ঠানটির সহআয়োজক। আমরা রোহিঙ্গা সমস্যার পঞ্চম বছরে পদার্পণ করেছি কিন্তু পাঁচ বছরে একজনকেও মিয়ানমারে পাঠানো সম্ভব হয়নি। অথচ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন আমাদের জন্য এক নম্বর অগ্রাধিকার ইস্যু। এই সাইড ইভেন্টের মাধ্যমে এ বক্তব্যই আমরা বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিতে চাই। আন্তরিকতার সাথে এবং সত্যিকার অর্থে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিশ্ব যেন আমাদের পাশে দাঁড়ায় বাংলাদেশ সেই আহবান জানাবে।
৫) ২৩ সেপ্টেম্বর ইউএন ফুড সিস্টেমস সামিট শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের সভায় প্রধানমন্ত্রী যোগ দেবেন। খাদ্য খাতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য তুলে ধরার জন্য এ সম্মেলন হবে একটি অনন্য উপলক্ষ। প্রধানমন্ত্রী উক্ত সভায় অংশগ্রহণ করে, প্রযুক্তিগত সহযোগিতা, কৃষি গবেষণা ও উন্নয়ন, টেকসই উৎপাদন, খাদ্য বিতরণ এবং সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অংশীজনদের মধ্যে শক্তিশালী অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার ব্যাপারে বিশ্ব নেতৃত্বকে আহবান জানাতে পারেন বলে আশা করা যাচ্ছে।
৬) একই দিনে জাতিসংঘের সাধারণ কর্মসূচি: সমতা ও অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে কাজ শীর্ষক একটি উচ্চপর্যায়ের সাইড-ইভেন্টে প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দেবেন।
৭) ২৪ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাধারণ বিতর্ক পর্বে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য রাখবেন। প্রতিবারের মতো এবারো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলায় বক্তৃতা দেবেন। তিনি বাংলাদেশের অভাবনীয় উন্নয়ন অগ্রযাত্রা, আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে অর্জন এবং স্বাস্থ্যখাতের সাফল্য সম্পর্কে আলোকপাত করবেন। পাশাপাশি, বিশ্ব শান্তি, নিরাপদ অভিবাসন, করোনাভাইরাসের টিকার ন্যায্যতাভিত্তিক বন্টন, বৃহৎ পরিসরে করোনা ভ্যাক্সিন উৎপাদনের লক্ষ্যে পেটেন্টসহ মেধাস্বত্ব উন্মুক্তকরণ, ফিলিস্তিনি ও বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিক সংকট, জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত বিষয়সমূহ তার বক্তব্যে উঠে আসবে।
৮) প্রতি বছরের মতো এবারো যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে একটি অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান আয়োজন করবেন। কোভিড মহামারির প্রেক্ষিতে ভার্চুয়াল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে এ সভা অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী প্রতিবারের ন্যায় বেশ কয়েকটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অংশগ্রহণ করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ, ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতি নগুয়েন জুয়ান ফুক, বার্বাডোজের প্রধানমন্ত্রী মিরা আমর মটলি, ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের সভাপতি চার্লস মাইকেলসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র-সরকার প্রধানদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অংশ নিয়ে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। এছাড়া তিনি জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গেও দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন।
৯) এছাড়া প্রতিবারের মতো প্রধানমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের আয়োজনে একটি গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করবেন। এই বৈঠকে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিবেশ ও সুযোগ সুবিধার বিষয়সমূহ তুলে ধরবেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীগণ তাদের বিনিয়োগ প্রস্তাব বাংলাদেশের কাছে তুলে ধরবেন। এর মাধ্যমে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি সংযোগ তৈরি হবে।
১০) এবারের সাধারণ অধিবেশনের সাইড লাইনে বেশ কিছু মন্ত্রী পর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্রের সম্পূর্ণ নির্মূলের জন্য আন্তর্জাতিক দিবস শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের সভা, ডারবান ঘোষণা এবং কর্মসূচির ২০তম বার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠিতব্য উচ্চপর্যায়ের সভা, যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেটের সাথে মন্ত্রীপর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া ডি-৮ ও সার্কের মধ্যাহ্নভোজ সভা অনুষ্ঠিত হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বহুপাক্ষিক এবং দ্বিপাক্ষিক এসব সভায় অংশগ্রহণ করবেন।
১১) একটি শান্তিপূর্ণ ও মানবিক বিশ্ব প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের প্রচেষ্টা, অভিবাসন, জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য নিরাপত্তা, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, শান্তিরক্ষা কার্যক্রমসহ বিভিন্ন বিষয়ে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন এবং উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সাফল্য আজ সর্বজনবিদিত। এর ধারাবাহিকতায়, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের এ অধিবেশনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দলের অংশগ্রহণ বহুপাক্ষিক ফোরামে বাংলাদেশের দৃপ্ত পদচারণাকে আরও সমুন্নত করবে।
সানবিডি/ এন/আই