পোকামাকড়ের পাশাপাশি আগাছাও ফলের শত্রু। পোকামাকড়ের সাথে সাথে আগাছাও ফসল নষ্টের জন্য প্রায় ৪০ শতাংশ দায়ী। তাই ফসল ফলাতে গেলে নিয়মিত আগাছা দমন করতে হবে। আগাছা দমন না করলে ফসল ক্ষতির সম্ভাবনা অনেক বেশি।
ক্ষেতের আগাছা দমনের প্রসঙ্গ এলেই সবার আগে রাসায়নিক পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণের চিন্তাভাবনা আমাদের মাথায় আসে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জমিতে আগাছা দেখলেই ‘রাসায়নিক আগাছানাশক’ প্রয়োগ করে কৃষকরা দমনের চেষ্টা করেন।
অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন যাবত মাত্রাতিরিক্ত রাসয়নিক প্রয়োগের অনেক কুফল আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই পরিস্থিতিতে কৃষকদের সঠিক উপায়ে আগাছা নিয়ন্ত্রণের উপর জোর দিতে হবে।
আমাদের দেশের যে সমস্ত আগাছানাশক বেশ পরিচিতি লাভ করেছে তার মধ্যে রিফিট ৫০০ ইসি, লগরান ৭৫ ডব্লিউজি, লেজার ১০ ডব্লিউপি, গ্রামোক্সোন ২০ এস এল ইত্যাদি অন্যতম। আমাদের দেশে তিন ধরনের আগাছা সাধারণত দেখা যায়। এগুলো হচ্ছে, ঘাস জাতীয়, মুথা জাতীয় ও চওড়া পাতা জাতীয়।
আগাছা দমনের বেশ কয়েকটি পদ্ধতি আছে। এসব পদ্ধতির অন্যতম হচ্ছে পরিচর্যা পদ্ধতি। বর্ষাকালে আগাছা থেকে বাঁচতে গেলে কৃষকদের দ্রুত ফলন হয় এমন ফসলের চাষ করা উচিত। মৌসুম অনুযায়ী সবসময় চাষাবাদ করা উচিত।
কখনো জমি ফেলে রাখা উচিত নয়, এতে আগাছা বেড়ে ওঠে। খুরপি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার জমি ভালো রাখার অন্যতম প্রাচীন উপায়। লাঙল, হুইল, উইডার, কালটিভেটর যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষতিকর আগাছা মাটিতে মিশিয়ে দেওয়াও অন্য আর এক রকম পদ্ধতি।
যে সমস্ত সবজি খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায় তাতে সহজেই তাদের শাখা প্রশাখা বিস্তারের মাধ্যমে জমিতে আগাছার প্রকোপ কম করতে পারে। যেমন, বরবটি, শিম, ঢেঁড়শ প্রভৃতি। একই জমিতে একই গোত্রীয় ফসল বারবার চাষ না করে আলাদা আলাদা পরিবারভুক্ত ফসল চাষ করলে জমিতে আগাছার বৃদ্ধি ও হ্রাস পায়। তাই শস্য আবর্তন খুবই জরুরি।
প্রতিবছর একই জমিতে টমেটো, মরিচ, বেগুন জাতীয় সবজি চাষ না করে শিম্বী গোত্রীয় ফসল চাষ করা যেতে পারে। কিছু কিছু শাকজাতীয় স্বল্পমেয়াদী সবজির বীজ যেমন, লাল শাক, পুঁই, পালং, কলমি, মেথি ঘন করে বুনলে জমিতে আগাছার বিস্তার অনেকটা প্রতিরোধ করা যায়।
কম সময় ব্যবধানে ও অগভীরভাবে জমি কর্ষণ করলে বা লাঙল দিলে বার্ষিক আগাছাগুলোকে অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। জমিতে মূল ফসলের সাথে অন্তর্বর্তী সাথী ফসল চাষ করলে অনেকাংশে আগাছা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। যেমন, বেগুন, টমেটো, বাঁধাকপি যেগুলোর সারি ও গাছ প্রতি ব্যবধান বেশি, সেখানে মুলা বা পালং জাতীয় সবজী অন্তর্বর্তী ফসল হিসাবে চাষ করা যাতে পারে।
মটরের বীজ বপনের সময় কিছুটা বিলম্বিত করলে বথুয়া বা ক্যানারি ঘাস ইত্যাদি আগাছার থেকে অনেকাংশে রেহাই মেলে। বীজ বপন বা প্রতিস্থাপনের পর থেকেই সবজি ফসলে সুষম পুষ্টি সরবরাহ সম্ভবপর হলে ও প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী সময়মতো রোগ-পোকা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে গাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। স্বাস্থ্যবান চারাগাছ আগাছার বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
মূল জমিতে ফসল লাগানোর আগে মাটির সৌরকরণ করলে আগাছার বিস্তার অনেক কম করা সম্ভব হয়। আগাছা দমনের জৈব পদ্ধতি জৈব পদ্ধতি সম্পর্কে জেনে নিন। জৈবিক পদ্ধতিতেও আগাছা দমন করা যায়।
আগাছার প্রাকৃতিক শত্রু বিভিন্ন রোগ, পোকা অথবা অন্যান্য প্রাণীর মাধ্যমেও আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। দুধিকানি, বিছুটি, ঘেটু হলদের মতন ফসলের মতন ক্ষতিকর আগাছাকে, মোজাইক ভাইরাস জব্দ করতে পারে। বিশেষ এক শ্রেণির স্পাইডার মাইট ক্ষেতের আগাছা উত্তম উপায়ে দমন করতে সক্ষম। বাজারেও বিভিন্ন রকমের জৈব আগাছা নিয়ন্ত্রণ আজকাল পাওয়া যাচ্ছে। সেগুলো ব্যবহার করলেও আগাছা ভালোই নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে।
এবার জেনে নিন যান্ত্রিক পদ্ধতি সম্পর্কে। আগাছা নিয়ন্ত্রণের সুপ্রাচীনতম ও অন্যতম একটি পদ্ধতি হলো হাত দিয়ে, নিড়ানি দিয়ে বা খুরপি দিয়ে আগাছা তোলা। জমির পরিমাণ অল্প হলে খুব সহজেই এই পদ্ধতিতে আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সাধারণত ফসলের উপর ভিত্তি করে সর্বনিম্ন ২ থেকে সর্বোচ্চ ৪টি হাত নিড়ানি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে।
এছাড়া লাঙল, উইডার, কালটিভেটর ইত্যাদির মাধ্যমেও আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। জৈব ও অজৈব দু ধরণের উপাদান দিয়ে মালচিং করেও আগাছার প্রকোপ থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে। জৈব উপাদান যেমন খড়, কচুরিপানা, শুকনো পাতা, তুষ, ভূষি ইত্যাদি ও অজৈব উপাদানের মধ্যে প্লাস্টিক ফিল্ম ও বিভিন্ন রঙের পলিথিন দিয়েও মালচিং করা হয়ে থাকে।
রাসায়নিক দিয়েও সহজে আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। রাসায়নিক, ফসল অনুযায়ী সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করলে আগাছার দমন ঘটানো সম্ভব। তবে নিয়ম না মেনে রাসায়নিক প্রয়োগে, ক্ষেতের মাটি থেকে শুরু করে, পশু-পাখি এমনকি মানুষের সমূহ বিপদের আশঙ্কা থাকে।
নির্বাচিত এবং অনির্বাচিত, দুই ধরনের আগাছা নাশক মূলত দেখা যায়। নির্বাচিত আগাছা নাশক প্রয়োগ করলে নির্দিষ্ট কিছু আগাছাকে মেরে দেয়। অনির্বাচিত আগাছা নাশক জমির সমস্ত গাছকে মেরে ফেলে।
আগাছা নাশক, গুঁড়ো আর তরল এই দুইরকমের মূলত হয়। বালি অথবা পানি মিশিয়েই এই আগাছা নাশক ক্ষেতে প্রয়োগ করা উচিত। মূলত বীজ বোনার আগে, বীজ বোনার পর ও আগাছা জন্মানোর আগে এবং আগাছা জন্মানোর পর এই তিন আলাদা আলাদা সময়ে আগাছা নিয়ন্ত্রক ব্যবহার করা যায়।
সানবিডি/ এন/আই