সার্কুলারে লাগাম ছাড়া বিমা কোম্পানির শেয়ার দর

উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ার বিক্রি বন্ধে নজর নেই আইডিআরএ’র

নিজস্ব প্রতিবেদক আপডেট: ২০২১-১০-০৩ ১৩:১৩:৪৯


বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (আইডিআরএ) বিভিন্ন সার্কুলারে লাগামহীনভাবে বেড়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিমা কোম্পানিগুলো শেয়ারের দর। সার্কুলার জারির পর থেকে এ পর্যন্ত কয়েকগুণ বেড়েছে কিছু কোম্পানির শেয়ারের দর। এখন আইন পরিপালনতো দূরের কথা উল্টো উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ার বিক্রির হিড়িক পড়েছে। কোন কোন পরিচালক তার হাতে থাকা পুরো শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। তবে শেয়ার বিক্রি বন্ধে কোব উদ্দ্যোগ নেই আইডিআরএ’র।

আইডিআরএর অনেকগুলো সার্কুলারের মধ্যে শেয়ারের দর বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের শেয়ার ৬০ শতাংশে উন্নীত করার নির্দেশনা। একাধিকবার বিষয়টি উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে (আইডিআরএ)। ফলে গত বছরের জুলাই থেকে বিমা খাতের শেয়ারের দাম লাগাম ছাড়া বেড়েছে। শেয়ার দর বাড়ার কারণে বিমা কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের বেশি দামে শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেন। গত এক মাসে বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে ঢাকা ও চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে। তবুও উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেননি আইডিআরএ।

কোম্পানিগুলোর এমন উদ্যোক্তা-পরিচালকও আছেন, যিনি তার হাতে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। আবার কেউ হাতে থাকা বেশির ভাগ শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে চলতি বছর বিমা খাতের উদ্যোক্তা পরিচালকরা মোট ১ কোটি ১৫ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫০টি শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দিয়েছেন। এর মধ্যে সিংহভাগ এরই মধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে। আর বাকিগুলো বিক্রি করার ঘোষণা এখনও বলবৎ আছে।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিমা কোম্পানির সংখ্যা ৫১টি। এর মধ্যে পাঁচটির মোট শেয়ারের ৬০ শতাংশের বেশি ধারণ করে আছেন উদ্যোক্তা পরিচালকরা। এর মধ্যে সম্প্রতি একটি কোম্পানির ৬০ লাখের বেশি শেয়ার কিনে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ার ৬০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। এটি হলো স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্স। গত জুন থেকে এই খাতে যে দর সংশোধন শুরু হয়েছে, সেখানে দেখা গেছে, এই কোম্পানির শেয়ার দরে পতন হয়নি, উল্টো বেড়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে।

চলতি বছরের শুরুতে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ পক্ষ থেকে ২০১০ সালের একটি চিঠি নতুন করে সব কোম্পানির কাছে পাঠানো হয়। সেই বিজ্ঞপ্তিতে বিমা আইন ২০১০-এর ২১(৩) ধারার তফসিল-১-এর কথা উল্লেখ করে বলা হয়, দেশে নিবন্ধিত জীবন বিমা কোম্পানির ক্ষেত্রে ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধন হবে ৩০ কোটি টাকা, যার ৬০ শতাংশ আসবে উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে। বাকি ৪০ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে।

সাধারণ বিমা কোম্পানির ক্ষেত্রে পরিশোধিত মূলধন হবে ৪০ কোটি টাকা, যার ৬০ শতাংশ উদ্যোক্তারা দেবেন। বাকি ৪০ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য। বিমা কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের পরিশোধিত মূলধনের ৬০ শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে, এমন সিদ্ধান্ত ২০১০ সালের। এক দশকেও সেটি প্রতিপালন করা হয়নি।

গত ২০ জুনও আইডিআরএর চেয়ারম্যান এম মোশাররফ বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। সেদিন সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময়ে তিনি বলেন, ‘তাদের (উদ্যোক্তা-পরিচালকরা) পুঁজিবাজার থেকে শেয়ার কিনতে হবে। এ জন্য হঠাৎ করে শেয়ার কেনার ক্ষেত্রেও জটিলতা আছে। তবে যেহেতু এটি আইনগত বিষয়, তাই জটিলতা থাকলেও আইগনত বিষয়টিকেই আমরা গুরুত্ব দেব।’

কিন্তু আইডিআরএ কী উদ্যোগ নিয়েছে সেটি স্পষ্ট নয়। বরং এখন বলা হচ্ছে, করোনা মহামারিতে কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক কার্যক্রম ভালো না হওয়ায় এমন সিদ্ধান্তে কিছুটা শিথিলতা দেখানো হচ্ছে।

বিমা খাতে গত এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে ব্যাপক হারে। এমনও দেখা গেছে, মোট লেনদেনের ২৭ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে এই একটি খাতেই। বিমা খাতে এক দিনে ৯০০ কোটি টাকারও বেশি লেনদেনের রেকর্ডও আছে চলতি সপ্তাহে। এখন কোনো কোনো দিন ২০০ কোটি টাকার নিচে, কখনও কখনও দেড় শ কোটি টাকারও নিচে হয় লেনদেন। আর এক দিন দাম বাড়লে চার দিন কমে, এভাবে ক্রমাগত কমছে শেয়ার দর।

উদ্যোক্তা পরিচালকদের মধ্যে সব শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার তালিকায় রয়েছেন, সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের উদ্যোক্তা পরিচালক রওশন আরা। তার কাছে থাকা কোম্পানির ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮১০টি শেয়ারের সবগুলোই বিক্রি করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।

মার্কেন্টাইল ইন্স্যুরেন্সের তিন পরিচালক, পরিচালক মোহাম্মদ আলী আজগর, উদ্যোক্তা সৈয়দ নূর আলম, পরিচালক মাহতাবুদ্দিন চৌধুরী। তিনজনের শেয়ার সংখ্যা কোম্পানির মোট শেয়ারের ৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। তাদের কারও হাতে ২ শতাংশ শেয়ার না থাকার পরেও তারা উদ্যোক্তা পরিচালক ছিলেন এতদিন।

সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্সের দুই উদ্যোক্তা এম এ মালেক তার হাতে থাকা ২১ হাজার ৫৭৫টি শেয়ারের সবগুলো আর জয়নাল আবেদন চৌধুরীর হাতে থাকা ১৩ হাজার শেয়ার বিক্রি করার ঘোষণা দিয়েছেন। কমপক্ষে ২ শতাংশ শেয়ার ধারণের যে নির্দেশনা এক দশক আগে দেয়া হয়েছিল, সেই নির্দেশনা অনুযায়ী, তাদের কারও পরিচালক থাকার কথা ছিল না এই নগণ্যসংখ্যক শেয়ার নিয়ে। কোম্পানির মোট শেয়ার সংখ্যা ৫ কোটি ৩১ লাখ ৪৪ হাজার ৮২৩টি। কমপক্ষে ২ শতাংশ ধারণ করতে হলে একেকজনের হাতে থাকতে হতো ১০ লাখ ৬২ হাজার ৮৯৬টি শেয়ার।

বিমার শেয়ার দর বৃদ্ধির পর ১ কোটি ১৫ লাখ বিক্রি করার তালিকায় রয়েছেন, ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্সের উদ্যোক্তা পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন তার হাতে থাকা ১৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮১১টি শেয়ারের সবগুলো বিক্রির ঘোষণা দেন গত ১০ আগস্ট। ১৯ আগস্ট জানান, তিনি সবগুলো শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন।

মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে:
কোম্পানির দুজন উদ্যোক্তা পরিচালক এক দিনে তাদের হাতে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এই দুজনের হাতে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের শূন্য দশমিক ৩৯ শতাংশ শেয়ার ছিল। তারা বিক্রি করে দিলে কোম্পানিটিতে উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার কমে হবে ৩০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশের মতো। এত কমসংখ্যক শেয়ার নিয়ে দুজন কীভাবে উদ্যোক্তা পরিচালক ছিলেন, সেই প্রশ্নও আছে।

রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সে:
কোম্পানির করপোরেট উদ্যোক্তা মিনহার ফিশারিজ তার হাতে থাকা ২২ লাখ শেয়ারের সবগুলো ব্লক মার্কেটে বিক্রি করে দেয়ার ঘোষণা দেন গত ২৯ এপ্রিল।

সবচেয়ে বেশি বিক্রির ঘোষণা ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সের:
কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালক আবদুল মান্নান ও তার স্ত্রী উম্মে কুলসুম মান্নান তাদের মালিকানাধীন কোম্পানি পেনিনসুলা গার্মেন্টস, সানপ্যাক ইন্ডাস্ট্রিজ ও পাইওনিয়ার ড্রেস লিমিটেডের হাতে থাকা ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সের বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দিয়েছেন। প্রথমে ঘোষণা আসে ৬ লাখ ৫৯ হাজার ১২০টি শেয়ার বিক্রির। এই শেয়ার বিক্রি শেষ না হতেই আসে এর চেয়ে চার গুণ বেশি শেয়ার বিক্রির ঘোষণার। এই পরিমাণ শেয়ার কোম্পানির মোট শেয়ারের ১ দশমিক ৫২ শতাংশের কিছু বেশি। এই শেয়ার বিক্রি শেষ হতে না হতেই মান্নান ও তার স্ত্রী আরও বড় অঙ্কের শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেন ৩০ সেপ্টেম্বর। অর্থাৎ ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সের মোট ৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে মালিকপক্ষ। এতে তাদের হিস্যা ৫৪ দশমিক ১৬ শতাংশ থেকে কমে হবে ৪৬ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ।

গ্রিনডেল্টা ইন্স্যুরেন্স:
কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালক মোজাম্মেল হক ও খুরশিদা চৌধুরী গত ৩ আগস্ট বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দিয়েছেন। এর মধ্যে মোজাম্মেল বিক্রি করবেন ৬ লাখ ৯ হাজার ৮৭৮টি ও আর খুরশিদা চৌধুরী বিক্রি করবেন ৫৭ হাজার ৪৬৯টি শেয়ার। কোম্পানির মোট শেয়ারের ৩৫ দশমিক ৩২ শতাংশ শেয়ার আছে উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে। এই শেয়ার বিক্রি হলে কোম্পানিতে উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার কমে যাবে শূন্য দশমিক ৬৬ শতাংশের কিছুটা বেশি।

ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্স:
কোম্পানিটির উদ্যোক্তা আজিজ আল মাহমুদ তার কাছে থাকা কোম্পানির ১৮ লাখ ১৭ হাজার ১২০টি শেয়ারের মধ্যে ৮ লাখ ১০ হাজার বিক্রির ঘোষণা দিয়েছিলেন ২৮ জুলাই। এই শেয়ার কোম্পানির মোট শেয়ারের ২ শতাংশের কিছুটা বেশি। বর্তমানে কোম্পানিতে উদ্যোক্তা পরিচালকরা সম্মিলিতভাবে ধারণ করে আছেন ৩৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ শেয়ার। একজন বিক্রি করে দিলেই তা কমে হবে ৩২ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ।

সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্স:
কোম্পানির মোট শেয়ারের ৩৮ শতাংশ শেয়ার আছে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে। কোম্পানির উদ্যোক্তা মোহাম্মদ শফিক গত ২৬ সেপ্টেম্বর তার কাছে থাকা কোম্পানির ১ লাখ ৫২ হাজার ৯১৭টি শেয়ারের মধ্যে ১ লাখ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দিয়েছেন। এই ঘোষণার পর শফিক কীভাবে কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালক আছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কারণ, ২ শতাংশ শেয়ার তো দূরের কথা, তিনি ১ শতাংশ শেয়ারেরই মালিক নন। মোট শেয়ারের কেবল শূন্য দশমিক ২৯ শতাংশের মতো মালিকানা নিয়ে তিনি পরিচালক আছেন, যা এখন আরও কমে যাবে।

অগ্রণী ইন্স্যুরেন্স:
কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান গত ৬ মে জানান, তিনি তার হাতে থাকা কোম্পানিটির ৭ লাখ ৫৬ হাজার ১০৭টি শেয়ারের মধ্যে দেড় লাখ বিক্রি করে দেবেন। পরে ৫ জুন তিনি জানান, সব শেয়ার বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। আরেক উদ্যোক্তা পরিচালক মাহমুদুল হক একই সময়ে তার হাতে থাকা ১০ লাখ ৮০ হাজার শেয়ারের মধ্যে বিক্রি করে দিয়েছেন ৩০ হাজার শেয়ার।

বিএনআইসিএল: গত ৫ সেপ্টেম্বর কোম্পানির উদ্যোক্তা মোহাম্মদ জাকারিয়া তার হাতে থাকা কোম্পানিটির ১২ লাখ শেয়ারের মধ্যে ৩ লাখ ১৪ হাজার ১৭৫টি বিক্রি করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ১৯ আগস্ট আরেক উদ্যোক্তা এম এফ কামাল তার হাতে থাকা ১২ লাখ শেয়ারের মধ্যে ৩ লাখ ১৪ হাজার ১৭৫টি বিক্রির ঘোষণা দেন। এই কোম্পানির মোট শেয়ারের ৬০ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ বর্তমানে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে আছে। এই দুই পরিচালক বিক্রি করবেন মোট শেয়ারের শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশের মতো। তারা শেয়ার বিক্রি করলে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হিস্যা ৬০ শতাংশের নিচে নেমে আসবে।

পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স:
কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালক নাসিরুল্লাহ তার হাতে থাকা ২ লাখ ৩১ হাজার ৩৩২টি শেয়ারের মধ্যে ২০ হাজার শেয়ার বিক্রি করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন গত ১৪ সেপ্টেম্বর।

পূরবী ইন্স্যুরেন্স:
কোম্পানিটির পরিচালক খালিদ হোসেন তার হাতে থাকা ১৩ লাখ ৬৬ হাজার ৫৭৬টি শেয়ারের মধ্যে ১ লাখ শেয়ার বিক্রি করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছ।

এএ