জয়! শয়তান রাজার জয়!!
:: প্রকাশ: ২০২১-১০-১৫ ১৮:৪৯:৩৩
মানুষ সুখে শান্তিতেই দিন কাটাচ্ছিলেন। কোন ঝগড়া নেই, বিবাদ নেই, নেই ফেসাদ কিংবা হিংসা-মারামারি! হিন্দু বাড়ির যাত্রাগানে মুসলমান আর মুসলমানদের পালা গানে হিন্দুরা নিমন্ত্রণ পেত এবং যেত। যেন একই বৃন্তে দু’টি কুসুম ‘হিন্দু-মুসলমান’। চারিদিকে শান্তি, সমৃদ্ধি আর সম্প্রীতি! সুখ আর সুখ!!
এমন পরিবেশে শয়তানদের রাজা তার এই খন্ড রাজ্য পরিদর্শনে এলেন। এলাকাটি কি শুন শান নিরব! সার্বিক চিত্র দেখে সে ভাবতে লাগলো, “এই রাজ্যের সব শয়তান কি তবে মরে গেছে? না। তা হতে পারে না!”
আবার ভাবে, “তা যদি নাই হয়, তবে মানুষের জীবনে এরকম সুখ-সমৃদ্ধি কি করে আসে? যেখানে এই ভারত বর্ষে দুটি জাতি ছিল! এখনও আছে! তারা কিভাবে এতো সুখে-শান্তিতে থাকে? না, মাথায় কিছুই আসছে না!” বলে মাথা চুলকাতে লাগলো সে।
অতঃপর রাজ মশাই আবার এক সুখ কল্পনায় হারিয়ে গেলেন, “হ্যা মনে পরেছে! ওরা তো সেই জাতি, হিন্দু-মুসলমান! যারা ১৯৪৬ সালে একে অপরকে যবন-কাফের আখ্যা দিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে দিয়েছিল এই ভূমিতে। আর সেই সুযোগে আমার বড় ভাইয়েরা ১৯৪৭ সালে দেশটাকে ভেঙ্গে তিন টুকরা করে দিয়েছিল। হ্যা, পরিস্কার মনে পড়েছে ঐ দিনের ঘটনা প্রবাহ! হায় হায়! কিভাবে যে এতটা দিন চলে গেল! হ্যা, ঐ ঘটনাটি সূত্রপাত আমিই করেছিলাম আমার যৌবন কালে। কি রক্ত গরমরে ভাই! আমি কেবল ইস্যু তৈরি করেছিলাম, আর বাদ বাকী যা করার তারাই করেছিল! ছুরি-লাঠি নিয়ে কাটা-কাটি, লাঠা-লাঠি কত না কি!”
“আর তারা নাকি এখন শান্তিতে বসবাস করছে? না, আমার মাথায় কিছুই আসছে না!” —চরম হতাশা ও বিরক্তি নিয়ে শয়তান রাজ চিৎকার করে কেঁদে উঠলো, “তাহলে কি আমার রাজ্যের পতন ঘটে গেছে রে— ? (হাউ মাউ কান্না) তুমি কি জিতে গেলে খোদা? হাউ মাউ–!”
শয়তানের চিৎকার আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হলো। সেই কান্না রণিত হলো বনে-বনে, পাহাড়-সাগরে! সেই ধ্বনিতে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠলো শত সহস্র ঝির্ণ দেহের শয়তান। যেন একটি বিরাট বড় দল! বাচ্চা, যুবা, বৃদ্ধ; সর্ব প্রকারের শয়তান জমায়েত হতে লাগল। হঠাৎ ক্ষিণ কন্ঠে ভেসে এলো একটি করুন সুর, “না মালিক, আমরা মরিনি। আপনার রাজ্যও ঠিক আছে। জাস্ট একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”
শয়তান রাজ ক্রোধে ফেটে পরলেন! বললেন, “তোদের দিন শেষ শয়তান! আমি একে একে সবকটিকে কতল করবো! শালা শুয়ারের বাচ্চারা!”
এ সময় এক যুবক শয়তান বুকে সাহস নিয়ে বলল, “হুজুর, আমরা কি করবো! আজকালকের মানুষেরা আমাদের সব শয়তানি রপ্ত করে ফেলেছে; তারা এখন আমাদের পকেট কেটে খায়! আর কি যে এক যন্ত্র বের হয়েছে, নাম ফেসবুক! হ্যা, একজন আমাদের চলাকি ধরে ফেললে, সাথে সাথে সেই চালাকির খবর প্রচার করে দেয় ফেসবুকে। আর সবাই সাথে সাথে সচেতন হয়ে যায়!
কি বললি? ফেসবুক? এটাতো আমার চাচাতো ভাইয়ের আবিস্কার! এর একটি উল্টা সফটওয়্যার আছে! সেটাকে কাজে লাগা!
সেটা কি মালিক?
সেটা হ’ল “গুজব আর প্রতারণা!”
টপ করে আরেক যুবক দাড়িয়ে গেল; বলল, হুজুর চেষ্টা তো করেছি, কিন্তু সেখানেও ষোলআনা সফল হতে পারিনি। আমরা যা কিছু শয়তানি করি যেমন: “স্যার আপনি লটারি পেয়েছেন; জিনের বাদশা; বিকাশের অফিস থেকে বলছি; ছি! ছি-ভ্যালী; ছি-অরেঞ্জ” আরও কত কি! কিন্তু মানুষ সহজেই এই ফেসবুকের মাধ্যমে শতর্ক হয়ে যায়। আর হুজুর, রাতের আঁধারে যে কিছু একটা করবো সেই সুযোগও নেই! তারা সারাদিন কাজ করে, রাতে ফেসবুক দেখে। এত ব্যস্ত মানুষ দিয়ে কী শয়তানি চলে? তারা এক খাটে শুয়ে ম্যাসেজের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীতে ভাব-ভালবাসা করে! তাছাড়াও দেখা স্বাক্ষাৎ, চিঠি লেখা, দাওয়াত দেয়া ইত্যাদি এখন জাদুঘরে; এমনকি তারা জন্মদিনের কেক-ফুল এখন ফেসবুকেই আদান-প্রদান করে! লেনদেন বা দায়িত্ব কর্তব্যও বলতে কিছুই নেই; তাই ঝগড়া ফেসাদও নেই! তবে হুজুর, মানুষ উপরে উপরে সুখ সুখ ভাব ধরলেও, আসলে তারা কিন্তু সুখি না! মুখে যে হাসি, সেটাও কৃত্রিম; হুজুর!”
“থাম বেয়াদব! এইজন্য তোরা সুখে শান্তিতে ঘুমাচ্ছিলি? আমারে জ্ঞান দিতে আসে! তোদের সব কয়টার মুন্ডু পাত করবো!” — শয়তান রাজের হুঙ্কার।
জমায়েত একেবারে পিন পতন নিরব হয়ে গেল! এমন সময় ভিড় ঠেলে এক বৃদ্ধ শয়তান বলে উঠলো, “হুজুর যদি অভয় দেন আমি একটু চেষ্টা করে দেখতে পারি। মহারাজের হারানো গৌরব যদি–!”
শয়তান রাজ ব্রু কুঁচকে, বিদ্রুপ হেসে বললেন, “তুই! হা হা হা! দেখ, কিছু করতে পারিস কি না!”
পরক্ষণেই আদেশ দিলেন “সেনাপতি! এই বৃদ্ধের কামান, গোলা-বারুদসহ যা যা রসদ লাগে, তা সরবরাহ কর।”
বৃদ্ধ বললেন,”না মহারাজ, আমার কিছুই লাগবে না! শুধু আমার এক ফোটা গুর লাগবে! পাবনার খাঁটি আখের গুর!”
সভায় হাসির রোল পড়ে গেল!
বৃদ্ধ সেদিকে কর্ণপাত না করে সেই এক ফোটা গুর নিয়ে সূবর্ণ পুরের যে রাস্তা হিন্দু ও মুসলিম পাড়াকে বিভাজন করেছে সেখানে চলে গেলেন। সাথে সাথে সব শয়তান দল বেঁধে রঙ দেখতে গেলেন সেখানে। রাজা, সেনাপতিও গেলেন। সবায় দেখলেন বৃদ্ধ রাস্তার উপরে কেবল ঐ এক ফোটা গুর রেখে চলে এলেন!
শয়তান রাজ তাচ্ছিল্য করে বললেন, “এটা কি তোর কারিশমা? শালা বৃদ্ধ শয়তান কোথাকার!”
বৃদ্ধ শীতল গলায় বলল, “ভাল কিছু মেওয়া পাইতে হইলে কিছুতো ধৈর্য্য লাগবেই মহারাজ!”
শয়তান রাজ ঠোঁট বাঁকালেন, দ্যাখ!
পরক্ষণেই দেখা গেল, পিপিলিকা সেই গুর খেতে এল দলে দলে; পিপড়াদের খেতে এলো ফড়িং আর তেলাপোকারা; তেলাপোকাদের খেতে এলো মুরগী; মুরগী ধরতে এলো শিয়াল; শিয়ালকে তাড়া দিতে এলো হিন্দু বাড়ির কুকুর; ঐ কুকুরকে তাড়া দিতে এলো মুসলমান বাড়ির কুকুর; এবার কুকুরে কুকুরে কামড়া-কামড়িতে হিন্দু বাড়ির গরু দড়ি ছিড়ে শেখদের জমির ধান খেয়ে ফেলল; শেখের বেটা লাঠি দিয়ে গরুকে বেধম প্রহার করলেন!
বাহ! জমে গেছে খেলা, শয়তানদের মধ্যে কৌতূহল এখন উদ্দীপনায় রূপ নিল।
বৃদ্ধ তর্জনী মুখে নিয়ে শি-শ-শ– করলো! সবাই চুপ! একেবারে নিরব দর্শক।
অতঃপর ঘটল এক হৃদয় বিধারক ঘটনা।
হিন্দুদের মা! অর্থাৎ যাকে কিনা মায়ের মতো পুজো করে সেই মাকে এভাবে প্রহার! হিন্দু যুবকদের রক্ত টকবক করে ফুটে উঠলো। কালী কালী বলে তারা মুসলিমদের বাড়ি ঘর মসজিদে আক্রমণ করে বসলো।
এ দিকে মুসলিমরাও হাক ডাক দিয়ে উঠলেন, কোথায় চেঙ্গিস, খিলজি, বাবর, কোথায় কালাপাহাড়! জেগে উঠ যত মুসলিম নও-যওয়ান! মুসলিমরা আলী আলী বলে পাল্টা আক্রমণ করলো। মন্দির ভাঙ্গলো, গীতা-পুরান পুড়ালো, নিদন করতে লাগলো কাফেরদের, যেখানে পায় সেখানেই, যেন কচুকাটা।
একদিকে বাতাসে ভেসে বেড়াতে লাগলো “কয়েক হাজার হিন্দু শেষ! দেব-দেবীর মুর্তি সমানে তছনছ করছে ঐ যবনের বাচ্চারা।”
অপরদিকে রাষ্ট হলো, মুসলিম নারীদের সম্রম হানি করছে হিন্দু শালারা! যেখানে পাচ্ছে সেখানেই মসজিদ, পবিত্র ধর্ম গ্রন্থে আগুন দিচ্ছে; একেবারে লঙ্কার মতো সারাদেশকে পুড়িয়ে দিচ্ছে ঐ মালাউনের বাচ্চারা।
সেই দমকা হাওয়ার গতি কোটি গুন বাড়িয়ে দিল ফেসবুক, ইউটিউব, ম্যাসেঞ্জার, হোয়টসএপস আরও কত যে কি! আগুনে ঘি ঢেলে দেয়া হলো!
এই অগ্নি-বায়ু যেদিকে বয়, সেদিকেই ধ্বংস! যেদিকে ধায়, সেদিকেই মানুষের পরাজয়! এভাবে গ্রামের পর গ্রাম; শহরের পর শহর; দেশের পর দেশ পরাজিত হতে থাকে! যবন মারে কাফেরকে, আর কাফের মারে যবনকে। শুধু লাশ আর লাশ!
“বাহ! বেশ মজার খেলা!” — শয়তান রাজ শিটি বাজিয়ে উঠে!
আদতে মানুষের হাতে মানুষ যে মরে সে খরব হিন্দু মুসলিম কেউ রাখে না। অতঃপর আগুন নিভে যায়। কিন্তু বাতাসে ভেসে বেড়ায় মানুষ পঁচা গন্ধ। এক সময় শান্ত হয় গ্রাম, পাড়া, মহল্লা, দেশ। কিন্তু বিনষ্ট হয় শান্তি। শৃঙ্খলা চলে যায় চুলায়, আর সমৃদ্ধি যায় রসাতলে।
মাঠ ভর্তি শয়তানের করতালিতে মুখরিত হলো চারদিক। খুশির বানে চিকচিক করে জ্বলে উঠলো শয়তান রাজের মুখশ্রী। ধ্বনিত হলো চারিদিক, “জয়! শয়তান রাজার জয়!”
এই দিনকে স্মরণ রাখতে শয়তান রাজ কতগুলো বৃক্ষরোপণ করলেন, বিষবৃক্ষ! এদের নাম দিলেন: হিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষ, অবিশ্বাস, অধৈর্য্য, উগ্রবাদ আর সাম্প্রদায়িকতা!
অতঃপর শয়তান রাজ ঐ বৃদ্ধ শয়তানকে তার প্রধান পরামর্শ দাতা নিয়োগ করলেন।
(প্রচলিত এক গল্প অবলম্বণে)
লেখক: ক্লিন এন্ড গ্রিন ফাউন্ডেশন এবং গরিব ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা।
এএ