বিমা খাতে সঠিক পরিকল্পনা, কর্মসংস্থানের অপার সম্ভাবনা
:: প্রকাশ: ২০২১-১১-০৭ ১৬:৩৮:২৭
বিমা হলো ঝুঁকি বহনের চুক্তি । এজন্য বিমা পলিসিকে বিমা চুক্তি বা ক্ষতিপূরেনর চুক্তিও বলা চলে । এটি দু’পক্ষের মধ্যে একটি আইন সম্মত চুক্তি। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে ক্ষতিপূরণ দিবে বলে নিশ্চয়তা দিয়ে চুক্তিতে আবদ্ধ হয় । অন্যপক্ষ , যার বিমা যোগ্য স্বার্থ আছে তিনি ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য কোন নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর কোন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্দিষ্ট হারে প্রিমিয়াম প্রদানের নিশ্চয়তা দিয়ে চুক্তিতে আবদ্ধ হয় । এভাবে বিমা হলো প্রথম পক্ষ বিমাকারী বা বিমা কোম্পানি এবং দ্বিতীয় পক্ষ বিমাগ্রহীতার মধ্যে যথাক্রমে ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং প্রিমিয়াম প্রদানের নিশ্চয়তা সম্বলিত একটি চুক্তি।
বিমা চুক্তি এবং বিমা প্রিমিয়াম নির্ভর করে ‘বিমা যোগ্য বিষয়’ এর বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তর উপর । তথ্য-উপাত্ত বা ডাটা বিশ্লষণ এর কাজ করতে প্রয়োজন উক্ত বিষয়ে প্রচুর পড়াশুনা এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ । তাইতো, বিভিন্ন বিমা পলিসি বিক্রয়, বিক্রয় ব্যবস্থাপনা এবং কোম্পানি ব্যবস্থাপনায় দরকার দক্ষ মানব সম্পদ । অধিকন্তু, বিমা পলিসি বিপণন শৃংখলে কিংবা বিমা দাবী প্রদান প্রক্রিয়ায় অথবা অপরাপর সকল বিষয়ে সার্বিক ব্যবস্থাপনার প্রত্যেক স্তরে প্রয়োজন প্রশিক্ষিত জনশক্তি। অথচ, দেশের এ গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরটি চলছে অদক্ষ এবং অপর্যাপ্ত জনশক্তি দিয়ে।
যে কোন দেশের অর্থনীতির অন্যতম তিন খাত হলো ব্যাংক, বিমা এবং পুঁজিবাজার। আমাদের দেশে তৈরী পোষাকখাতের পরই বিমা খাত হলো দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থান খাত । কিন্তু প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে এখাতের অবদান অনেক অপ্রতুল। ব্যাংক, বিমা এবং পুঁজিবাজার— আর্থিক খাতের এ তিনটির মধ্যে বিমাই সবচেয়ে পিছিয়ে। শুধু পিছিয়ে আছে বললে কমই বলা হবে, বরং বলা উচিত অর্থনীতির আকারের তুলনায় অনেক পিছিয়ে এ খাত । ২০১৯ সালে জিডিপিতে এ খাতের অবদান ছিল মাত্র দশমিক ৪৯ শতাংশ । ২০২০ সালে তা আরো কমে দশমিক ৪০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে সুইস রি ইন্সটিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত সিগমা রিপোর্ট । বিমা প্রিমিয়ামে বাংলাদেশের মাথাপিছু ব্যয় ৯ মার্কিন ডলার, যা সারা বিশ্বেই নিম্নতম। যথাযথ নীতি প্রণয়নের অভাবে খাতটি থেকে ভালো কিছু বের করে আনতে পারছে না বাংলাদেশ।
শুধু মাত্র প্রবাসী আয় এবং তৈরী পোষাকখাতের রপ্তানি আয়, দিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে তার ইপ্সিত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব না। কেননা , পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনসংখ্যা । অথচ বিনিয়োগের বিকল্প খাত তৈরী না হওয়ার ফলশ্রুতিতে বিনিয়োগ বাড়ছে না ,বাড়ছে না কর্মসংস্থানও ।‘ মড়ার উপর খড়ার ঘা ’ হিসেবে যোগ হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান প্রায় শত ভাগ পাসের হার । ফলে বাড়ছে পুঞ্জিভূত ব্যাপক বেকারত্ব । বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে , ২০১৯ সালে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার প্রায় ছিল ৪.৬ শতাংশ । সংখ্যার হিসেবে তা প্রায় ১.৩৮ কোটি ! মনে রাখতে হবে এ পরিসংখ্যানে ছদ্ম বেকারত্বেকে বিচেনায় নেয়া হয়নি । তা বিবেচনায় নিলে হারটি আরো বাড়বে ।
করোনা মহামারীর কারণে দেশে বিভিন্ন খাতে কর্মহীন হয়েছে অসংখ্য কর্মক্ষম মানুষ। দেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ জনসংখ্যা কর্মবাজারে প্রবেশ করে। এর মধ্যে ৬ থেকে ৭ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয় বিদেশে। তবে করোনা মহামারীর কারণে দেশে বেকারত্বের হার আরো বেড়ে গেছে। বাংলাদেশে স্বাভাবিক বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ হলেও যুব বেকারত্বের হার ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। করোনাভাইরাসের কারণে সেটি কয়েক গুণ বেড়ে গেছে বলে বিভিন্ন পর্যালোচনায় উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর তথ্য অনুযায়ী, করোনা মহামারীতে বিশ্বে ৬(ছয়)জনের ১(এক)জন বেকার হয়েছে, আর বাংলাদেশে বেকার হয়েছে চারজন যুবকের মধ্যে একজন, যা প্রায় ২৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ। করোনায় কর্মহীন জনগোষ্ঠী নিয়ে গবেষণা করেছেন অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত। তার গবেষণায় দেখানো হয়- দেশে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে ৬ কোটি ৮২ লাখ ৮ হাজার মানুষ কর্মে নিয়োজিত ছিলেন। শুধু লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়েছেন ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৭১ জন। অর্থাৎ মোট কর্মগোষ্ঠীর ৫৯ শতাংশ মানুষই কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকার হয়েছে সেবা খাতে। বিমা খাত সেবা খাতেরই একটা অংশ ।
এখানে প্রসঙ্গিক আরেকটি বিষয় বলার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না , বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ বর্তমানে নিউইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক ড.বিরুপাক্ষ পাল ‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’ এর সাথে এক সাক্ষৎকারে উচ্চ জিডিপি সত্তেও বাংলাদেশে বেকারত্ব কেন বাড়ছে এমন প্রশ্নের জবাবে আয়ের অনানুষ্ঠানিক খাতের বিশালত্বকে এ জন্য দায়ী করেন । অনানুষ্ঠানিক আয় হলো মূলত সেসব আয় যা আয়কারী আয় হিসেবে কোথাও প্রকাশ করেন না ফলে প্রথমিকভাবে তা জিডিপি গণনায় বাদ পড়ে যায় । প্রসংঙ্গক্রমে তিনি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ডাটার মাননিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন । তিনি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ব্যবহৃত তথ্য-উপাত্তকে পৃথিবীতে সবচাইতে মানহীন বলে দাবী করেন । তিনি বলেন প্রতেক দেশই তথ্য-উপাত্তর সত্যতা এবং আর্ন্তজাতিক মান বজায় রাখতে পাচঁ স্তর বিশিষ্ট ফিল্টারিং করে , যা বাংলাদেশ অনুসরণ করে না । তাই শুনতে অস্বস্তি লাগলেও বলতে হয় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রদত্ত তথ্য-উপাত্ত পৃথিবীতে সবচাইতে মানহীন । আরো অনেক গবেষকও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য-উপাত্তর মান নিয়ে নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন ; বলছেন বেকারত্বর প্রকৃত সংখ্যাটি সন্দেহাতীতভাবে আরো অনেক বড় হবে ।
অন্য একটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় বাংলাদেশ এখন কর্মক্ষম জনসংখ্যার দিক দিয়ে স্বর্ণযুগে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসের সুবিধা জনক অবস্থায় রয়েছে । বাংলাদেশের প্রায় ৬৮ শতাংশ জনসংখ্যা কর্মক্ষম । যা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনবৈজ্ঞানিক মুনাফা হিসেবে পরিচিত । কোন দেশে যদি ৬০ শতাংশের বেশী মানুষ কর্মক্ষম থাকে তাহলে সেদেশকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনবৈজ্ঞানিক মুনাফা অবস্থায় আছে বলে গন্য হয় ।
জনসংখ্যার প্রায় সত্তর ভাগ কর্মক্ষম এ ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসেতো বটেই পৃথিবীর ইতিহাসেও বিরল ঘটনা । সঠিকভাবে কাজে না লাগালে এ সুবিধাজনক অবস্থা অচিরেই পরনির্ভরশীল জনসংখ্যার পরিমান বাড়িয়ে দেশের দায় হিসেবে আবির্ভূত হবে । দ্রুত ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করতে পারলে ক্রমবর্ধমান বেকারত্বর কারনে অচিরেই বাংলাদেশের সকল অর্জন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে । তাই , জাতীয় অর্থনীতির অন্যান্য চলক বা অনুঘটক গুলোর এক বা একাধিক অনুঘটককে ধাক্কা দেয়া এখন অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে ।
কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে করোনাত্তোর সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। বিমা খাত হতে পারে কর্মসংস্থানের অপার সম্ভাবনাময় একটি খাত হতে পারে অর্থনৈতিক ঝুঁকি রোধের অন্যতম প্রধান মোক্ষম হাতিয়ারও । ২০২২ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে পৃথিবীতে ৩০তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। অথচ আমাদের দেশের বিমা খাত বিশ্বে ৭৬তম বৃহত্তম এবং বিমা খাতে বাংলাদেশ তলানীর দেশ হিসেবে গন্য । বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ‘বিমা ফাঁক’ প্রায় সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা মোট জিডিপির ২.১ শতাংশ। এটি দেশের অর্থনীতিতে বড় ঝুঁকি তৈরী করছে। উপরন্তু অর্থনীতির আকার আরো বড় হলে উক্ত ‘বিমা ফাঁক’ আরো বেড়ে যাবে। তাই চরম বেকারত্ব এবং বর্ধনশীল অর্থনীতির প্রয়োজনে বাংলাদেশকে তার বিমা খাতের সংস্কার করা অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে।
প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপার্স কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায় মাত্র এক শতাংশ বিমা অবদান বৃদ্ধি দুই শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি করে । এর কারণ এটি ২২শতাংশ অবিমাজনিত ক্ষতি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগোত্তর করঅবদান হ্রাস ১৩ শতাংশ পর্যন্ত ঠেকিয়ে দিতে সহায়তা করে । বিমা অবদানের গাণিতিক বৃদ্ধি জিডিপি বৃদ্ধিকে জ্যামিতিক ভাবে বৃদ্ধি ঘটাবে । বিমা শিল্প কেবল ব্যবসায় বানিজ্যের স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরীতেই অবদান রাখে না বরং প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অর্থনৈতিক সংকটের সময় সরকারের আর্থিক চাপ হ্রাস করতেও সহায়তা করে ।
লন্ডনভিত্তিক বিশ্বের অন্যতম সেরা বিমা মার্কেট লয়েড এর সম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ সাধারণ বিমা খাতে সবচেয়ে কম বিমাকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে । লয়েডের মতে, বাংলাদেশের এমন অবস্থার কারণ প্রতিবছর দেশটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তার জিডিপির দশমিক আট শতাংশ হারায়। লয়েড আরও বলেছে যে, বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হবে বাংলাদেশ। অথচ এ বিষয়ে দেশটির কেন প্রস্তুতি চোখে পড়ছে না এবং ফান্ড রিকোভারি বা তহবিল পুনঃরুদ্ধার সামর্থ্যরে দিক থেকেও বাংলাদেশ সবচেয়ে পিছিয়ে। অতএব , প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অবিমা জনিত ক্ষতি হ্রাস করতে বাংলাদেশকে তার বিমা খাতের সংস্কার করা অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে।
উচ্চ কমিশনের বিনিময়ে প্রিমিয়াম সংগ্রহ, কম পুনঃবিমা, দেরিতে দাবি নিষ্পত্তি, অন্যায্য প্রভাব, খুবই দুর্বল জনশক্তির মান, পরিচালন দুর্বলতা, ব্যাংকারদের কমিশন বাণিজ্য, সার্ভেয়ারদের মনগড়া সার্ভে এবং বিভিন্ন অনিয়মের কারণে এ খাত অগ্রসর হতে পারছে না। মুলত, বর্নিত বিষয়ে প্রয়োজনীয় সরকারী নজরদারী এবং বিমা খাতের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ৩৩টি জীবন বিমা কোম্পানী এবং ৪৬টি সাধারণ বিমা কোম্পানী যথাক্রমে ৮ম বৃহত্তম জনসংখ্যা এবং ৩০তম বৃহত্তম অর্থনীতির কোন সুবিধাই নিতে পারছে না ।
পরিশেষে বলা চলে , করোনা পরবর্তী ব্যাপক বেকারত্বের লাগাম টেনে ধরতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অবিমা জনিত ক্ষতি নূন্যতম পর্যায়ে নামিয়ে আনতে এবং টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে বাংলাদেশকে তার বিমা খাতের ব্যাপক সংস্কার করা অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে। দেশের অর্থনীতির তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রবাহ হিসেবে বিমা খাত ব্যাপক সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে প্রয়োজনীয় গতি পাবে না । এ খাতের জন্য তাই প্রয়োজন সুষ্ঠ মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রনয়ন এবং তার যাথাযথ বাস্তবায়ন । তবেই অর্থনীতিতে গতিশীল তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রবাহ হিসেবে ব্যাপক অবদান রাখতে পারবে বিমা খাত।
মোঃ নূর-উল-আলম এসিএস
সহযোগী সদস্য : ইনিস্টিউট অব চাটার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি)
মোবাইল : ০১৬১০-১২৩২২৩
ইমেইল : csnoor.bd@gmail.com
এএ