রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে টমেটো জনপ্রিয়তা পেয়েছে বেশ। ভাগ্য বদলের আশায় অনেকেই নাম লেখান অনেকেই এদের মাঝে কথা হয় উপজেলার মহিশালবাড়ি শফিকুল ইসালামের সাথে। তিনি তার ভাগ্য বিড়ম্বনার কথা জানান, তারা আট ভাইবোন। পৈতৃক সম্পত্তি বলতে মোটে আট শতক বসতভিটা। সেখানেই কোনো রকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছেন। তারও আলাদা সংসার। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন অনেক আগে। স্ত্রী, ছেলে-পুত্রবধূ এবং নাতি নিয়ে তার এখন ৫ জনের সংসার। ছেলে রাজমিস্ত্রি। বাবা-ছেলের আয়েই ঘুরছে সংসারের চাকা।
তিনি জানান, যখন মজুরি ২০ টাকা ছিল, তখন থেকেই তিনি দিন মজুরি করেন। এখন পান সাড়ে ৩০০ টাকা। এক পর্যায়ে ভাবেন অনেকেই তো টমেটো চাষে ভাগ্য পাল্টাচ্ছে, তিনিও করবেন চাষ। অন্যের জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ শুরু করেন।
এ বছর সোয়া ২ বিঘা জমিতে আট দিনে প্রথম দফায় ১০০ মণ টমেটো তুলেছেন। প্রথম দিকে দাম পেয়েছেন ১ হাজার ২০০ টাকা মণ। এরপর কমতে কমতে এক পর্যায়ে ১০০ টাকায় নেমেছে। তখন শ্রমিকের খরচই ওঠেনি।
টমেটো চাষে ‘কপাল’ লাগে উল্লেখ করে শফিকুল বলেন, কেউ বিঘায় ৫০ হাজার এমনকি লাখ টাকা লাভ করছেন। কিন্তু তিনি ১৬-১৭ বছর চাষ করে বিঘায় ৪০ হাজার টাকার টমেটো পেয়েছেন। সর্বোচ্চ পেয়েছেন ৬০ হাজার টাকার।
আর চারা রোপণ থেকে শেষ পর্যন্ত বিঘায় খরচ অন্তত ৩০ হাজার টাকা। খরচ বাদ দিয়ে বিঘায় ৮ থেকে ১২ হাজার টাকা টেকে।খাটাখাটনিই বৃথা। সেইসঙ্গে শুধু শুধু ফসল নিয়ে টেনশন। ভেবে-চিন্তে দুই বছর ধরে তিনি আর নিজে টমেটো চাষ করেন না। অন্যের জমিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।
মাঠের পর মাঠ টমেটো ক্ষেত। দুপুর গড়িয়েছে অনেক আগেই। খেত থেকে ঘরের পথে পা বাড়িয়েছেন কৃষি শ্রমিকরা। তখনও ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে নিড়ানি দিচ্ছিলেন টমেটো চাষি সাইদুর রহমান। তিনি উপজেলার বারুইপাড়া এলাকার বাসিন্দা। এলাকায় সার ও বীজের
দোকান রয়েছে তার।
এ বছর এক বিঘা জমি লিজ নিয়ে টমেটো চাষ করেছেন তিনি। পাঁচ বছর ধরে টমেটো চাষ করেন। তবে তার গল্পটা একটু ভিন্ন। তিনি বলেন, গাছ একেবারেই উজাড় না হলে টমেটোতে লোকসান হওয়ার কথা নয়। মৌসুমে এক বিঘায় ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় হয় তার। এই ৫ বছরে টমেটো চাষে তার লোকসান হয়নি।
এই চাষি বলেন, মৌসুমের শুরুতে প্রতি মণের দাম পাওয়া যায় ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা। এই দাম নির্ভর করে বাজারে আমদানির ওপরে। তারা কাচা টমেটো তুলে বিক্রি করে দেন। প্রথম দিকে বাজারে আমদানি কম থাকে। ফলে ওই সময় যার ক্ষেতে যত বেশি টমেটো উঠে তিনি ততই লাভবান হন। তবে রোগবালাই ও খারাপ আবহাওয়া হলে ক্ষতির শঙ্কা থাকে।
এখন দেশে টমেটোর রাজধানী হয়ে উঠেছে গোদাগাড়ী। শীতকালীন আগাম ও উন্নত জাতের টমেটো চাষ হয় এই উপজেলায়। মৌসুমে অন্তত কয়েক কোটি টাকার বাণিজ্য হয় টমেটোর। শুরুর দিকে ভালো দাম পেলেও শেষের দিকে দাম মেলে না। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দাম নিয়ন্ত্রণ করে সিন্ডিকেট। ফলে মার খান চাষি।
জানা গেছে, চলতি ২০২১-২০২২ রবি মৌসুমে রাজশাহী জেলায় টমেটো চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৬০০ হেক্টর। এ থেকে ৬৬ হাজার টন টমেটো উৎপাদনের আশা করছে কৃষি দফতর। সোমবার (১৫ নভেম্বর) পর্যন্ত জেলায় ৩ হাজার ৫১৭ হেক্টর টমেটো চাষ হয়েছে। এর মধ্যে গোদাগাড়ীতেই চাষ হয়েছে ২ হাজার ৯৬০ হেক্টর।
জেলা কৃষি দফতরের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরের মধ্যে জেলায় সবচেয়ে বেশি টমেটো চাষ হয়েছে ২০২০-২১ মৌসুমে ৩ হাজার ৬৬০ হেক্টর। এ সময় উৎপাদন হয়েছে ৮২ হাজার ২১ টন টমেটো। সেইবার কেবল গোদাগাড়ী উপজেলায় ২ হাজার ৫০ হেক্টরে টমেটো উৎপাদন হয়েছে ৬৬ হাজার ৩৭৫ টন।
এই কয় বছরের মধ্যে ২০১৯-২০ মৌসুমে সর্বনিম্ন ২ হাজার ৯২৫ হেক্টর টমেটো চাষ হয়েছে জেলায়। সেই বছর টমেটো ফলেছে ৬৬ হাজার ৩২৬ টন। ওই বছর গোদাগাড়ীর ২ হাজার ১৫০ জমিতে টমেটো পাওয়া গেছে ৪৮ হাজার ৩৭৫ টন।
অন্যদিকে এই পাঁচ বছরের মধ্যে টমেটো উৎপাদন হয়েছে ২০১৮-১৯ মৌসুমে। সেই বছর জেলার ৩ হাজার ৩৭৯ হেক্টর জমিতে টমেটো ফলেছে ৭৪ হাজার ৩১৯ টন। এর মধ্যে গোদাগাড়ীতে ২ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে ৫৮ হাজার ৫৯৫ টন টমেটো উৎপাদন হয়।
এছাড়া ২০১৫-১৬ মৌসুমে ৩ হাজার ২৬৬ হেক্টরে ৭৪ হাজার ১১৮ টন, ২০১৬-১৭ মৌসুমে ৩ হাজার ১৪০ হেক্টরে ৬৬ হাজার ৫৩৩
টন এবং ২০১৭-১৮ মৌসুমে ৩ হাজার ২৭৪ হেক্টরে ৭০ হাজার ৬২৪টন টমেটো ফলেছে রাজশাহী জেলায়।
এই তিন বছরে গোদাগাড়ীতে যথাক্রমে ২ হাজার ৫৬০ হেক্টরে ৬১ হাজার ৪৪০ টন, ২ হাজার ৪২০ হেক্টরে ৫৩ হাজার ২৪০ টন এবং ২ হাজার ৬৩০ হেক্টরে ৫৭ হাজার ৮৬০ টন টমেটো উৎপাদন হয়।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কেজে এম আব্দুল আউয়াল জানান, আউশ ধান কেটে নেওয়ার পর গোদাগাড়ীতে টমেটো চাষ হয়। এটা মূলত বর্ষাকালীন টমেটো। প্রায় ৩৬ জাতের টমেটো চাষ হয় এই এলাকায়। এর একটিও আমাদের দেশীয় নয়, সবগুলো হাইব্রিড।
অন্য যেকোনো মাঠ ফসলের তুলনায় টমেটো চাষ অত্যন্ত লাভজনক। বিঘায় প্রায় ৭০ মণ টমেটো উৎপাদন হয়। কম করে প্রতি মণ ১ হাজার টাকা করে হলেও ৭০ হাজার টাকা হয়। যা ধান কিংবা অন্য ফসল চাষে আয় করা সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, এক কথায় টমেটো অর্থকরী ফসল। আগাম উঠায় চাষিরা বাজারে ভালো দাম পান। চাহিদা বাড়ায় প্রতি বছরই চাষের পরিধি বাড়ছে। লাভের আশায় টমেটো পরিপক্ক হওয়ার আগেই চাষিরা সংগ্রহ করে বাজারজাত করেন। পরিপক্ক ও নিরাপদ টমেটো কিভাবে উৎপাদন করা যায় আমরা সেই চেষ্টা করছি। আধুনিক চাষের কলাকৌশল নিয়ে সবসময় মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের পাশে আছেন।
সানবিডি/ এন/আই