পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (পিএলএফএসএল) ব্যবসায়িক পরিকল্পনা চেয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। আগামী ছয় মাসের মধ্যে কোম্পানির কার্যক্রম শুরু করতে সকল ধরণের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। একই সাথে কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন বিশেষ নিরীক্ষা করবে বিএসইসি। সোমবার (২২ নভেম্বর) বিএসইসির উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ।
প্রতিষ্ঠানটি অবসায়ন না করে আবারও পুনর্গঠন বা পুনরুজ্জীবিত করার নির্দেশনা চেয়ে গত জুন মাসে ২০১ জন আমানতকারী আবেদন করেন। এর শুনানিতে ২৮ জুন আদালত প্রতিষ্ঠানটি পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে একটি বোর্ড গঠন করার কথা বলেন। এর ধারাবাহিকতায় ১২ জুলাই বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের একক ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে আদেশ দেন। গত ১৩ জুলাই আদেশের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়। পিএলএফএসএলের সাময়িক অবসায়ক (প্রবেশনাল লিক্যুইডেটর) নিয়োগসংক্রান্ত ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই দেওয়া আদেশ প্রত্যাহার করে ওই পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দেওয়া হয়েছে।
পুনরুজ্জীবিত করতে ১০ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কামাল-উল আলমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আদালতের রায়ে কোম্পানিটির ব্যবসা চালু করার জন্য বিএসইসির নির্দেশনা নিতে বলা হয়েছে কোম্পানির পর্ষদকে। সেই নির্দেশনার আলোকে বিএসইসির উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
পুঁজিবাজারের সব খবর পেতে জয়েন করুন
Sunbd News–ক্যাপিটাল নিউজ–ক্যাপিটাল ভিউজ–স্টক নিউজ–শেয়ারবাজারের খবরা-খবর
বৈঠকের বিষয়ে বিএসইসির কমিশনার অধ্যাপক ড. শামসুদ্দিন আহমেদ সানবিডিকে বলেন, বিনিয়োগকারী ও আমানতকারীদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে মাহামান্য হাইকোর্ট একটি আদেশ দিয়েছে। আদেশে অনেকগুলো বিষয়ের সাথে কমিশনকে কোম্পানির ব্যবসা চালু করার জন্য সময়ে-সময়ে পরামর্শ দিতে বলা হয়েছে। এরই আলোকে আমরা কোম্পানির সাথে বৈঠক করেছি।
তিনি বলেন, বৈঠকে কয়েকটি বিষয়ে আলাপ হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কোম্পানির ব্যবসা চালু করার জন্য একটি বিজনেস প্লান চাওয়া হয়েছে, দ্বিতীয়ত- বিগত চার বছর কোম্পানির কোন বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) হয়নি, তাই এজিএম করার জন্য আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়েছে। কোম্পানির ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করার জন্য কিছু জনবল নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। একই সাথে কোম্পানির শুরু থেকে বন্ধ হওয়া পর্যন্ত একটি বিশেষ নিরীক্ষা করবে কমিশন।
কোম্পানির নতুন পর্ষদ: কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কামাল-উল আলমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পরিচালনা পর্ষদে আনসার ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জালাল উদ্দিনকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রাখা হয়েছে। পর্ষদের অপর সদস্যরা হলেন, সাবেক সচিব আনোয়ারুল ইসলাম সিকদার, অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ হাসান শাহীদ ফেরদৌস, পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হালিম চৌধুরী, সাবেক সেনা কর্মকর্তা (অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) কাজী তৌফিকুল ইসলাম, ফেলো চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট নুর-ই-খোদা আবদুল মোবিন ও মওলা মোহাম্মদ, আমানতকারীদের প্রতিনিধি নাশিদ কামাল, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের চেয়ারম্যান নুরুল কবির।
পিপলস লিজিংয়ের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সদস্য ও তাঁদের সম্মানী নির্ধারণের পাশাপাশি হাইকোর্ট পর্ষদের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পর্ষদের সদস্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যানসহ পিএলএফএসএলের আমাতকারী ও ঋণগ্রহীতাদের প্রতি কয়েক দফা নির্দেশনা দিয়েছেন।
পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের প্রতি চার দফা নির্দেশনার মধ্যে প্রথমটিতে পরিচালনা পর্ষদের সব সদস্য ও সাময়িক অবসায়কের (নিষ্ক্রিয়) সঙ্গে আলোচনা করে সুবিধাজনক সময়ে পরিচালনা পর্ষদের প্রথম সভা আহ্বান করবেন এবং সভা পরিচালনা করবেন। গঠিত পরিচালনা পর্ষদ কার্যকরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে নির্দেশ দিয়ে হাইকোর্ট বলেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আদালত আদেশ দিয়ে চূড়ান্তভাবে সাময়িক অবসায়ককে অব্যাহতি দিচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত সাময়িক অবসায়ককে (নিষ্ক্রিয়) পিএলএফএসএলের পর্ষদে সংযুক্ত রাখবেন গভর্নর।
এনআররবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার) নানা কৌশলে নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলে পুঁজিবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনেন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে নিজের আত্মীয়, বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে পর্ষদে বসিয়ে চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন। ওই চার কোম্পানির মধ্যে পিপলস লিজিংও একটি। পরে গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা লোপাট করে তিনি বিদেশে পালিয়ে যান বলে ২০২০ সালের শুরুতে খবর আসে। তাকে গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের মাধ্যমে জারি করা হয় রেড নোটিশ।
১৯৯৭ সালের ২৪ নভেম্বর আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিপলস লিজিংকে অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর থেকে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকের কাছ থেকে মেয়াদি আমানত ও বিভিন্ন ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা ধার করে ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। তবে ২০১৫ সালের পর থেকে অনিয়ম ও ঋণ জালিয়াতির কারণে প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা ধারাবাহিকভাবে খারাপ হতে থাকলে এবং খেলাপি প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা আদায় করতে না পের আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারেনি।
২০১৯ সালের ১৪ জুলাই পিপলস লিজিং অবসায়নের জন্য আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই দিনই মামলার শুনানি শেষে অবসায়নের পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেয় আদালত।
নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘একনাবিনের’ প্রতিবেদন অনুসারে, প্রতিষ্ঠানটির মোট ঋণের স্থিতি দাড়াঁয় ১ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে মেয়াদি আমানত ৯৯১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, লিজ অর্থায়ন ১০৮ কোটি ৪ লাখ, আবাসন ঋণ ৩৩ কোটি, বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ ২৬ কোটি এবং অন্যান্য সম্পদ ৬৭৭ কোটি টাকা। আর সবমিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রভিশন ঘাটতি ৪১৬ কোটি টাকা।
এই ঘটনায় পরিচালকদের মধ্যে বিশ্বজিৎ কুমার রায়, উজ্জ্বল কুমার নন্দী, আরেফিন শামসুল আলামিন, ক্যাপ্টেন (অব.) এম মোয়াজ্জেম হোসেন, মতিউর রহমান এবং কবির উদ্দিন মিয়া, সিরাজুল ইসলাম মোল্লার বেশি সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। আলোচ্য সময়ে পরিচালকরা বোর্ড মিটিংয়ের সম্মানী হিসেবে প্রায় ৪০ লাখ টাকা নিয়েছেন।
কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন বন্ধ রাখার সময় দফায়-দফায় বেড়েছে। এ নিয়ে ৪৬ দফায় কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন বন্ধ রাখার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ গত ১০ অক্টোবর কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন বন্ধের মেয়াদ ১৫ দিন বাড়ানো হয়েছিল।
জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত পিপলস লিজিংয়ের শেয়ার লেনদেন বন্ধের ঘোষণা করে ডিএসই। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ৯৩২তম বোর্ড সভায় সেই স্থগিতাদেশই বর্ধিত করে গত ১৩ আগস্ট থেকে ২৭ আগস্ট করা হয়।
পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড ২০০৫ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। সর্বশেষ আর্থিক বছরে ২০১৪ সালে শেয়ারহোল্ডারদের ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। বর্তমানে কোম্পানিটি জেড ক্যাটাগড়িতে লেনদেন হচ্ছে। কোম্পানিটির অনুমোধিত মুলধন পাঁচ শত কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ২৮৫ কোটি ৪৪ লক্ষ ১০ হাজার টাকা। মোট শেয়ারের ২৩ দশমিক ২১ শতাংশ রয়েছে উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে। বাকী শেয়ারের মধ্যে ৮.৬২ শতাংশ প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, ০.১৯ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং ৬৭.৯৮ শতাংশ রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে।