পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কোম্পানির মালিকরা গ্রাহকদের ২ হাজার ১২৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। কোম্পানির মালিকরা গত এক দশকে এই টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করেছে। সানবিডির অনুসন্ধান ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বিশেষ নিরীক্ষায় এমন অস্বাভাবিক তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
কমিশনের প্রতিবেদনে সকল লেনদেনকে সুস্পষ্ট মানি লন্ডারিং অপরাধ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি অর্থ মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং সিআইডিকে দিয়েছে। কমিশন সূত্র ও অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,ফারইস্ট লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ২০১০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছে। তার মেয়াদে ধারাবাহিক আর্থিক অপরাধ এবং অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটেছে।
জমি ক্রয়ে টাকা মাইর ও পাচার: টাকা মারার অন্যতম মাধ্যম জমি ক্রয় করা। বিএসইসির প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কোম্পানির নামে জায়গা ক্রয় করা হয়েছে। জমি ক্রয় ও ভবন নির্মানে বড় ধরনের দুর্নীতি করেছে কোম্পানির অপসারিত চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম। স্বার্থসংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে অন্তত ১২টি জমি ও ভবন কেনার ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম করেছে। এর মাধ্যমে কোম্পানির ৮৫৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ। কোম্পানির অর্থ আত্মসাৎ ও ব্যক্তিস্বার্থে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে স্বার্থসংশ্লিষ্ট লেনদেনের (রিলেটেড পার্টি ট্রানজেকশন) অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে কেনা হয়েছে। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হেমায়েত উল্লাহসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় পরিচালকরা অর্থ আত্মসাতের এই নীল নকশা বাস্তবায়ন করেন।
২০১৫ সালের ৩১ মার্চ ফারইস্ট লাইফের পর্ষদ কাকরাইলে পুরনো ভবনসহ ৩২ শতাংশ জমি ১৯৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে ২৮ শতাংশ জমি ১৭২ কোটি টাকায় কেনা হয় মফিজুল ইসলাম ও সেলিম মাহমুদের কাছ থেকে, যারা চেয়ারম্যান নজরুলের শ্বশুর ও শ্যালক। জমিটি ২০১৪ সালের ৮ জুলাই আবুল কাশেম মোহাম্মদ সিদ্দিকী ও অন্য ১৪ জনের কাছ থেকে কেনেন মফিজুল ইসলাম ও সেলিম মাহমুদ। সাবকবলা দলিল অনুযায়ী, মফিজুল ইসলাম ২১ শতাংশ ও সেলিম মাহমুদ অবশিষ্ট ৭ শতাংশ জমি কেনেন মোট ১৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকায়। তারা দুজনই নগদ প্রদানের শর্তে ১৭২ কোটি টাকায় ২৮ শতাংশ জমি বিক্রয় করেন ফারইস্ট লাইফের কাছে। মাত্র ১০ মাসে কৃত্রিমভাবে জমির মূল্য বাড়ানো হয়েছে ১৫২ কোটি ৪২ লাখ টাকা। কাকরাইলের জমিটির অবশিষ্ট ৪ শতাংশ ২০১৫ সালে তিনটি ভিন্ন দলিলের মাধ্যমে ৯ কোটি ২৫ লাখ টাকায় ক্রয় করে ফারইস্ট লাইফ। কোনোরকম ভূমি উন্নয়ন না করেই জমিটির উন্নয়ন বাবদ আরও ৪৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়। সব মিলিয়ে কোম্পানি তৎকালীন চেয়ারম্যান নজরুলের শশুর ও শ্যালককে কাকরাইলের ৩২ শতাংশ জমি ও পুরনো ভবনের জন্য মোট ২২৭ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।
বিএসইসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নজরুল ইসলামের স্ত্রী ও কোম্পানির সাবেক পরিচালক তাসলিমা ইসলামের ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেওয়া আয়কর রিটার্নে দেখা যায়, বাবা মফিজুল ইসলাম ও ভাই সেলিম মাহমুদের কাছ থেকে তাসলিমা ইসলাম ১১৫ কোটি টাকা উপহার হিসেবে পেয়েছেন। যেখান থেকে তিনি তার স্বামী নজরুল ইসলামকে ৫০ কোটি টাকা উপহার হিসেবে প্রদান করেন। এই লেনদেন ব্যাংকিং চ্যানেলে সম্পন্ন হয়েছে। নজরুল ইসলাম ও ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মধ্যে এটি একটি স্বার্থসংশ্লিষ্ট বেআইনি লেনদেন, যার মাধ্যমে নজরুল ইসলাম ও তার পরিবার ব্যক্তিস্বার্থে কোম্পানির ১৯৮ কোটি ২০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে পাচার করেছেন।
একই কায়দায় রাজধানীর তোপখানা রোডের ৩৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ জমি ক্রয়ের মাধ্যমেও বিপুল পরিমাণের অর্থ হাতিয়ে নেন নজরুল। ২০১৪ সালের মার্চে তোপখানা রোডের ওই জমিটি মো. আজহার খান ও মো. সোহেল খানের কাছ থেকে ২০৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকায় কেনার সিদ্ধান্ত নেয় কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ, যারা নজরুলের ব্যবসায়িক অংশীদার। ক্রয়ের সময় জমিটির ১৫ দশমিক ৩০ শতাংশের মালিকানা আজহার খানের নামে দেখানো হয়, যা তিনি মোস্তাফিজুর রহমান ও খালেদুর রহমানসহ অন্যদের কাছ থেকে একই বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি ও ১৬ জানুয়ারি ১২ কোটি ৮৫ লাখ টাকায় ক্রয় করেছিলেন। আর মো. সোহেল খান অবশিষ্ট ১৮ দশমিক ২৬ শতাংশ জমি মোস্তাফিজুর রহমান শামীম ও মজিবুর রহমান শাহীনসহ অন্যদের কাছ থেকে ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর ও ২০১৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ৮ কোটি ৭০ লাখ টাকায় কেনেন।
সব মিলিয়ে জমিটি ক্রয়ে মো. আজহার খান ও মো. সোহেল খানের ব্যয় হয় ২১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এছাড়া জমিটি উন্নয়নের জন্য আরও ২২ কোটি ৯২ লাখ টাকা ব্যয় দেখায় কোম্পানিটি। ব্যবসায়িক অংশীদারদের কাছে স্বার্থসংশ্লিষ্ট এই লেনদেনের মাধ্যমে ফারইস্ট লাইফের ২০৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা পাচার করা হয়েছে, যেখানে চূড়ান্ত সুবিধাভোগী হচ্ছেন নজরুল ইসলাম।
২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে মিরপুরের গোড়ান চটবাড়ী এলাকায় ৬২৯ শতাংশ জমি ক্রয় করা হয় ৭৭ কোটি ২৯ লাখ টাকায়, যেখানে নিবন্ধন ও ভূমি উন্নয়ন ব্যয় বাবদ আরও ১২১ কোটি টাকা দেখানো হয়। অস্বাভাবিক মূল্যে জমি ক্রয় ছাড়াও ভূমি উন্নয়ন ব্যয়ের নামে বিপুল পরিমাণের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন তারা। সব মিলিয়ে গত এক দশকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ১২টি জমি ও ভবন অস্বাভাবিক মূল্যে ক্রয়ের মাধ্যমে ফারইস্ট লাইফের ৮৫৮ কোটি টাকা পাচার করেছেন নজরুলসহ অন্যান্য পরিচালক ও কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা। এসইসির হিসাবে, আত্মসাৎকৃত ওই অর্থের বর্তমান মূল্যমান হচ্ছে ১ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। এসইসি বলছে, ট্রেজারি বন্ড কেনা হলে ১০ বছরে ওই অর্থ দ্বিগুণের বেশি হতো।
ভূয়া পরিচয় ও জাল স্বাক্ষর: কোম্পানির অর্থ লুটপাট করার জন্য একের পর এক অভিনভ কৌশল করা হয়েছে। আত্মসাতের উদ্দেশ্যে কর্মচারীদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও স্বাক্ষর জাল করে ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের তোপখানা শাখায় মোস্তফা জামান হামিদী ও মুহাম্মদ আবদুল মান্নান নামে ঢাকার বাইরের দুজন কর্মকর্তার নামে ব্যাংক হিসাব খোলা হয় ফারইস্ট লাইফের প্রধান শাখা থেকে। বিমার ভুয়া কমিশন সৃষ্টি করে ওই দুই ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন নজরুল ও হেমায়েত উল্লাহ। এভাবে বিভিন্ন ব্যাংকে কর্মচারীদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও জাল স্বাক্ষর দিয়ে হিসাব খুলে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তারা। অনুমোদন ছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্র ও জাল স্বাক্ষর দিয়ে ব্যাংক হিসাব খোলা ও কোটি কোটি টাকা লেনদেন করায় গত ২১ অক্টোবর নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন মুহাম্মদ আবদুল মান্নান।
অবৈধ ঋণে টাকা নিজের পকেটে: বিএসইসির প্রতিবেদনে পর্যালোচনা করে পাওয়া গেছে, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকে ৩৬৯ কোটি ৬০ লাখ টাকার এমটিডিআর (শরিয়াহভিত্তিক আমানত) করে ফারইস্ট লাইফ। ওই এমটিডিআর লিয়েন (বন্ধক) রেখে উদ্যোক্তা-পরিচালক এমএ খালেক ব্যক্তিগতভাবে ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৩১২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ঋণ নেন এবং যথারীতি খেলাপি হয়ে পড়েন। এর ফলে ঋণপ্রদানকারী ব্যাংকগুলো ওইসব এমটিডিআর লিকুইডেট করে। আর ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স তাদের হিসাবে ৪১২ কোটি ৭০ লাখ টাকা এমএ খালেকের নামে ঋণ হিসেবে দেখায়।
এমএ খালেক যেসব স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নেন, সেগুলো হলো পিএফআই সিকিউরিটিজ, প্রাইম প্রপার্টি হোল্ডিংস, প্রাইম ইসলামী সিকিউরিটিজ, ম্যাকসন অ্যাসোসিয়েটস ও ম্যাকসনস বিডি লিমিটেড। এমএ খালেক এসব প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান অথবা প্রভাবশালী পরিচালক হিসেবে ছিলেন। ২০১৮ সালের ৩ নভেম্বর ৩৬৯ কোটি ৬০ লাখ টাকার দায় স্বীকার করে ফারইস্ট লাইফের সঙ্গে খালেক একটি সমঝোতায় পৌঁছান। কিন্তু কোনো অর্থ পরিশোধ করেননি।
বিএসইসির প্রতিবেদনে এসব ঘটনায় ফারইস্ট লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, উদ্যোক্তা এমএ খালেক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেমায়েত উল্লাহর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ এনেছে। এতে বলা হয়েছে, তাদের পারস্পরিক যোগসাজশ ও পরিকল্পনার অর্থ লোপাট হয়েছে। অস্বাভাবিক দামে জমি কেনাবেচার বাইরে তারা নিজেদের স্বার্থসংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে শত শত কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি সাধন করেছেন।
নথি জালিয়াতি : স্বার্থসংশ্লিষ্টদের বেআইনিভাবে ঋণ ও বিনিয়োগের মাধ্যমেও ফারইস্ট লাইফের বিপুল পরিমাণের অর্থ লোপাট করেছেন নজরুল, এমএ খালেকসহ অন্য পরিচালকরা। ফারইস্ট লাইফের ২০১৮ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে (ব্যালান্স সিটে) শেয়ার ও বন্ডে কোম্পানির ৬৮৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ দেখানো হয়। তবে কোম্পানির করপোরেট বুকস অব অ্যাকাউন্টস তদন্তে দেখা যায় যে, কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালক ও শীর্ষ কর্মকর্তা এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট ১৩ জনকে ব্যাংক ঋণের সুবিধা দিতে বোর্ড সভার রেজল্যুশন নকল করে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে মুদারাবা টার্ম ডিপোজিট (এমটিডিআর) খোলা হয়। এ ক্ষেত্রে কোম্পানির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, পরিচালক এমএ খালেক, কেএম খালেদ, মিজানুর রহমান, তাসলিমা ইসলাম, এমএ ওয়াহাব, ডা. ইফ্ফাত জাহান, আয়শা হোসনে জাহান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হেমায়েত উল্লাহ ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে মুদারাবা টার্ম ডিপোজিটের বিপরীতে ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়। আর এসব ঋণ ও এর সুদ পরিশোধ না করায় ফারইস্টকে প্রায় ৬৫৯ কোটি টাকার এমটিডিআর সমন্বয় করতে হয়।
সংশ্লিষ্ট পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে পিএফআই সিকিউরিটিজ, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি, প্রাইম ফাউন্ডেশন, পিএফআই প্রপার্টিজ, মিথিলা প্রপার্টিজ, মিথিলা টেক্সটাইল, আজাদ অটোমোবাইলস ও ম্যাকসন অ্যাসোসিয়েটস।
সমিতি করে টাকা পকেটে: ২০১৩ সালে এফআইএলআইসিএল এমপ্লয়ি কো-অপারেটিভ সোসাইটি এবং ২০১৬ সালে প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড (পিআইএলআইএল) এমপ্লয়ি কো-অপারেটিভ সোসাইটি নামে দুটি সমিতি গঠন করা হয়। এর মধ্যে এফআইএলআইসিএল এমপ্লয়ি কো-অপারেটিভ সোসাইটিকে ১২০ কোটি ৬ লাখ টাকা ও পিআইএলআইএল এমপ্লয়ি কো-অপারেটিভ সোসাইটিকে ৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা অগ্রিম প্রদান করে ফারইস্ট লাইফ কর্তৃপক্ষ। বিএসইসির পক্ষ থেকে নিয়োগ করা বিশেষ নিরীক্ষক দেখতে পান, কোম্পানির বুকস অব অ্যাকাউন্টসে সমবায় সমিতি দুটিতে দেওয়া অর্থ অগ্রিম হিসেবে দেখানো হলেও তা ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে দেওয়া হয়নি। এমনকি ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে এফআইএলআইসিএল এমপ্লয়ি কো-অপারেটিভ সোসাইটি গুটিয়ে ফেলা হলেও কোম্পানির হিসাবে অর্থ ফেরত দেওয়া হয়নি। প্রতারণামূলকভাবে কোম্পানির অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে ওই দুই সমবায় সমিতি গঠন করা হয়েছিল বলে বিশেষ নিরীক্ষক মনে করছেন।
জালিয়াতির সহযোগী নিরীক্ষ: কোম্পানির বিপুল পরিমাণের অর্থ লুটপাটে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে স্বাধীন নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও। ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চারটি স্বাধীন নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান কোম্পানির হিসাব নিরীক্ষা করে। এ সময় করপোরেট গভর্ন্যান্স অডিটে আরও তিনটি প্রতিষ্ঠান যুক্ত ছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান ও তাদের অংশীদাররা জালিয়াতির প্রতিবেদন দাখিল করেছে, যার কারণে আর্থিক বিবৃতিতে ম্যাটেরিয়াল মিসস্টেটমেন্টে ঝুঁকি চিহ্নিত করতে ও মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া দাবি স্তরে লেনদেনের ধরন, অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স ও ডিসক্লোজার দিতেও ব্যর্থ হয়েছে নিরীক্ষকরা। এমনকি ফারইস্ট লাইফে ব্যাপক জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের ঘটনায় পর্যাপ্ত প্রমাণ সংগ্রহ করতেও ব্যর্থ হয়েছে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। সুস্পষ্ট ব্যর্থতার জন্য নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান ও তাদের অংশীদারদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা দরকার বলে মনে করে এসইসির তদন্ত দল। তদন্ত প্রতিবেদনে এসইসি উল্লেখ করেছে যে, ওই অর্থ আত্মসাৎ না করে যদি সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হতো তাহলে লুটকৃত অর্থের বর্তমান মূল্য দাঁড়াত সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
পাত্তা নেই দেড় হাজার কোটি টাকার: ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত নয়টি ব্যাংক ও কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কোম্পানির এক হাজার ৫৬২ কোটি টাকার এমটিডিআর ছিল। পরবর্তী তিন বছরে আরও ৫২৫ কোটি টাকার ডিপোজিট রাখে প্রতিষ্ঠানটি। এতে করে কোম্পানির এমটিডিআর বাবদ মোট ডিপোজিট থাকার কথা দুই হাজার ৮৭ কোটি টাকা। কিন্তু ২০১৮ সাল শেষে কোম্পানির এমটিডিআরের মোট ব্যালান্স ছিল ৪০৪ কোটি টাকা। বিসইসি ধারণা করছে, কোম্পানির শীর্ষ কর্তাদের যোগসাজশে উদ্যোক্তা-পরিচালকরা ব্যক্তিস্বার্থে স্বার্থসংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে কোম্পানির এক হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
যারা করেছেন সহযোগিতা: প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই টাকা লটুপাট করতে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের বড় অংশ, মনোনীত ও স্বতন্ত্র পরিচালক, এমডিসহ কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা সহায়তা করেছেন। এর জন্য সাবেক এমডি ও সিইও হেমায়েত উল্লাহকে বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত করেন নজরুল। এর অংশ হিসেবে মাসে ১২ লাখ সম্মানী দেওয়া হতো তাকে। এককালীন প্রায় ৩ কোটি টাকা কমিশনও দেওয়া হয়েছে হেমায়েতকে। বড় ধরনের সুযোগ পাওয়ার কারণে কোম্পানির কাছে বিভিন্ন সময়ে তথ্য চেয়েও তা পায়নি বিএসইসি।
মূলত ২০১০ থেকে ২০২১ সালে অপসারণের আগপর্যন্ত ফারইস্ট লাইফের চেয়ারম্যান ছিলেন নজরুল ইসলাম। তার আমলেই ধারাবাহিকভাবে আর্থিক অপরাধ ও অর্থ পাচারের ঘটনাগুলো ঘটেছে। ফারইস্ট লাইফের আরও দুই প্রতিষ্ঠান প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি ও প্রাইম এশিয়া ফাউন্ডেশনেরও চেয়ারম্যান ছিলেন নজরুল, যেখানে ফারইস্ট লাইফ বেআইনিভাবে ১০৪ কোটি ৬০ লাখ ও ২৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে।
একটি কোম্পানিতে অডিট কমিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও ১০ বছরে যে অর্থ আত্মসাৎ ও লুটের ঘটনা ঘটেছে সে সম্পর্কে ন্যূনতম তদারকিও করেনি ফারইস্ট লাইফের অডিট কমিটি। বরং অডিট কমিটির সদস্যরাও নজরুলসহ অন্যান্য লুটপাটকারীর সঙ্গে যোগসাজশে কোম্পানির অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। অর্থ লুটপাটে কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সহায়ক ভূমিকা পালন করেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হেমায়েত উল্লাহ। তিনি ২০১০-১১ সালে ছিলেন কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং ২০১২ থেকে ২০২১ সালে তাকে অপসারণের আগ পর্যন্ত এমডি ও সিইওর দায়িত্ব পালন করেন। কোম্পানির অর্থ আত্মসাতে অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তাও একইভাবে সহযোগিতা করেছেন।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য:
বিষয়টি নিয়ে সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, উদ্যোক্তা এমএ খালেক এবং সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেমায়েত উল্লাহকে বারবার ফোন করা হয়। তাদের সকলের ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। অন্য কোনো উপায়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে কোম্পানি সচিব মাহামুদুল হাসান বলেন,বিএসইসির তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে আমরা কিছু জানিনা। তাই এই বিষয়ে মন্তব্য করতে পারে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবির হোসেস সানবিডিকে বলেন, বিমা খাতের সুনাম ফেরাতে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছি। কোন একটি প্রতিষ্ঠানের অপকর্মের দায় পুরো খাত কেন নিবে? কেউ যদি কোন অপকর্ম করে তাহলে আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুণো ব্যবস্থা নিতে পারে। একার জন্য পুরোখাত ক্ষতিগ্রস্থ হতে দেওয়া যাবে না।
এ বিষয়ে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবায়াত-উল-ইসলাম সানবিডিকে বলেন, ফারইস্ট লাইফের বিরুদ্ধে বিএসইসি একটি তদন্ত করেছে। সেখানে বড় ধরণের অনিয়ম ধরা পড়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনটি ইতোমধ্যে আরও কিছু নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে দেওয়া হয়েছে।
তিন আরও বলেন, মালিকদের অপকর্মের কারণে গত ৯ আগস্ট কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে কোম্পানিটিতে ১০ জন স্বতন্ত্র পরিচালক দেওয়া হয়েছে।