"পাহাড়ে পান থেকে চুন খসলেই আমাদের মিডিয়াগুলো খবর প্রকাশ করে। অথচ, গত তিনদিন ধরে, পার্বত্য চট্টগ্রামের কতিপয় নিরীহ, অসহায় পাহাড়ি অামাকে ধর্ষনের হুমকি দিচ্ছে, অামাকে পাহাড়ে নিষিদ্ধ ঘোষনার দাবি জানাচ্ছে, আমার ফেসবুক হ্যাক করার চেস্টা করছে, অশোভন মন্তব্য করছে এবং আমার ছবি ফটোশপের মাধ্যমে বিকৃত করে আমাকে মানসিক ও সামাজিকভাবে ধর্ষণ করেই যাচ্ছে। অথচ, আমার গনমাধ্যমের সহকর্মীরা বসে বসে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে!!"
এটি একজন লেখিকার ফেসবুক পোস্ট। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের জীবনধারা ও রাজনীতি নিয়ে যিনি একটি উপন্যাস লিখেছেন। যার নাম 'ডুমুরের ফুল'। উপন্যাসটির লেখিকা রোকেয়া লিটাকে ধর্ষণের হুমকি পর্যন্ত দিচ্ছে পাহাড়ীরা। লেখিকা তার ফেসবুকের টাইমলাইনে হুমকির স্ক্রীনশট দিয়ে লিখেছেন, “তথাকথিত সহজ সরল কতিপয় পাহাড়ির আসল চেহারা!! ইহারা এখন আমারেই ধর্ষণ করিতে চায়।”
ধর্ষণ করলে প্রথাগত বিচারে তার শাস্তি শূকর জরিমানা। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের প্রথাগত ও পরম্পরাগত নিয়ম এটি।সাংবাদিক রোকেয়া লিটার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘ডুমুরের ফুল’-এ এমনই কিছু অসামঞ্জস্য বিচার ব্যবস্থার বর্ণনা পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, কখনও কখনও বিচারের নামে ধর্ষকের সাথেই ধর্ষিতাকে বিয়ে দেয়া এবং রক্ষক যে ভক্ষক হয়ে যায়, সেই ধরণের ঘটনারও উল্লেখ রয়েছে বইটিতে। এ কারণেই লেখকের উপর চটেছেন পাহাড়ীরা।
দীর্ঘ আট মাস পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে, কখনও বা সীমান্তবর্তী দূর্গম পাহাড়ি এলাকাগুলোতে গিয়ে, পাহাড়িদের সাথে কথা বলে জানার চেষ্টা করেছেন লেখক। লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন পার্বত্যাঞ্চলে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। পাহাড়ীদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতার অনেক ছবি রয়েছে সেখানে।
এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে উপন্যাস লেখা প্রসঙ্গে রোকেয়া লিটা বলেন, ‘আমরা যারা ঢাকায় থাকি, প্রায়ই পাহাড়ে ধর্ষণের খবর পাই। এসব খবর পড়লে মনে হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে যেসব ধর্ষণ হয়, তার সবই ঘটান বাঙালিরা। বিষয়টি আসলে তেমন নয়। কেবল বাঙালি কর্তৃক ধর্ষণের অভিযোগই আসে খবরে। পাহাড়ি পুরুষদের বিরুদ্ধেও ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে অনেক। কিন্তু সেসব বিষয় প্রকাশ্যে আনেন না সেখানকার পাহাড়ি নেতারা। তাই, ঢাকায় বসে বা ২/৩ দিনের জন্য পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে আসলে পাহাড়ের প্রকৃত অবস্থা বোঝা সম্ভব নয়।’
শুধু ধর্ষণ বা প্রথাগত বিচার নয়, বইটিতে উঠে এসেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক অস্থিরতার পেছনের অনেক অজানা তথ্য। আর এজন্যই বইটির নাম রাখা হয়েছে ‘ডুমুরের ফুল।’
লেখক জানান, উপন্যাসটির চরিত্রগুলো বাস্তব, তবে তাদের ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে। বইটির নামকরণ সম্পর্কে লেখক জানিয়েছেন, অনেকেই আমার দ্বিতীয় উপন্যাসের নামকরণের স্বার্থকতা জানতে চাইছেন। অনেকেই বলছেন, ডুমুরের ফুল বলতে তো কিছুই নেই, তাহলে আমার উপন্যাসের এই নাম রাখলাম! ডুমুরের ফুল আসলে ফলের ভেতরে থাকে, বাইরে থেকে দেখা যায় না। এই উপন্যাসে মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতি ও জীবনাচরণকে ভেতর থেকে উন্মোচন করা হয়েছে যা সচরাচর ঢাকায় বসে বা দুই/তিন দিনের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে বেড়াতে গিয়ে বোঝা যায় না। এজন্যই উপন্যাসটির নাম রাখা হয়েছে ডুমুরের ফুল
পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতি ও জীবনাচরণ নিয়ে রচিত এই উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে সময় প্রকাশন। একুশে বই মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে তিন নম্বর স্টলে আজ শুক্রবার থেকে পাওয়া যাচ্ছে উপন্যাসটি।
পাহাড়ীদের দাবী তাদের প্রতিবাদের মুখে বইটির উপর প্রকাশিত বুক রিভিউ দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকা তাদের অনলাইন ভার্সন থেকে তুলে নিয়েছে। কালের কণ্ঠের অনলাইন ভার্সন পরীক্ষা করে দেখা গেছে সেখানে এ সংক্রান্ত কোনো বুক রিভিউ নেই। তবে প্রত্যাহার সংক্রান্ত কোনো ঘোষণাও দেয়নি তারা।
বইটি সম্পর্কে লেখক বিভিন্ন সময় তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানিযেছেন, প্রতিবছর শান্তি চুক্তি দিবস এলে ঢাকা থেকে সাংবাদিকরা পাহাড়ে যায় রিপোর্ট করতে। বেশিভাগ প্রতিবেদনই বিগত বছরের পুনরাবৃত্তি। আর সারা বছর প্রতিবেদন পাঠায় স্থানীয় প্রতিনিধি। স্থাণীয় প্রতিনিধিদের বেশিভাগই পাহাড়ি, আর নিউজ করার জন্য এদের প্রিয় বিষয় হলো, “বাঙালী কর্তৃক পাহাড়ি নারী ধর্ষণ”। আমি বলবো পাহাড় রাজনীতির সবচে বড় হাতিয়ার হলো “পাহাড়ি নারী ধর্ষণ”। ধর্ষণ আর শান্তি চুক্তি ছাড়াও যে আরও হাজারটা বিতর্কিত ইস্যু আছে পাহাড়ে, তা হয়তো কখনও বুঝতেই পারতাম না “ডুমুরের ফুল” লেখা শুরু না করলে!! আমি বলবো, পাহাড়ের আজকের এই অবস্থার জন্য অনেক বেশি দায়ী আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলো এবং কিছু এনজিও। ক্ষেত্র বিশেষে, এসব সংবাদপত্র ও এনজিও কাজ করেছে পাহাড় রাজনীতির ফুয়েল হিসেবে।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, আমার মনে হয় এতোকিছু করতে হবে না, থানায় গিয়ে খোঁজ নিলেও কিছু তথ্য পাওয়া যাবে। তবে, সমস্যা হলো, পাহাড়ি মেয়েদের খুব একটা দেখা যায় না যে, তারা ধর্ষণ নিয়ে বাঙালীর ওপর দোষারোপ করছে। বেশিভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় পাহাড়ি পুরুষরা এই বিষয়টির রাজনীতিকরণ করছে এবং সেভাবেই প্রচার চালাচ্ছে..
পাহাড়ী নারী ধর্ষণ সম্পর্কে লেখিকা আরো বলেছেন, আজকে একজনের লেখা পড়লাম। তিনি লিখেছেন, “বাঙালী সেটেলারদের কাছে পাহাড়ি মেয়েরা ভোগ্যপণ্য”। এই কথাটি শুনলে প্রথমেই মনে হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালী সেটেলারদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে বোধ হয় শুধুই ধর্ষণ করার জন্য। তাদের আর কোনো কাজ নেই সারাদিন তারা শুধু মদ খায় আর পাহাড়ি মেয়েদের ধরে এনে ধর্ষণ করে। এমনকি এসব লেখা পড়লে মনে হয়, এই যে শীতকাল এলেই দলে দলে বাঙালীরা পাহাড়ে বেড়াতে যায়, তারাও বোধ হয় শুধু পাহাড়ি মেয়েদের ধর্ষণ করতেই যায়। বলি, পাহাড়ি মেয়েরা কি এতই রুপবতী আর এতই অাকর্ষনীয় হয়ে গেছে যে, বাঙালীরা সারাক্ষণ তাদের ধর্ষণ করার জন্য ওঁত পেতে বসে আছে!!
তবে, পাহাড়ে ধর্ষণের ঘটনা যে ঘটছে না, তা কিন্তু নয়। হয়ত, এসব ঘটনার সাথে বাঙালীরাও জড়িত। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা একেবারেই ভিন্ন। প্রায় আট মাস পার্বত্যচট্টগ্রামে ছিলাম, দুজন পাহাড়ি মেয়ে ধর্ষণের ঘটনা আমার কানে এসেছে। আশ্চর্য্যজনক হলেও সত্যি যে, দুটি ঘটনাতেই অভিযোগ পাহাড়ি পুরুষের বিরুদ্ধে। আরও অবাক হয়েছিলাম যে বিষয়টি দেখে, দুটি ঘটনাই ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল, ধর্ষকের বিচার চেয়ে কোনো আন্দোলন নেই, নেই কোনো মিছিল, পত্রিকার পাতায়ও কোনো খবর নেই!! অথচ, ঢাকায় বসে আমরা শুধু খবর পাই, বাঙালীরা পাহাড়ি মেয়েদের ধরে এনে ধর্ষণের উৎসব পালন করছে। বুঝতে সমস্যা হয় না, এগুলোই হলো পাহাড়ের আসল রাজনীতি, এই রাজনীতির অনেকটা জুড়েই রয়েছে আমার উপন্যাস ” ডুমুরের ফুল (সময় প্রকাশন)”।