বাংলাদেশের মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর অন্যতম একটি হল ক্যানসার। এক বছরে দেশে নতুন করে ক্যানসার রোগী শনাক্ত হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার ৭৮১ জন। তাদের মধ্যে মারা গেছেন ১ লাখ ৮ হাজার ১৩৭ জন। ক্যানসার শনাক্ত ও মৃত্যুর হারে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যাই বেশি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অফ পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের করা এক গবেষণা থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
বুধবার (৫ জানুয়ারি) শহীদ ডা. মিল্টন হলে আয়োজিত এক সেমিনারে এ গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয়। গবেষণাটি উপস্থাপন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. শেহরিন রায়না।
গবেষণা করতে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) সেবা নেয়া ক্যানসার রোগীদের মধ্য থেকে।
তথ্য সংগ্রহের জন্য এক বছর ধরে প্যাথলজিভিত্তিক ক্যানসার রেজিস্ট্রি কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
১ জানুয়ারি ২০১৮ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত বিএসএমএমইউ সার্জারি বিভাগে হিস্টোপ্যাথলজিকাল ডায়াগনোসিসের জন্য যারা সজিন্স টিউমারের নমুনা জমা করেছেন, তাদের থেকে ক্যানরেজ সফটওয়্যারের মাধ্যমে তথ্যগুলো সংগ্রহ করা হয়।
গবেষণার জন্য ২১ হাজার ১৭৫ ডায়াগনোসিসের নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, আক্রান্তের মধ্যে ৫৯ দশমিক ৫ শতাংশই নারী এবং ৪০ দশমিক ৫ শতাংশ পুরুষ।
পুরুষের তুলনায় নারীরা কম বয়সে ক্যানসার আক্রান্তের হারও বেশি।
গবেষণায় বলা হয়, নারীরা ১৫ বছর বয়স থেকে ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং ৪৬ বছরের মধ্যে বেশি রোগী পাওয়া যাচ্ছে।
এদিক থেকে আবার পুরুষের বেশির ভাগই ২০ বছরের পর থেকে আক্রান্ত হচ্ছেন, আর ৫০ বছর বয়সের মধ্যেই বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে।
গবেষণা থেকে পাওয়া গেছে, প্রজননতন্ত্রের ক্যানসারে আক্রান্তের হার পুরুষের তুলনায় নারী বেশি। ৫৫ শতাংশ নারী এই ক্যানসারে আক্রান্ত।
এ ছাড়া আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর ২৩ শতাংশ স্তন ক্যানসার, ২১ দশমিক ৫ শতাংশ জরায়ু ক্যানসার এবং ৮ দশমিক ৯ শতাংশ মুখগহ্বরের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন।
বেশিসংখ্যক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে ফুসফুসের ক্যানসার, লিউকেমিয়া ও লিঙ্গোমায় ভুগতে দেখা গেছে।
প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের মধ্যে স্তন ক্যানসার, থাইরয়েড ক্যানসার এবং জরায়ুমুখ ক্যানসারের আধিক্য দেখা গেছে।
আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের অর্ধেককেই দেশি প্রজননতন্ত্রের ক্যানসারে ভুগতে দেখা গেছে।
শিশুদের বেলায় ছেলে ও মেয়ে উভয় ক্ষেত্রেই লিউকেমিয়া ছিল সর্বোচ্চসংখ্যক।
সুপারিশ
ক্যানসার শনাক্ত, চিকিৎসা ও আগে থেকেই সচেতন করে তুলতে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছেন গবেষকরা।
ক্যানসার রেজিস্ট্রি সহজ করতে সবগুলো বিভাগকে অটোমেশনের আওতায় আনার ওপর বেশি জোর দেয়া হয়েছে সুপারিশে।
ভবিষ্যতে ক্যানসার রোগীদের শনাক্ত করার জন্য বিশেষ শনাক্তকরণ নম্বর প্রদান করা যেতে পারে।
ক্যানসারের সঠিক প্রকারভেদ করা এবং সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে তা বোধগম্য করে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের আয়োজন করা।
সারা দেশের ক্যানসারের সঠিক তথ্য পেতে জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার রেজিস্ট্রি চালু করা উচিত।
ক্যানসার রেজিস্ট্রিতে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত DHIS2-তে সংযুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া।
ক্যানসার রেজিস্ট্রির স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত যৌথ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
ক্যানসার রেজিস্ট্রির কারিগরি দিক উন্নত করতে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতা গ্রহণ করা যেতে পারে।
ক্যানসার রেজিস্ট্রির পাশাপাশি এ সংক্রান্ত গবেষণার জন্য ইন্ডাস্ট্রি-বিশ্ববিদ্যালয় সহযোগিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
কেন আক্রান্ত বাড়ছে
ক্যানসারে আক্রান্তের হার নারীদের বেশি জানিয়ে বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির যুগ্ম মহাসচিব অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, ‘নারীদের আক্রান্ত হওয়ার হার কিছুটা বেশি। তবে কেন বেশি তার মূল কারণ অনুসন্ধানে আরও গবেষণা প্রয়োজন।’
জাতীয় ক্যানসার সোসাইটির সাম্প্রতিক এক গবেষণায় তথ্য উঠে আসে, ধূমপায়ীদের একটি বড় অংশ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন।
মাত্রাহীন নগরায়ণের কারণে ব্রেস্ট ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলেও জানান এ বিশেষজ্ঞ।
ফ্যাটি লিভার তৈরি করে এ ধরনের খাবার গ্রহণে ক্যানসারের আশঙ্কা থাকে। ফ্যাটজাতীয় ও ভেজাল খাবার খেলে ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বেশি। পরিবেশগত কারণেও মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হতে।
বায়ু দূষণের কারণে ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে বলে গবেষণা তথ্যে উঠে এসেছে। সে কারণে ধূমপান ও বায়ুদূষণ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
দেশে ক্যানসারে আক্রান্তদের মধ্যে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ ধূমপান বা তামাকজাতীয় দ্রব্য সেবন করেন। আর ২৭ শতাংশ নারী পানের সঙ্গে জর্দা খেতেন বলে গবেষণায় দেখানো হয়েছে।
চিকিৎসাসেবা জেলা পর্যায়ে
অবশ্য কিছুদিন আগেও দেশে ক্যানসারের চিকিৎসা সহজলভ্য ছিল না। যেটুকু ছিল তা-ও খুব ব্যয়বহুল। চিকিৎসা সহজলভ্য ও ব্যয় কমে আসায় চিকিৎসা নেয়ার প্রবণতা বাড়ছে বলে জানান গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক।
তিনি বলেন, ‘এখন জেলা পর্যায়ে ক্যানসার চিকিৎসার বিস্তার ঘটছে। গ্রামের মানুষ সেখানে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পারছেন, বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা চিকিৎসা দিতে গ্রামপর্যায়ে যাচ্ছেন। ফলে চিকিৎসা নিয়ে জটিলতা ও ব্যয় অনেকটাই কমে এসেছে।’
পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক অধ্যাপক সৈয়দ শরীফুল ইসলামের সভাপতিত্বে এবং প্যাথলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ কামালের সঞ্চালনায় সেমিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো জাহিদ হোসেন, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. এম মোস্তফা জামান, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সাবরিনা ফ্লোরা, হেলথ ইনফরমেশন ইউনিটের প্রধান ডা. শাহ আলী আকবর আশরাফি।
এএ