শিল্প-কারখানায় পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে ৬৬ শতাংশ নিয়মবহির্ভূত আর্থিক লেনদেন হচ্ছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রেণিভেদে সার্বিকভাবে সর্বনিম্ন ৩৬ হাজার থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ আট হাজার ৮০০ টাকা নিয়মিতবহির্ভূত আর্থিক লেনদেন হয়। আবাসিক এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন না করার আইনি বিধান থাকলেও ৭২ শতাংশ শিল্প-কারখানা আবাসিক এলাকায় অবস্থিত। ক্ষমতার অব্যবহার ও ক্ষেত্রেবিশেষে অবৈধ অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে এটি করা হয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে।
বুধবার (৫ জানুয়ারি) ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ‘পরিবেশ অধিদপ্তরে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এ প্রতিবেদন তুলে ধরেন টিআইবি’র রিসার্চ ফেলো নেওয়াজুল মাওলা।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এ জরিপ পরিচালিত হয়। মিশ্র পদ্ধতির এ গবেষণ গুণগত এবং পরিমাণগত পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগ করে তথ্য সংগ্রহ, যাচাই ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই গবেষণায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ করা হয়।
প্রত্যক্ষ তথ্যের উৎস হিসেবে সংশ্লিষ্ট পরিবেশ অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, পরিবেশ ছাড়পত্র গ্রহীতা, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, ইআইএ পরামর্শক এবং পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে মোট ৩০টি মুখ্য তথ্যদাতার সাক্ষাৎকার, সাতটি পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এবং প্রধান ও মাঠ পর্যায়ের কার্যালয়ের পর্যবেক্ষণ, ৩৫৩টি পরিবেশ ছাড়পত্র গ্রহীতার ওপর জরিপের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
পরোক্ষ তথ্যের উৎস হিসেবে সংশ্লিষ্ট আইন, বিধি ও নীতিমালা, প্রাসঙ্গিক গবেষণা প্রতিবেদন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রকাশিত প্রতিবেদন, সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিবেদন এবং ওয়েবসাইট পর্যালোচনা করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, জাতিসংঘ পরিবেশ সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর মোট মৃত্যুর মধ্যে প্রায় এক-চতুর্থাংশ (১২.৬ মিলিয়ন) মানুষের মৃত্যু হয় পরিবেশগত বিপর্যয়জনিত কারণে। এনভায়রনমেন্টাল পারফরমেন্স ইনডেক্স (ইপিআই), ২০২০ অনুযায়ী, পরিবেশ দূষণ রোধে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম এবং ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম।
বায়ুদূষণের বিভিন্ন উপাদানের বাৎসরিক গড় উপস্থিতির হিসেবে দূষণের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে; দূষিত রাজধানীর তালিকায় ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয় (আইকিউএয়ার, ২০২০)। বায়ু দূষণজনিত কারণে গত এক দশকে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৩১ হাজার ৩০০ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে (এইচইআই, ২০২০)।
গবেষণার সার্বিক পর্যবেক্ষণসমূহ হলো
* পরিবেশ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইন, বিধিমালাসহ সম্পূরক আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগে ব্যর্থ হয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
* কর্মীদের একাংশের অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বড় অঙ্কের নিয়মবহির্ভূত আর্থিক লেনদেন এবং তা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ঘাটতির ফলে পরিবেশ অধিদপ্তরে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে।
* অধিদপ্তরের কর্মীদের একাংশের সাথে পরিবেশ দূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের একাংশের যোগসাজশ; এবং তাদের প্রভাবের কাছে আত্মসমর্পণ করার কারণে অধিদপ্তরের কার্যকারিতা ব্যাহত হয়েছে।
* অধিদপ্তরের কার্যক্রমে সুশাসনের বিভিন্ন নির্দেশ, যেমন- স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা, জনসম্পৃক্ততা এবং কার্যকর সমন্বয়ে ঘাটতি বিদ্যমান।
* একদিকে সামর্থ্যের ঘাটতি এবং অন্যদিকে সরকারের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রভাবিত হয়ে বস্তুনিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণে ঘাটতির কারণে পরিবেশ রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
* কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ সরকারি বিভিন্ন বড় উন্নয়ন প্রকল্প এবং শিল্প কারখানা স্থাপনই মূলত পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী হলেও এক্ষেত্রে পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ অগ্রাধিকার কার্যক্রমের অংশ হওয়ার কথা থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের বিদ্যমান ক্ষমতা প্রয়োগে ব্যর্থতা লক্ষণীয়।
* আমলানির্ভরতা, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ঘাটতি, নিরীক্ষায় ঘাটতি, পেশাগত দক্ষতার ঘাটতি এবং অনেক ক্ষেত্রে সৎ সাহস ও দৃঢ়তার ঘাটতির কারণে পরিবেশ অধিদপ্তর একটি দুর্বল, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অনেকাংশে অক্ষম ও অকার্যকর একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিণত হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যক্রমে সুশাসনের চ্যালেঞ্জসমূহ চিহ্নিত করে তা থেকে উত্তরণে টিআইবি ১০ দফা সুপারিশ প্রস্তাব করে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-
১. আইনের যথার্থ প্রয়োগে ভয়, চাপ ও আর্থিক প্রলোভনের ঊর্ধ্বে থেকে দৃঢ়তার সঙ্গে পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী বড় উন্নয়ন প্রকল্প এবং শিল্প কারখানাগুলো জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে।
২. প্রেষণে পদায়ন না করে অধিদপ্তরের নেতৃত্বে বিশেষায়িত জ্ঞানসম্পন্ন ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে হবে।
৩. যথাযথ চাহিদা নিরূপণ সাপেক্ষে সব কার্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক বরাদ্দ, পর্যাপ্ত অবকাঠামো, কারিগরি ও লজিস্টিকাল সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. ওয়েবসাইটকে আরও তথ্যবহুল (যেমন- নিরীক্ষা প্রতিবেদন, পূর্ণাঙ্গ বাজেট, প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ তথ্য, বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে করা জরিমানা ও আদায়ের পরিমাণের ওপর পূর্ণাঙ্গ তথ্য, সব প্রকল্পের ইআইএ প্রতিবেদন নিয়মিত হালনাগাদ করতে হবে।
৫. পরিবেশ সংক্রান্ত পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তালিকাভুক্ত করে পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী ত্রুটিমুক্ত পরিবেশগত সমীক্ষা সম্পন্ন নিশ্চিত করতে হবে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিদপ্তরের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
৬. প্রকল্প বাস্তবায়ন, দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ সংরক্ষণের সঙ্গে জড়িত সব কর্মীর বার্ষিক আয় ও সম্পদের বিবরণী বছর শেষে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়াসহ তা প্রকাশ করতে হবে।
৭. পরিবেশ ছাড়পত্রকেন্দ্রিক অনিয়ম-দুর্নীতি এবং বিভাগীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তি প্রদানের নজির স্থাপন করতে হবে।
৮. ইটিপির কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং ইআইএ প্রতিবেদন অনুযায়ী মিটিগেশন প্ল্যান ও ইএমপি তদারকি বৃদ্ধিসহ পরিবেশগত নিরীক্ষার (এনভায়রনমেন্টাল অডিট) ব্যবস্থা করতে হবে।
৯. দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ সংরক্ষণ কার্যক্রম তদারকি ও পরিবীক্ষণে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সম্প্রসারণ এবং এর কার্যকর ব্যবহার করতে হবে।
১০. আইন সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবেশ আদালতে সাধারণ মানুষের সরাসরি মামলা করার সুযোগ রাখতে হবে।
এএ