বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য হ্রাসের একটি চিত্তাকর্ষক ট্র্যাক রেকর্ড রয়েছে। গত এক দশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দ্রত বর্ধনশীল অর্থনীতির তালিকায় স্থান পেয়েছে। এ সাফল্যের পিছনে রয়েছে বিশাল জনগোষ্ঠী, শক্তিশালী তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানী আয় এবং স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনীতি। অব্যাহত রপ্তানি আয় এবং উপভোগ পুনরুদ্ধার অর্থবছর ২২-এ প্রবৃদ্ধির হার ৬.৪ শতাংশে উঠতে সাহায্য করবে। বাংলাদেশের উপর সাম্প্রতিক বিশ্বব্যাংকের পর্যালোচনায় উপরোক্ত বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
বুধবার ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স-বাংলাদেশের (আইসিসিবি) পাঠানো ত্রৈমাসিক বুলেটিনের সম্পাদকীয়তে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলির মধ্যে একটি ছিল এবং এর মাথাপিছু জিডিপি ছিল বিশ্বের দশম সর্বনিম্ন। সেই অবস্থা থেকে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের অবস্থানে পৌঁছেছে। ২৪ নভেম্বর ২০২১ তারিখে অনুষ্ঠিত ৭৬তম জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৪০তম পূর্ণাঙ্গ বৈঠকে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়।
যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনের অন্যতম প্রধান সূচক হলো পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ। ঢাকার বিদ্যুতায়ন শুরু হয় ১৯০১ সালে, নিউইয়র্কের মাত্র ১৯ বছর পর এবং লন্ডনের ১৩ বছর পর। ১৯৪৮ সালে, তৎকালীন সময়ে প্রধানত ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং খুলনায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী মাত্র কয়েকটি স্টিম টারবাইন ছিল। ১৯৬২ সালে, একটি ছোট ৪০ মেগায়াট কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে চালু করা ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইনের সাথে স্থাপন করা হয়েছিল।
১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর জনসংখ্যার মাত্র ৩ শতাংশের বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ ছিল। বর্তমানে বাংলাদেশের ২৩,০০০ মেগাওয়াাটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে এবং ১০০% জনগোষ্ঠী বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (বিপিডিবি) সূত্রানুসারে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে উদ্বৃত্ত প্রায় ৮,০০০ মেগাওয়াট।
বাংলাদেশের জিডিপি গত এক দশকে অর্থাৎ ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সালে ৬.৫ থেকে ৮.২-এ উন্নীত হয়েছে। ২০১০ সালে, সরকারী খাতে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৩,৫০০ মেগাওয়াট। ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আইসিসি বাংলাদেশের এনার্জি ফর গ্রোথ সম্মেলনে ১৫টি দেশের বিশেষজ্ঞরা অংশ নিয়েছিলেন, তারা ফিদেল রামোসের ফিলিপিন্সের রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময়ের সাফল্যের কথা উল্লেখ করে টেন্ডার ছাড়াই বেসরকারি খাতের জন্য বিদ্যুৎ খাত উন্মুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সরকার পরামর্শটি অনুসরণ করেছে এবং এর ফলে দেশে এখন উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে বাণিজ্যিক জ্বালানি সম্পদ হল: দেশীয় প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, আমদানি করা তেল, এলপিজি, আমদানি করা এলএনজি, আমদানি করা বিদ্যুৎ এবং জলবিদ্যুৎ। তন্মোধ্যে প্রাথমিক এনার্জির প্রায় ২৭ শতাংশ পূরণ করে বায়োমাস এবং বাকি ৭৩ শতাংশ পূরণ হয় বাণিজ্যিক এনার্জি দ্বারা। প্রাকৃতিক গ্যাস বাণিজ্যিক বিদ্যুতের প্রায় ৬২ শতাংশ (৮% আমদানি করা এলএনজি সহ) এবং আমদানি করা তেল দ¡ারা বাকি অংশের সিংহভাগের প্রয়োজন মেটানো হয়।
সাম্প্রতিক বিশ্ব প্রবণতা অনুসারে, এলএনজি এবং কয়লার সরবরাহ কেবল অনিশ্চিত নয়, কয়লা এবং গ্যাস ভিত্তিক প্ল্যান্ট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়বহুল হয়ে উঠতে পারে। দেশটি গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে, কিন্তু ট্রান্সমিশন দুর্বলতার কারণে অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘন ঘন বিঘেœর অভিযোগ গ্রাহকরা এখনও করে থাকেন।
এটি বিপিডিবির পরিসংখ্যানেও প্রতিফলিত হয়েছে,পরিসংখ্যান অনুসারে দেশের ট্রান্সমিশন ক্ষমতা গত এক বছরে ১২,৮৮৮ সার্কিট লাইন কিমি থেকে মাত্র ১০৪ সার্কিট লাইন কিলোমিটার বেড়ে ১২,৯৯৬ কিলোমিটার হয়েছে। আগামী ২/৩ বছরের মধ্যে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ১,৩২০ মেগাওয়াট, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ১,২০০ মেগাওয়াট এবং রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে ২,৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
এছাড়াও, অধিক সিস্টেম লস, নতুন প্ল্যান্ট সম্পূর্ণ করতে বিলম্ব, কম দক্ষতা সম্পন্ন প্ল্যান্ট, অনিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ, বিদ্যুৎ চুরি এবং পাওয়ার প্লান্ট রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তহবিলের ঘাটতি সমাধানে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপি ৪৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ১৯৭১ সালে ছিল মাত্র ৬.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আশা করা হচ্ছে যে ২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপি ৫১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলাওে উন্নীত হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ৭ শতাংশের বেশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের আনুমানিক ৩৪,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে। তাই বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন যে অন-শোর এবং অফ-শোর গ্যাস ও তেল অনুসন্ধান, বিদ্যুৎ সঞ্চালন এবং বিতরণ বিভাগগুলির উন্নয়নের জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
এএ