লেখনী শৈলীতে আবিয়ার মারিয়া
জীবিকার তাগিদে মানুষকে কত কিই না করতে হয়।পরিবার-পরিজন,ঘর বাড়ি ছেড়ে অচেনা পথে পাড়ি দিতে হয়।কেউ ব্যস্ততায় ডুবে থেকে সন্ধান করে রিযিকের,কেউ বা আবার পায়ের উপর পা তুলে বসে সামনে সব রিযিক পেয়ে যায়।
গল্পটা এমনই এক আর দশটা পরিবারের মত সাধারণ পরিবারের।শারাফাত মিয়া গ্রামের গৃহস্থী করেন,বেশ কিছু জমি আছে,ফসল ভালোই ফলে,সেই টাকায় ৪ মেয়েকে যথাসাধ্য সুশিক্ষা আর সুশৃঙ্খলতার সাথে মানুষ করার চেষ্টা করেছেন,অভাব অনটনে না খেয়ে ছিলেন,তবু মেয়েদের গায়ে আঁচড় লাগতে দেননি।তবে তারা সবাই এখন আর বাবা মায়ের সাথে নেই।বড় মেয়ে আমিরা চট্টগ্রামে পড়াশোনা শেষ করে একটা ভালো কোম্পানিতে চাকুরী করছে।ছোট মেয়েগুলোও গ্রামেই ছিল,তবে কিছুদিন আগে ২জন বড় বোনের কাছে গেছে,পড়ালেখা করতে শহরে যেতে হবে তো!
আমিরা আগে লেডিস হোস্টেলে থাকত। সেখানে থেকে গ্রেজুয়েশন শেষ করেছে আল্লাহর রহমতে।কয়েক মাস আগে বাড়ি যাওয়ার পর বাবা ডেকে পাঠায়,
-মা,বস,কিছু কথা বলমু ভাবছি তোর কাছে।
-জ্বী আব্বা,বলেন
-তুই তো শহরে পড়াশোনা করলি,বড় হইলি,এখন আলহামদুলিল্লাহ একটা চাকরীও করতেছিস।তুই যেমন শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না,বাস্তবতার শিক্ষায় শিক্ষিত হইছিস,তোর বইনদেরো তো হইতে হবে,তাই না?
-জ্বী আব্বা।
-ভাবতেছি,ওদেরকেও তুই নিয়া যা।শহর দেখুক,চলুক,বাহিরের দুনিয়াটা জানুক।হুট কইরা একটা পরিস্থিতিতে পইড়া গেলে কিভাবে সামলাইব,কার সাথে কেম্নে চলব,দুনিয়ায় হাজার রকম মানুষ,তাদের চালচলনও হাজার রকম।এদের সাথে কেম্নে চলা লাগব,এগুলাও তো বুঝা দরকার,তাই না?
-জ্বী আব্বা
-তুই ওগোরে শহরে নিয়া যা।কই কেম্নে ভর্তি করাবি,কেম্নে যাইব,এগুলা আলোচনা কর,বইনেরা বুইঝা ল,তোর আম্মার লগে কথা ক,সিদ্ধান্ত নে,বুঝলি?
-জ্বী আব্বা।
-আর খরচপাতি আমি দিমু,অসুবিধা নাই।আল্লাহ যখন তোরে দিবার মতন ক্ষমতা আমারে দিসে,ওগোরেও দিতে পারমু।বুঝছস কি বলছি?
-জ্বী আব্বা।
শারাফাত মিয়া উঠে যান।আমিরা ভাবতে থাকে।রাতে বাবার কাছে যায়।
-আব্বা,কিছু কথা ছিল
-বল মা
-আব্বা,আমি নামিরা আর সামিরার খরচ নিজে বহন করতে চাই।
শারাফাত মিয়া মুখ খুলেন কিছু বলার জন্যে,আমিরা হাত তুলে থামিয়ে বলে,
-আব্বা,আমি শেষ করি নাই।আপনে তো আজ পর্যন্ত আমাদের সবার খরচ দিয়া গেছেন,যতই কষ্ট হোক,মানা কোনোদিন করেন নাই।না খায়াও আমারে টাকা পাঠাইছেন।আব্বা,আমি মেয়ে মানুষ,ছেলের মত লাখ টাকা কামাতে পারব নাকি জানি না,কিন্তু যেটুকু কামাই,ঐটা দিয়ে আপনার একটু হইলেও কাজে আসতে চাই।আমারে মানা কইরেন না আব্বা।লাগলে আপনারে জানামু,আপনে তখন দিয়েন?কিন্তু আমি যা পাই,তা দিয়া ওগোরে খুব না হোক,ভাল রাখতে পারমু।আর আপনেই তো শিখাইছেন,রিযিকের মালিক আল্লাহ।ওরা আমার কাছে থাকলে রিযিকও আল্লাহই দিব।আমার এই অনুরোধটা রাখেন আব্বা?প্লিজ?
শারাফাত মিয়ার কঠিন গাল বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে,চোখের জল খুব দুষ্টু,আবেগ লুকাতে দিল না।মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেয়ে উঠে যান।মনে মনে ভাবেন,মেয়ে আমার বড় হয়ে গেছে!
আমিরা ভুল শিখেনি,না শারাফাত মিয়া ভুল শিখেয়েছেন।আমিরা হোস্টেল ছেড়ে দুরুমের একটা ছোট্ট বাসা ভাড়া নেয়।বাড়িওয়ালার মেয়ে ওর কলেজের বান্ধবী, তাই চাইতেই ভাড়া পেয়ে যায়। বোনদের নিয়ে নতুন বাড়িতে ওঠার ১ মাসের মাথায় তাকে তার বস অফিসে ডেকে পাঠায়।
-আমিরা!Please be seated.
-Yes sir.
-How's your day going?
-Quite well sir,Alhamdulillah.
-That's the spirit! I have a good news for you!
-Me?what sir?!
-You got promoted!
-What! I can't believe my ears! Is that so?Alhamdulillah,all praise goes to Allah!
বস গলা খাঁকড়ি দেয়।
-আমিরা!প্রমোশন আমি দিয়েছি।
-জ্বী স্যার,তা অবশ্যই।তবে সে প্রমোশন অন্য কেউ না পেয়ে আমি পেয়েছি,এবং আল্লাহ আমাকে এর জন্য বাঁচিয়ে রেখেছেন,সেজন্যে কি আমি আল্লাহর শুকর গোজার করব না?
বস হাসে।জানেন,এই পর্দাশীল ধর্মভীরু মেয়েটা কেমন। এটাও বুঝেছেন,আল্লাহকে ভয় পাওয়া ও ভালোবাসার ফলে যে সততা সে নিজের মাঝে ধারণ করেছে,তাতে উপরের পোস্টের জন্য তার চেয়ে উপযুক্ত আর কেউ হতে পারে না!
আমিরা হেসে উঠে সবার আগে নামাযের রুমে যায়।এই নামাযের রুম ঠিক করার কারণও আমিরা নিজে।শুরুতে অফিসে নামাযের কোন স্থান নির্দিষ্ট ছিল না।কি করে থাকবে?ছেলেরা জামাতে পড়ে,কিন্তু কোন মেয়ে নামায পড়ে না,সেই তাগিদও অনুভব করে না।আমিরা প্রথম প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান স্যারের ঘরে গিয়ে পড়ত যখন তিনি নামাযে ছিলেন।কিন্তু ওর তো নামাযে বেশ সময় লেগে যায়,আর স্যার এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন।অস্বস্তিকর পরিস্থিতি এড়াতে বেশ বলিষ্ঠ গলায় স্যারকে নামাযের স্থানের ব্যাপারে জানায়।স্যার ওর কথায় পরদিনই একটা স্টোর রুম পরিষ্কার করে নামাযের ব্যবস্থা করে দেন।
আমিরা প্রমোশনের খবর পেয়েই দৌড়ে আগে দুরাকাত নফল পড়ে,আনন্দে শরীর কাঁপতে থাকে,কত স্বপ্ন দেখেছে এই কিছু টাকার জন্যে!এখন আর ওকে ওর বোনদের খরচ নিয়ে ভাবতে হবে না।আল্লাহ কিভাবে রিযিক এনে দিলেন ওদের মাধ্যমে!
বাড়িতে ওর প্রমোশন সকলের মনে খুশির জোয়ার এনে দেয়।খেতে বসে আমিরা দুই বোনকে ভাত বেড়ে দিতে দিতে বলে,
-আল্লাহর উপর যে বিশ্বাস রাখে,তাকে আল্লাহ যে কোন অজানা উৎস হতে রিযিকের ব্যবস্থা করে দেন,তা সে কল্পনাও করতে পারবে না!বলেছিলাম আব্বাকে আমাকে নিয়ে চিন্তা না করতে।দেখলি,আল্লাহ কিভাবে তোদের রিযিক আমার হাত দিয়ে পাঠয়ে দিল?
সবাই হাসে,হেসে বলে,"আলহামদুলিল্লাহ!" এটা যে সুখের হাসি,কৃতজ্ঞতার হাসি।
কিছুকাল, কিছু দিন,কিছু মাস,এমনি করে প্রায় বছর খানেক চলে যায়।দিন পেরিয়ে রামাদান মাস চলে আসে।রোযার মাসেও ওদের স্কুল,কলেজ আর অফিসের কোন বন্ধ নেই।গরমে,বৃষ্টিতে,সব অবস্থায় ঘর থেকে বেরুতে হচ্ছে।বাড়িতে ফিরে যাবে,কিংবা ধীরে সুস্থে আল্লাহর ইবাদাত করবে,সেই সুযোগও সীমিত।তিন বোনের আর গ্রামে যাওয়া হয় না।ইট কাঠের খাঁচায় দিনের শেষ ভাগে দৌড়োতে দৌড়োতে ইফতারের ব্যবস্থা করতে হয়,রান্না করতে হয়,সেসব গুছিয়ে আবার পরদিন অফিসে,কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ যাওয়ার জন্য তৈরি হতে হয়।
এ যেন বিরতিহীন অন্তহীন এক যাত্রা,যেখানে মানুষ এত মহান এক মাসেও আল্লাহর হুকুম পালনের সুযোগ কমিয়ে ফেলে দুনিয়ার পিছে ছুটতে ছুটতে। আমিরার হতাশ লাগে,চারদিকে এসব দেখে দম আটকে আসে।এত দাম সবকিছুতে!এত টাকা,সব কোথায় চলে যাচ্ছে!এত গরম,এত কাজের চাপ!সবাই শুধু দৌড়াচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে!
কিছুদিন পর আমিরা বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ে।হাড় কাঁপিয়ে জ্বর আসে।উঠে যে চুলোর কাছে যাবে,সে শক্তিটুকুও পায় না।অফিসে ফোন করে জানাতে বাধ্য হয় যে আজ সে আসবে না।নামিরা,সামিরা মিলে চেষ্টা করে যা করার,কিন্তু ছোটমানুষ গুলো আর কিই বা করবে।যখন ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসে,আমিরা না পারতে বিছানা থেকে উঠে আসে।লাল চোখ আর প্রচন্ড মাথা ব্যথা নিয়ে ফ্রিজ খুলে দেখে,গতরাতের ভাত,একটু ভাজি,শরবত আর খেজুর,অন্য কিছুই নেই।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওদের ডেকে এসবই আয়োজন করতে থাকে।
ইফতারের টেবিলে বসে ৩ বোন অসহায়ের মত চেয়ে থাকে।এতদিন যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে যেন ৪/৫ পদের খাবার থাকে,বিশেষত ফল,সালাদ জাতীয় খাবার।আমিরা বোনদের জন্য কোন কমতি রাখে নি কারণ ওদের দুজনের এটাই বাবা মাকে ছাড়া প্রথম রামাদান।কিন্তু আজ যেন সবকিছু বিবর্ণ।আমিরার মনে হয়,আজ এই বুঝি ছিল রিযিকে? খুব কান্না পায় ওর।এত অসুস্থ শরীরেও কোন মতে রোযা রেখেছে,কিন্তু ইফতার? খাবারগুলো সামনে নিয়ে আমিরার নিজেকে বড্ড বেশি অসহায় লাগতে থাকে।
আল্লাহর উপর যারা নির্ভর করে,আল্লাহ তাদের অকল্পনীয় উৎস থেকে রিযিকের ব্যবস্থা করে দেন।আমিরা ক্ষাণিকের জন্য ভুলে যায় এসব,যেটুকু আছে,অসুস্থ শরীরে সেটুকুর জন্যে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতেও মনে থাকে না।কিন্তু আল্লাহ আমাদের ভুলে যান না।আমরা যত পাপই করি,যতবারই আমরা তার শুকরিয়া গোজার করতে ভুলি না কেন, আল্লাহ আমাদের তবুও রহমত করেন,উনি যে রহমানুর রাহীম!
ইফতারের ১০ মিনিট আগে বাসার বেল বাজে।এই অসময়ে কে এল?নামিরা আর সামিরা উঠে যায় দেখতে।আমিরা ড্রইংরূমে ওদের সাথে কারো কথার শব্দ শোনে।কিছুক্ষণ পর ওরা দুজন দুটো বড় প্লেট ভর্তি নানারকম খাবার,ফল নিয়ে হাসিমুখে ঢুকে।আমিরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে,এসব কোত্থেকে!বিস্ময়ে প্রশ্ন করে,
-এসব কে দিল?!
-নিচতলার অন্তু ভাইয়ার আব্বু!
-হঠাৎ?কোন উপলক্ষ?
-আংকেল আমাদের ফার্মেসিতে ওষুধ আনতে দেখেছেন, তোমার অসুখের কথা বলেছি,সেটাও শুনেছেন।তাই আংকেল এসব পাঠিয়ে দিতে বলেছেন!আরও বলেছেন,তুমি সুস্থ হওয়ার আগে পর্যন্ত আংকেল খাবার পাঠিয়ে দিবে,তুমি যেন মানা না কর!
আমিরা কেঁদে ফেলে।কিছু মুহূর্তের জন্যে ভুলে গিয়েছিল,ওদের আর কেউ না হোক,আল্লাহ আছেন।যদিও আংকেল আন্টি এখানে আসার পর থেকে ওদের তিনজনকে ভীষণ স্নেহ করেন,কিন্তু তবু অসুস্থতার সময়েও উনাদের কাছে যেতে চায়নি।কিন্তু উনারা ঠিকি দেখেছেন,আল্লাহ দেখিয়েছেন!
আমিরার কান্না দেখে নামিরা,সামিরাও কেঁদে ফেলে।ইফতার সামনে রেখে ওরা মুনাজাতের জন্য হাত তোলে,
"আল্লাহ!এই পৃথিবীর সব কিছু তোমার অধীন!তুমিই আমাদের রিযিক দাও,তুমিই নিয়ে যাও।নিজের রিযিক নিয়ে আমরা যতই পেরেশান হই,তুমি আমাদের জন্য আমাদের বরাদ্দ সবটুকুই পৌঁছে দাও!ইয়া আল্লাহ,তুমিই রিজিকদাতা,পালনকর্তা, তুমি রাহমানুর রাহীম!আমরা ভুলে গেলেও তুমি কখনো ভুলো না!আমাদের ক্ষমা করে দাও ইয়া রাব্ব,আমাদের মাফ করে দাও!"
সানবিডি/এনজে