বর্তমান সময়ে বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম আলোচিত বিষয় সিরিয়া সঙ্কট। পাঁচ বছর আগে শুরু হওয়া আরব বসন্তের ঢেউ সিরিয়াতেও আছড়ে পড়েছিল। আর তখন থেকেই দেশটিতে চলে আসছে সঙ্কট। সিরিয়াতে এ পর্যন্ত গৃহযুদ্ধের বলি হয়েছে আড়াই লাখেরও বেশি মানুষ। শরণার্থী হিসেবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছে এক কোটির বেশি সিরীয়।
দেশটিতে বর্তমানে ক্ষমতায় আছে বাশার আল আসাদের নেতৃত্বাধীন সরকার। আসাদ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পাঁচ বছর আগে ইসলামপন্থি নুসরা ফ্রন্টসহ কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী লড়াই শুরু করে। এরপর সেখানে যুক্ত হয় জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস। তবে আইএসের সাথে আল নুসরা ফ্রন্টের রয়েছে বৈরিতা। অনেকের ধারণা আইএস মূলত যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি।
বর্তমানে সিরিয়াতে ৬টি দল বা উপদল সংঘর্ষে লিপ্ত। এগুলো হলো- আসাদ সরকার, বিদ্রোহী গোষ্ঠী, কুর্দি গোষ্ঠী, হিজবুল্লাহ, আইএস এবং কয়েকটি ছোট বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সমন্বয়। সেই সাথে দেশটিতে বিমান হামলা চালিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব এবং রাশিয়াসহ শক্তিশালী দেশগুলো। বাশার সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের লক্ষ্যে হামলা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব। আর আইএস দমনের নামে আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া।
তবে বিভিন্ন সময়ে বিমান হামলা চালিয়ে আসলেও এ পর্যন্ত কেউই স্থল সেনা পাঠায়নি সিরিয়াতে। হঠাৎ করে গত ৫ জানুয়ারি সৌদি আরব ঘোষণা দেয়, জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে লড়াই করতে সিরিয়াতে স্থল সেনা পাঠাতে প্রস্তুত সৌদি আরব। এরপর থেকে সিরিয়া ইস্যুতে আবারো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক অঙ্গন। স্থল সেনা পাঠানোর ঘোষণা দেয় সৌদি আরবের মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনও।
সিরিয়ায় সেনা পাঠানোর বিষয়ে সৌদি আরবের প্রস্তাবকে যুক্তরাষ্ট্র স্বাগত জানালেও এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সিরিয়া ও তার মিত্ররা। সৌদি আরবের ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় সিরীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়ালিদ আল-মুয়াল্লেম বলেন, ‘সিরিয়াতে কেউ সেনা পাঠালে তাদের কফিনে ফেরত পাঠানো হবে।’
এদিকে ১২ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদ জার্মান গণমাধ্যম হান্ডেলসব্লাটকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘সিরিয়ার যুদ্ধে বিদেশি স্থল সেনা প্রেরণ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনতে পারে।’ তার মতে, সিরিয়াতে স্থল সৈন্য প্রেরণ করলে সব পক্ষই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। তার এ মন্তব্যকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সতর্কতা হিসেবে বলা হয়েছে আল জাজিরার বিশ্লেষণে।
সিরিয়াতে স্থল সেনা পাঠাতে সৌদি আরবের ঘোষণা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার আরব মিত্রদের বিবেচনা করে দেখা উচিত- তারা একটি স্থায়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চায় কি না।
অপরদিকে বিদ্রোহীদের দখল থেকে গোটা সিরিয়ার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে বাশার আল আসাদ। বৃহস্পতিবার বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এর পরপরই সিরিয়াতে স্থল হামলার লক্ষ্যে তুরস্কে সেনা মেতায়েন শুরু করে সৌদি আরব। সেই সাথে জড়ো করা হচ্ছে জঙ্গি বিমানও। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, সৌদি আরব এবং তুরস্ক যৌথভাবে তুর্কি ভূখণ্ড থেকে সিরিয়াতে স্থল হামলার পরিকল্পনা করছে।
আর এ খবর নিশ্চিত করেছে তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘সৌদি আরব দায়েশের (আইএস) বিরুদ্ধে তাদের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। তারা বলেছে, যুদ্ধে জঙ্গি বিমান এবং স্থল সেনা- উভয়টিই পাঠাতে প্রস্তুত রয়েছে তারা।’
তিনি আরো বলেন, ‘দায়েশকে হটাতে প্রতিটি যৌথ বৈঠকে আমরা একটি ব্যাপক এবং ফলপ্রসূ কৌশলের প্রয়োজনিয়তার ওপর জোর দিয়েছি। দুই দেশই এ কৌশলে সম্মত হলে তুরস্ক এবং সৌদি আরব তুর্কি ভূখণ্ড থেকে সিরিয়াতে অভিযান চালাতে পারে।’
সুতরাং একদিকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার সতর্কতা, অপরদিকে সিরিয়াতে সৌদি আরবের স্থল অভিযানের ঘোষণা। সেইসঙ্গে সৌদি আরবের সাথে আছে তার পশ্চিমা মিত্ররা। ধারণা করা হচ্ছে, সিরিয়াতে সৌদি আরব স্থল হামলা শুরু করলে ছাড় দেবে রাশিয়াও। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা-বিরোধী লড়াইয়ে আসাদ রাশিয়ার ঐতিহাসিক মিত্র। পরিস্থিতি যা দাঁড়াচ্ছে তাতে সব মিলিয়ে একটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখার অপেক্ষায় আছে বিশ্ববাসী!
সানবিডি/ঢাকা/এসএস