কোভিড পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী ভোগ্য পণ্যের সাপ্লাই চেইনের উপর বেশি মাত্রায় চাপ পড়ায় ও কাঁচামাল আমদানি খরচ বৃদ্ধির ফলে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে আমদানিকারকদের ঋণ সহায়তা ও আমদানিকৃত পণ্যের উপর আরোপিত শুল্ক কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা।
শনিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বেসরকারি খাতের দৃষ্টিতে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির সামগ্রিক পর্যালোচনা’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এ আহ্বান জানান তারা।
আলোচনায় অংশ নেন ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রাহমান, এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন এবং ঢাকা চেম্বারেরর ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি আরমান হক প্রমুখ। ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। আলোচনায় করোনা সংক্রমণের মধ্যেও চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-ডিসেম্বর, ২০২১) বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ আশাব্যঞ্চক হলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যস্ফীতি, রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ, সাপ্লাই চেইন, নীতি-সহায়তা, মানবসম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধি, লজেস্টিক অবকাঠামোর উন্নয়ন সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন ব্যবসায়ী নেতারা।
ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রাহমান ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের অর্থনীতির সার্বিক প্রেক্ষাপটের উপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এতে তিনি বলেন, কোভিড পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী ভোগ্য পণ্যের সাপ্লাই চেইনের উপর বেশি মাত্রায় চাপ পড়ায় আমাদের দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ও কাঁচামাল আমদানিতে দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় বাজারে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমতাবস্থায় বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনয় পণ্যে আমদানিকারকদের ঋণ সহায়তা ও আমদানিকৃত পণ্যের উপর আরোপিত শুল্ক হ্রাস করা হলে সাধারণ জনগণ এ অবস্থা হতে মুক্তি পাবে বলে মত প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, কোভিড মহামারির কারণে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ক পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, একই সাথে তৈরি পোষাকখাতের পণ্যের বহুমুখীকরণ ও নতুন নতুন পণ্য উদ্ভাবনের জন্য উদ্যোক্তাদের আরো মনোযোগী হতে হবে।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি বলেন, শিল্পখাতের প্রয়োজনের নিরিখে আমাদের পাঠ্যক্রমের যুগোপযোগীকরণ এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষ মানব সম্পদ তৈরিতে মনোযোগী হওয়া একান্ত অপরিহার্য। কৃষিখাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকার ঘোষিত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহের মধ্যে অন্তত ১টিকে কৃষিখাতে পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের জন্য বরাদ্দের প্রস্তাব করেন ডিসিসিআই সভাপতি।
সুসুক এর মতো আরো বন্ড ব্যবস্থার প্রবর্তনের মাধ্যমে বেসরকারিখাতের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ঋণ সুবিধা উদ্যোগের আহ্বান জানিয়ে রিজওয়ান রাহমান বলেন, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারী উদ্যোক্তারা যেন ব্যাংকিং চ্যানেল হতে আরো বেশি হারে ঋণ সুবিধা প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও তিনি সিএমএসএমই’দের জন্য সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্র্যাকেজ হতে ঋণ প্রাপ্তি নিশ্চিতের জন্য বাংলাদেশের ব্যাংকের নজরদারি বাড়ানোর জোরারোপ করেন। ব্যবসায়িক কার্যক্রমে হয়রানি হ্রাস ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধিতে দেশের কর ও ভ্যাট কার্যক্রমের সকল স্তরে অটোশেন নিশ্চিতকরণের প্রস্তাব করেন ডিসিসিআই সভাপতি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, কোভিড মহামারী ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি সকল স্তরের জনগনের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছু নীতসহায়তার পাশাপাশি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। তিনি উল্লেখ করেন, কোভিড মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিধিনিষেধ আরোপের কারণে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যে স্থবিরতা পরিলক্ষিত হলেও আমাদের অর্থনীতি এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, সুসুক বন্ড প্রবর্তনের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করা যাবে এবং এ ব্যাপারে বাংলাদেশে ব্যাংক পরবর্তীত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। তিনি উল্লেখ করেন, আমাদের রপ্তানি বেশি মাত্রায় তৈরি পোষাকের উপর নির্ভরশীল, তবে কৃষি, ঔষধ, পাট, সিরামিক, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতি সম্ভাবনাময় খাতকে প্রয়োজনীয় নীতিসহায়তা প্রদানে এগিয়ে আসার পাশাপাশি মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়নে সকলকে মনোযোগী হয়ে একযোগে কাজ করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রধান আরো বলেন, রপ্তানি বহুমুখীকরণ তহবিলের সম্প্রসারণ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের সক্ষমতা বাড়বে। তবে নেগোশিয়েশন দক্ষতা বাড়াতে সকলকে আরো মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি জানান, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়তা নীতিমালা প্রণয়ণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক, বিডা’র সাথে একযোগে কাজ করছে। বিশেষ করে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থার আরো উন্নয়নের মাধ্যমে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যয় উল্লেখজনক হারে হ্রাস করা সম্ভব বলে মত প্রকাশ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। কোভিড মহামারি মোকাবিলায় সকলকে একযোগে কাজ করার পাশাপাশি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়নের উপর জোরারোপ করেন। তিনি সিএমএসএমই খাতকে দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি উল্লেখ করে এখাতের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে সকলকে কাজ করার আহ্বান জানান।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে দেশের কর কাঠামাকে সাময়িক সময়ের জন্য পুনঃবিন্যাস করার দাবি জানাই। তা না হলে সামনের রমজান মাসে আরো ভোগান্তি বাড়বে। শিল্পখাতে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরিতে শিক্ষা ও শিল্পখাতের সমন্বয় আরো সম্প্রসারণের আহ্বান জানান এফবিসিসিআই সভাপতি।
তিনি বলেন, দেশের কৃষিখাতের উন্নয়নে কৃষিপণ্য প্যাকেজিং এবং লজেস্টিক ব্যবস্থাপনায় আরো মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানাই। এছাড়াও এলডিসি উত্তোরণের পরবর্তী সময়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের ঔষধ শিল্পকে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। টেকসই পণ্য হিসেবে পাট হতে উৎপাদিত পণ্য বহুমুখীকরণের মাধ্যমে এ ধরনের পণ্য রপ্তানি আরো বৃদ্ধির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে বলে তিনি অভিমত দেন। লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের সাথে এসএমই উদ্যোক্তাদের একটি বড় অংশ সম্পৃক্ত থাকায় এখাতের প্রতি আরো যত্নবান হওয়ার উপর গুরুত্বারোপ করেন এফবিসিসিআই সভাপতি।
বিদ্যুৎ খাতে সরকারি পুরাতন শিল্পসমূহ, যেগুলো সঠিকভাবে পরিচালনা করা যাচ্ছে না, সেগুলোকে বন্ধ করার পাশাপাশি সিস্টেম লস কমানোর উপর আহ্বান জানিয়ে বলেন, এর মাধ্যমে বিদ্যুতের মূল্য ভোক্তাদের সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে। দেশের লজেস্টিক খাতের উন্নয়নে ১২ বছরের জন্য একটি দীর্ঘময়োদী পরিকল্পনা প্রদানের লক্ষ্যে এফবিসিসিআই কাজ করছে, যা শীঘ্রই সম্পন্ন করে সরকারের নিকট উপস্থাপন করা হবে।
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, দেশের অভ্যন্তরীন নদীপথ ব্যবহার করা সম্ভব হলে, পণ্য পরিবহনের খরচ এক-তৃতীয়াংশ কমানো যেতে পারে এবং এ লক্ষ্যে নদীপথের সংষ্কারের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
এএ